স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষে মুক বধিরদের ভাষা বা কথা জোগানোর পদ্ধতি নিয়ে সাতসতেরো মত তৈরি হয়েছে | হচ্ছেও | তর্কটাকে এখন আর অভিমতের দ্বন্দ্ব বলে মনে হয় না | বধির শিশুর বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে এইসব মতামতের ভিন্নতাকে এখন সেরেফ মর্জির ঝঞ্ঝাট বলেই মনে হয় |
আমরা , মানে আমরা যারা বধিরদের শিক্ষা নিয়ে ভাবছি —ফি রোজ নতুন পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করছি — কেমন যেন মনে হয় ওদের জন্য সরল কোনো ভাষা আবিষ্কার এবং সেই ভাষায় ওদের এগোনোটা নিশ্চিত করার চেয়ে নিজেদের মনমতো ভাষা ঢোকানোটাই করছি বেশি | কখনো শোনার প্রশিক্ষণ বা Auditory Training কখনো বা ঠিক আমাদের মতো কথা বলানোর চেষ্টা বা Speech stimulation দিয়ে এদের ওপর অনবরত উৎপাত চালাচ্ছি | ওদেরকে না বুঝে কেবল জোর আর জোর | নিজের ভাষার সাম্রাজ্য বাড়ানো
সন্দেহ নেই –মাস্টার পন্ডিত সবিশেষ বিদগ্ধ হচ্ছেন | কিন্তু এতো বছর শিক্ষকতার পর আমার কেবলই মনে হয় — তত্ত্ব নীতির ঝগড়াঝাটিতে এক কোণে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে গেলো আমার কথা না বলা জ্যান্ত জ্যান্ত পুতুলগুলো | বাচ্চাগুলো চ্যুত হল নিজের অনুভব বা বোধের জগৎ থেকে | ইংরেজিতে বললে বলতে হয় —ট্রেনিং হল তাদের | শিক্ষা নয় | কেননা শেখাতে গিয়ে তো ভুলিয়ে দিলাম তাদের অন্তর্নিহিত আনন্দ | দেখার বিলাস | বাঁচার আমেজ | নিয়মিত বেঁচে ওঠার ইচ্ছে | সব নষ্ট করলাম |
ধরেই নিলাম — কানে না শোনা কিংবা কথা বলতে না পারার সাথে সাথে এরা যেন চোখ মেলে দেখতে বা মন খুলে বুঝতে জানে না | বুঝলাম না — কী অনাবিল সহজতায় , বিশ্বাসে এবং অনবরত তৎপরতায় একটি কানে না শোনা , কথা না বলা বাচ্চাও জীবনের যে কোনো পরিস্থিতির সামাল দেয় | দেয়ার সামর্থ্য ধরে |
অনেকদিন আগে প্রকৃতিশিক্ষা দেব বলে আমার স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলাম গাদিয়ারা | আগেই বলেছি —বেশ কিছুদিন আমার ও আমার সহকর্মীদের মনে হচ্ছিল — Articulation Training এর থেকে এদের এখন অনেক বেশি দরকার –ভর্তি বা ন্যাড়া শস্যক্ষেত্রে অনেকক্ষণ ধরে বিচরণ | খোলা মাঠে দৌড় –কেবল দৌড় | এমনকি প্রবল বজ্রবর্ষায় খানিক একা দাঁড় করিয়ে রাখা — যাতে তারা প্রতিকূল আবহাওয়াকে সামাল দিতে শেখে | মাথায় রুমাল বেঁধে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মত বর্ষায় একটা শুকনো চালাঘর খুঁজে নিতে পারে আমার বধির রাধা কৃষ্ণ | কিশোর কিশোরী |
তো সেবার সারাদিন ধরে চলছে এদের প্রকৃতি বিচরণ | দিন এগোচ্ছে | দুপুরে সূর্য্য কাঁসা পিতলের রঙ নিচ্ছে | বিকেল এগোচ্ছে পায়ে পায়ে সন্ধে অভিমুখে | কমলবরণ ধরছে কমলাটে আকাশে | এক ক্ষেতে সর্ষের কচি হলুদ তো পাশের ক্ষেতে বিস্কুট রঙের ধান | গ্রামের চার্চে এই ঘন্টা পেটালো তো পর মুহূর্তেই অনতিদূরে আজান | খেয়াল করলাম গভীর মনোযোগে বাচ্চাগুলো সব দেখছে | শুনতে না পেলেও চার্চের বাজনা আর মসজিদের ঈশ্বর আবাহনের শব্দ যে আলাদা তা যেন মুঠো পাকিয়ে করতলে ধরতে চাইছে |
বোঝাতে বোঝাতে আমরা ক্লান্ত | আর বুঝতে পেরে ওরা সমাহিত | হোটেলে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে ! তবু প্ৰফুল্ল !
পরদিন ফিরবো | নদীপথে | মাঝনদীতে মাঝি খবর দিলো নৌকায় ফুটো | জল ঢুকছে | সবচেয়ে কোলপোঁছা বাচ্চাটাকে চেপে ধরে বসে আছি | প্রবল মৃত্যুভয়ে আমি , আমার বাচ্চা | হঠাৎ দেখলাম সব কটা বাচ্চা মাঝির সাথে যোগ দিয়েছে জল ছাঁচতে | মাঝি না ডাকতেই — আমরা না বলতেই |
একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে না ? মাঝি বললে –” জাহাজ এগোলে তার ঢেউয়ে কিন্তু নৌকো আরো ডুববে | রুমাল নাড়ান শিগগির | ” নাড়াচ্ছি | ছোট রুমাল বেশ কটা বেরিয়ে পড়ল সবকটার স্কার্ট প্যান্টের পকেট থেকে |
আরে তবু এগিয়ে আসছে যে জাহাজটা ! থামছে না যে | আঁচলে টান পড়ল | দেখি সবচেয়ে বড় ছেলেটা আমার শাড়ি খুলে দিচ্ছে | ইশারায় বোঝাচ্ছে প্রাণপণ —” ওরে বোকা আন্টি তোর শাড়ি খুলে মেলে দে দুদিকে | বড় বস্ত্র ঠিক নজর করবে জাহাজ |” দুহাত দুপাশে পাখির মত দুলিয়ে শাড়ি মেলার কায়দা শিক্ষককে বোঝাচ্ছে শিক্ষার্থী | বোঝাতে বোঝাতে থুতু বের করে ফেলল বধির কিশোর | বাঁচা ও বাঁচিয়ে দেবার ফিনকি ছোটা তেজে আপনি তুমি তুই সব গুলিয়ে ফেলল সে | , তুই আর তুই ! ” –ও আন্টি তুই এই কর –আন্টি বাঁদিকের আঁচল আরো বাড়া –বাড়াআআ ! ”
পুত্রের উপদেশে সেদিন তার মা শাড়িটা খুলেই ফেলেছিল | আর জলের মধ্যে রঙিন এক শাড়িপাখি দুলছে দেখে আর এগুলো না জাহাজ |
কাদাভরা পুরোনো ঘাটে এসে আছড়ে পড়ল নৌকো | খুব কাঁদছিলাম আমি | লাজশরমের মাথা খেয়ে কাঁদছিলাম | নিজে বেঁচেছি বলে –না কোলেরগুলো বেঁচেছে বলে, তা আজ স্পষ্ট মনে পড়ে না | শুধু খেয়ালে আছে , সায়া ব্লাউজে একগাদা কাদামাটি মেখে দাঁড়িয়ে আমি —আর বকবক করতে করতে আমায় পেঁচিয়ে ধরেছে সেই ছেলে | মার গায়ে এবার বস্ত্র পরাবে প্রিয় পুত্র | পাকে পাকে — অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঢেকে ঢেকে |
আকাশ নদী খুল্লাম প্যার করে | ফুটো জলযান ফিরছে সেই নদীটি ধরে | সবল করে দিয়ে গেছে অ – বাক সন্তানেরে |
অসিত না সফিকুল ? কে ছিল সে ? নাহ ! নাম টাম মনে নেই |
অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর বর্ননা, “শিখলি কোথায়?ঠেকলি যেথায়”