দিনের আলোয় এতটা অসহায় লাগে না। কিন্তু রাতে চেম্বার থেকে ফেরার সময় ধূ ধূ ফাঁকা রাস্তায় কান্না পায়।
রাত দশটায় মধ্যমগ্রাম ওভারব্রিজ পার হচ্ছি। পুরো ওভারব্রিজে আমি একা। ঠিক মাঝখানে পৌঁছে স্কুটার থামালাম। রেললাইনের দু’ধারে সার সার আলো জ্বলছে। সিগনালের আলো লাল। মনে হচ্ছে হলিউডি হরর ফিল্ম। মৃতের শহরে আমি একা বেঁচে আছি।
আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আমি হাউমাউ করে কাঁদলেও কেউ ফিরে তাকাবে না।
বড় অসহায় লাগছিলো। কতটা অসহায়? অনেকটা গ্রামীণ হাসপাতালের সেই দিনটার মতো।
২১৮ জন কুকুরে কামড়ানো রোগীর ইনজেকশন পেন্ডিং। ড্রিস্টিক থেকে সাপ্লাই এসেছে ৩০ জনের।
আমি ফোনে আর্তনাদ করছি, ‘স্যার, এর থেকে সাপ্লাই দিতেন না। কাকে ছেড়ে কাকে দেব? সকলে ছিঁড়ে খাবে।’
ওপাশ থেকে ঠান্ডা ঘরে বসে বড়কর্তা বলছেন, ‘প্রায়োরিটি অনুযায়ী দাও। প্রায়োরিটি ঠিক করার জ্ঞান টুকু নিশ্চয়ই আছে?’
৩০ টা ইনজেকশনের জন্য ৩৩ টা রেকমেন্ডেশন লেটার। এম এল এ, পঞ্চয়েত প্রধান, বিডিও, পঞ্চায়েত সদস্য সকলেই চিঠি লিখেছেন। এই রেকমেন্ডেশনের বাইরে যে ভারতবর্ষ আছে তারা আধপেটা খায়, সন্তান উৎপাদন করে আর লাইন দিয়ে সব জায়গা থেকেই ব্যর্থ হলে ফেরে। যাওয়ার সময় অভিশাপ দিয়ে যায়। ‘এটা ঠিক করলা না ডাক্তার। ছুঁইয়ের টাকা ঠিকই এয়েচে। তুরাই টাকা মারি দিছিস। আমার ছাওয়ালের যদি কিছু হয়, তোরটাও বাঁচবে নারে।’
প্রায়োরিটি বস্তুটা কি? এদেশে যার বেশি অর্থ আছে, তার ইচ্ছাটাই হলো প্রায়োরিটি। বেশি পরিমাণে অর্থ উপার্জনের কৌশল লেখাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই প্রায়োরিটির চাপেই N95 মাস্ক বাজার থেকে রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়। তরুণ চিকিৎসকেরা সার্জিক্যাল মাস্ক পরেই অভিমূন্যের মতো চক্রব্যূহে ঢুকতে বাধ্য হয়।
এদেশের প্রায়োরিটি কি? ২০২০ সালের বাজেট অনুযায়ী স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। আর শুধু আর্ম ফোর্সের জন্যই বরাদ্দ ৪ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা। অতএব পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ যে দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটির, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশের জায়গা নেই।
চিকিৎসকদের সাথে দয়া করে সৈন্যবাহিনীর তুলনা করবেন না। এতে সেনাদের অপমান করা হয়। কোনো সেনাই প্লাস্টিকের বন্দুক নিয়ে আসল লড়াইয়ের মাঠে নামেনা। আর বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল ও করোনা সেণ্টার কলকাতা মেডিকেল কলেজে আমার ভাইবোনদের PPE এর নামে দেওয়া হচ্ছে ছেঁড়া কমদামি রেনকোট। N95 মাস্কের বদলে দেওয়া হচ্ছে সার্জিক্যাল মাস্ক।
তবু ভাইবোনগুলি মৃত্যুপুরীতে হাসিমুখে ঢুকছে। দিনের পর দিন বাড়ি ঘর থেকে নিজেকে হাসপাতালেই কোয়ারান্টাইন করে রাখছে।
যে সব উপরতলার চিকিৎসক নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা কি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে থাকতে চিকিৎসা শাস্ত্রের গোড়ার কথা গুলো, ইনফেকশন প্রিভেনশনের বেসিক তথ্যগুলো ভুলে গেছেন?
স্কুটারে স্টার্ট দিলাম। বাড়ি ফিরে স্নান করতে হবে। সারাদিনের পরা জামাকাপড় কেচে ফেলতে হবে।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি বাবা স্কুটার বার করছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছ?
একটা লেবার পেশেন্ট ভালো প্রগ্রেস করছে না। এমারজেন্সি সিজার হতে পারে। আমি রাতে ফিরব না। নার্সিং হোমেই থেকে যাব। রাতের আর এম ও আসতে পারেনি।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবা স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে গেল। বাঙালি আত্মঘাতী জাতি কিনা জানিনা, তবে বাঙালি চিকিৎসক নিসন্দেহে একটি আত্মঘাতী জাতি।