দিনক্ষণ হিসেব করে নয় সম্ভবত – কিন্তু, ঠিক পয়লা বৈশাখে হালখাতার দিনটিতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করলেন কোভিড উনিশ মোকাবিলায় তাঁদের গাইডলাইনের লেটেস্ট আপডেট।
অবশ্য এই বিশেষ সঙ্কটটির মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেরকম অবস্থান বদলেছেন বারবার, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো অবস্থান থেকে সরে এসেছেন প্রায় একশ আশি ডিগ্রি – এই আপডেটের আয়ু কদিন বলা মুশকিল। মানছি, অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মোকাবিলায় এরকম চিন্তাভাবনা-পদক্ষেপের ইউ-টার্ন সম্ভবপর – কেননা, যত নতুন তথ্য আসবে, ততোই বেশী বেশী করে আমরা বিষয়টি নিয়ে জানতে পারব – আর ততোই বদলাতে থাকবে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ – বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যকলাপের নিয়ম এমনটাই – তবু, গাইডলাইনের ব্যাপারে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত। একটা কিছু জানতে পারা মাত্রই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো নতুন সিদ্ধান্ত আসতে থাকলে বিভ্রান্তি বাড়ে – তার বেশী কিছু উপকার হয় না।
বিশেষত, তথ্যের পাশাপাশি কমন সেন্স বা কাণ্ডজ্ঞান – বিশ্বব্যাপী গাইডলাইন জারির মুহূর্তে দুটিই সমান বিবেচ্য হওয়া উচিত। যেমন ধরুন, যে অসুখ এমন সংক্রামক, তার যে একটি উপসর্গহীন সংক্রামক পর্যায় থাকতে পারে – এই সম্ভাবনা শুরুতেই মাথায় রাখা যেতে পারত – অন্তত বাড়তি সাবধানতা হিসেবে, সেই উপসর্গহীন সংক্রমণের সম্ভাবনা যে একদম নেই, একথা না বলা-ই উচিত ছিল। এই সম্ভাবনা মাথায় রাখলে আমজনতার জন্যে মাস্ক পরার বিষয়টি আরো আগে ভাবা যেতে পারত – অসুখ ছড়িয়ে পড়া আটকানোর কাজে, কিছুটা হলেও, সুবিধে হত।
কিন্তু, যা হয়নি, সে নিয়ে হাহুতাশ করার মানে হয়না আর। এখন, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কী কী করা যায়, সেটা ভাবা উচিত। বিশেষত, এই দফার নির্দেশিকাটি যথেষ্ট সুচিন্তিত ও পরিণত – বর্তমান কর্তব্য তো বটেই, আগামীদিনেও কী কী করা উচিত সে নিয়ে দিশা দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে।
আপডেটেড গাইডলাইনের শুরুতেই জানানো হয়েছে – লক্ষ্য বলতে, একজন আক্রান্ত থেকে অনেকজন সংক্রামিত আর সেই অনেক সংক্রামিত থেকে চারপাশে অসুখ ছড়িয়ে পড়া – অর্থাৎ, একটি কেস থেকে আক্রান্তের ক্লাস্টার তৈরী হওয়া আর সেই ক্লাস্টার থেকে বিস্ফোরক আউটব্রেক – তাকে ঠেকাতে হবে, যে করেই হোক।
আর এর জন্যে যে পদক্ষেপগুলো জরুরী, তার ক্ষেত্রে তিনটি কথা মাথায় রাখতে হবে –
১. দ্রুততা – কেননা, এ অসুখ এমন সংক্রামক যে সামান্য ঢিলেঢালা ভাব ও সময় নষ্ট করা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে।
২. আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছি, তার পরিসর বা স্কেল – এই অসুখ নিয়ন্ত্রণে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ভিন্ন অসুখ সামলানো সম্ভব নয়।
৩. ইক্যুইটি বা সমতা – কোভিড উনিশ যথার্থই একটি বিশ্বব্যাপী ক্রাইসিস – পৃথিবীর সর্বত্র অসুখ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে কেউই বিপন্মুক্ত নন। ক্রাইসিস যেখানে গভীর – অর্থবল বা টেস্টকিট বা অন্যান্য সামগ্রী সেখানে জরুরী ভিত্তিতে পাঠানো উচিত – নিজের দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আলাদা করে মানে নেই, কেননা অন্যত্র অসুখ নিয়ন্ত্রণে না এলে নিজের দেশটিও সুরক্ষিত থাকবে না। এখানে চাচা-আপন-প্রাণ-বাঁচার যুক্তি অবান্তর।
এর পাশাপাশি প্রতিটি দেশকে নিজেদের পরিস্থিতি, সামর্থ্য ও পরিকাঠামো অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে – যাতে যত দ্রুত সম্ভব সংক্রামিত মানুষদের চিহ্নিত করা যায়, যাতে তাঁদের সংস্পর্শে আসা মানুষজনকে বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় – লক্ষ্য একটাই, এই ভাইরাসের একজনের থেকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়া যতদূর সম্ভব আটকানো – পরিভাষায়, আ স্টেডি স্টেট অফ লো-লেভেল অর নো ট্রান্সমিশন।
এরই মাঝে মাথায় রাখতে হবে, যেখানে অসুখ আপাত নিয়ন্ত্রণে, অন্তত প্রথম দফায় আপাত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হয়েছে – সেখানেও নতুন করে ভাইরাস এসে পৌঁছাতে পারে – নতুন করে সংক্রমণ শুরু হতে পারে – কেননা, মানুষের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না দীর্ঘমেয়াদে – অতএব, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরো সক্রিয় হওয়া জরুরী।
প্রতিটি ব্যক্তিমানুষকে পালন করতে হবে সাধারণ কিছু সচেতনতা – যেমন –
১.হাত ধোয়া
২.বারবার মুখে হাত না দেওয়া
৩.গুড রেস্পিরেটরি এটিকেট, অর্থাৎ কাশি বা হাঁচির সময় রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা বা কনুইয়ের উল্টোপিঠ দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা
৪.অসুস্থ হলে বাইরের লোক থেকে তো বটেই, পরিজনদের থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা
৫.করোনা-আক্রান্ত বা সেরকম কোনো সন্দেহভাজনের সংস্পর্শে এলে নিজেই এগিয়ে এসে প্রশাসনকে জানানো
৬.সরকারি নির্দেশনামা মেনে অপরের সাথে দূরত্ব রক্ষা করা (ফিজিকাল ডিস্ট্যান্সিং) বা বাড়ির বাইরে না বেরোনো (যেদেশের সরকার যেরকম বলছেন)
(বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও সবার জন্যে মাস্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে উঠতে পারলেন না!!!)
সরকারের দায়িত্বের মধ্যে অন্যান্য কথাবার্তার মধ্যে আলাদা করে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্যে বাড়তি অর্থ জোগানো এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষজনের জন্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিষেবার ব্যবস্থা চালু রাখা।
বেসরকারি সংস্থাদের উদ্দেশেও এই সঙ্কটকালে বাড়তি মুনাফার কথা না ভেবে ন্যায্যমূল্যে পরিষেবা চালু রাখা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন ও বিক্রয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে – কিন্তু, সে আশার সারবত্তা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। আপনি যদি ন্যায্যমূল্য বা উচিত মূল্যের ধারণার পরিবর্তে ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ভারসাম্য থেকে উদ্ভূত বায়বীয় ভাবনায় সীলমোহর দেন – তাহলে ব্যবসায়ীদের কাছে এবম্বিধ পরিস্থিতিতে তথাকথিত সদিচ্ছের আশা করা অনুচিত – কেননা, ওই একই চিন্তাক্রম অনুসারে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা ব্যবসার অবশ্যপালনীয় সৎ-ইচ্ছা।
দেশগুলির কর্তব্য বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি জনগোষ্ঠী যাতে কোভিড নিয়ন্ত্রণে সামিল হতে পারে – যাতে তাদের বক্তব্য শোনা হয় এবং যাতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় – সরকারকে সে বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। আমাদের দেশে অবশ্য এ বিষয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো – এখানে কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ছড়ালে তাদের দোষারোপ করে ঘৃণা-বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টিই দস্তুর।
পরীক্ষানিরীক্ষা প্রসঙ্গে নির্দেশিকার বদলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ – আমার কাছে কখন রোগী আসবে তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে না থেকে যত দ্রুত সম্ভব সক্রিয়ভাবে আক্রান্ত/সংক্রামিত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে পরীক্ষা করা। অর্থাৎ, যাঁদের উপসর্গ রয়েছে এবং অল্পবিস্তর জটিল উপসর্গ রয়েছে – পরীক্ষা তাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে লক্ষ্য হবে, সব সংক্রামিতকেই খুঁজে বের করা -এমনকি যাঁদের মধ্যে উপসর্গ এখনও শুরু হয়নি, খুঁজে বের করতে হবে তাঁদেরও।
নড়বড়ে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিয়ে এই কাজ সহজ নয়। জনস্বাস্থ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যে অধিকতর বিনিয়োগ অর্থবরাদ্দের দাবী ডাক্তারদের তরফে বারবার এসেছে – কিন্তু, কোনো অজ্ঞাত কারণে সে দাবী কখনোই জনগণের দাবী হয়ে ওঠে নি। সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবীতে পথে নেমেছেন যে সংখ্যার চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী, সে তুলনায় আমজনতার অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। আজ আচমকা পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার আশা কম।
এই করোনা-পরিস্থিতি মোকাবিলার শুরুর মুহূর্তেও সরকারের মুখ্য মাথাব্যথা ছিল – দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় ভেন্টিলেটর আছে তো!! আমজনতার কাছে হিসেব পেশ করাও সহজ ছিল – করোনা-আক্রান্তের পাঁচ শতাংশের যদি ভেন্টিলেটর লাগে আর দেশের জনসংখ্যার এত শতাংশ যদি আক্রান্ত হন ইত্যাদি ইত্যাদি – হিসেব কষে একমাত্র ঘাটতি যে ভেন্টিলেটরের সংখ্যায়, এ কথা আমজনতা দিব্যি বোঝেন। অন্তত, এই একটি ব্যাপারে রাজ্য-কেন্দ্রের ফারাক নেই – প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধুঁকুক ক্ষতি নেই, নীল-সাদা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল নিশ্চিত ভোট-ক্যাচার। এমনকি, এই ঘোর করোনা-সঙ্কটেও রাজ্যের কমিটিতে প্রশিক্ষিত জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞের ঠাঁই নেই।
অথচ, এদেশেই করোনা-মোকাবিলায় আশ্চর্য সাফল্য দেখিয়েছে কেরল – এবং সে সাফল্য দুর্দান্ত আইসিইউ-আইটিইউ গড়ে তোলার পথ ধরে আসেনি – এসেছে সুগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের পথ ধরে – এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জনসমাজের অধিকতর অংশগ্রহণের হাত ধরে।
আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ? এই রাজ্যে যদি উত্তরবঙ্গের করোনা-পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ছড়ি ঘোরান স্বাস্থ্যভবনের বিশেষজ্ঞ, তো রাজ্যের কার্যকলাপে নজরদারি করতে আসেন কেন্দ্রের এক্সপার্ট টিম। কাজ ঠিকঠাক চলছে কিনা, সামগ্রিক লক্ষ্যপূরণে সর্বত্র সমানতালে কাজ এগোচ্ছে কিনা – দেখভাল প্রয়োজন নিঃসন্দেহে – কিন্তু, সম্পর্কটা সহযোগিতার সুরে বাঁধা থাকা বাঞ্ছনীয়, কথাবার্তার সুর উর্দ্ধতন-অধস্তনের মতো শোনালেই মুশকিল।
কেন্দ্রীয় স্তরে একটি নির্দেশিকা জরুরী নিঃসন্দেহে – কিন্তু, স্থানীয় স্তরে তার প্রয়োগ যে স্থান-কাল-পরিস্থিতি বিচার করে স্থানীয় আধিকারিক করবেন এবং গাইডলাইনের মধ্যে থেকেই তাঁর যে কিছু স্বাধীনতা জরুরী – এ মেনে নিতে আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ভারী অসুবিধে।
বারবার মনে না করালে কারো খেয়ালই থাকে না – তাই, আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে বিকেন্দ্রীকৃত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর কমিউনিটি পার্টিসিপেশনের কথা বলছেন – নির্দেশনামার পূর্বেই সে পথে চলে সাফল্যের দিশা দেখিয়েছে কেরল। সে সাফল্য এখনও চূড়ান্ত নয় – তবে আপাতত চমকপ্রদ তো বটেই। (কেরল মডেল নিয়ে আলাদা করে আলোচনা পরে কখনও করব)। কিন্তু, কে শুনছে সে কথা!!!
কাকতালীয়ভাবেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনামার ঠিক পরদিনই আমাদের দেশে জারি হল লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশনামা। না, লকডাউন অবান্তর, এমন কথা একবারও বলছি না – পরিস্থিতির বিচারে সে সম্ভবত খুবই প্রয়োজনীয়। কথাটা সরকারি নির্দেশিকার সাথে অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের ফর্দটি ঘিরে – বা বলা ভালো, নির্দেশিকার মূল সুরটি নিয়েই।
যেমন ধরুন, পাব্লিক প্লেসে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে – মাস্কের কথা দূরে থাক, গৃহহীন ফুটপাথবাসীর সামনে মুখে রুমাল বেঁধে ঘোরার সামর্থ্যও কি আছে? এদিকে সরকারবাহাদুর জানিয়েছে, নির্দেশনামা অগ্রাহ্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাহলে?? বলা হয়েছে, প্রকাশ্য কোনো স্থানে পাঁচজনের বেশী জড়ো হওয়া শাস্তিযোগ্য – কিন্তু, বাজার খোলা থাকলে এ নিয়ম মেনে চলা সম্ভব?? বলা হয়েছে, মদ-বিড়ি-সিগারেট-গুটখা বিক্রি বন্ধ – ধরা পড়লে ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেরই শাস্তি হতে পারে – কিন্তু, লকডাউনের মধ্যে তো অত্যাবশ্যক সামগ্রী বাদ দিয়ে সবকিছুরই বিক্রিবাটা বন্ধ আর উপরিউক্ত সামগ্রীসমূহ অত্যাবশ্যকের তালিকায় ঢুকেছে বলে নতুন কোনো খবরও নেই – তাহলে আলাদা করে এমন শাস্তির ঘোষণার যুক্তি কী??
সব থেকে বড়ো কথা, সমাজের সবাইকে নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার দিশা এই নির্দেশিকায় পাওয়া মুশকিল। এবং, নির্দেশিকার মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণের সুরটিই অনুপস্থিত – উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কর্তৃত্বের সুর ছত্রে ছত্রে।
দ্বিতীয়ত, করোনা-আক্রান্ত তো বটেই, কিন্তু তাঁদের বাদ দিয়েও বাকি মানুষ যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন, সে নিয়ে বাড়তি সজাগ থাকতে বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু, এই মুহূর্তে ক্যানসার-আক্রান্ত মানুষজন রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি নিতে পারছেন না ঠিকভাবে, ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের আকাল, নিয়মিত ডায়ালিসিস প্রয়োজন যাঁদের, তাঁরাও মুশকিলে – অধিকাংশ হাসপাতালে ইলেক্টিভ অপারেশন বন্ধ, এমার্জেন্সি বাদ দিয়ে অধিকাংশ চিকিৎসা স্থগিত – আর, এদেশে যেহেতু স্বাস্থ্যপরিকাঠামো বিকেন্দ্রীকৃত হতে পারেনি, অনেককেই চিকিৎসার জন্যে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ – লকডাউনে যাতায়াত দুরূহ। দেশের বিপুল সংখ্যার শিশু টীকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে – এদের একটা বড় অংশ ভ্যাক্সিন দিয়ে ঠেকানো যায় এমন অসুখে ভোগার সম্ভাবনা। আশ্চর্য ব্যাপার এই, এসেনশিয়াল হেলথ সার্ভিস বজায় রাখার উপদেশের সাথে সাথে টীকাকরণ কর্মসূচী স্থগিত রাখার পরামর্শ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ই দিয়েছেন।
আর সমাজে যাঁরা নীচের সারিতে রয়েছেন – অর্থাৎ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ – অসুখ সামলানোর বিবিধ সরকারি ক্রিয়াকলাপে তাঁরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। তাঁদের জন্যে সামাজিক সুরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করার কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বললেও এদেশের সরকার তেমন কিছু কার্যকরী পদক্ষেপের কথা জোরগলায় বলছেন কই!!
পরীক্ষা করার ক্ষেত্রেও বিস্তর জটিলতা। এ মাসের সতেরো তারিখের গাইডলাইনে আইসিএমআর জানিয়েছেন, আপনি গত দু’সপ্তাহের মধ্যে বাইরে থেকে এলে (লকডাউনের চতুর্থ সপ্তাহে এমন ভাবনার যুক্তি কী!!), জানা করোনা-আক্রান্তের সংসর্গে এলে বা স্বাস্থ্যকর্মী হলে এবং, হ্যাঁ মনে রাখুন, এসবের সাথে সাথে উপসর্গ থাকলে, তবেই পরীক্ষা করাতে পারবেন। তাহলে সক্রিয়ভাবে বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে উপসর্গের আগেই সব সংক্রামিতের খবর নিয়ে ফেলা যাবে কী করে??
উপসর্গহীন অবস্থায় পরীক্ষা করানোর নিদান হটস্পট বা তেমন হাই-রিস্ক পরিস্থিতি থেকে এলে, একমাত্র তখনই। এই হটস্পট বা হাই-রিস্ক পরিস্থিতির সঠিক চিহ্নিতকরণ কিন্তু খুব সরল নয়। তাছাড়া রাতারাতি তো কোনো এলাকা হটস্পট হয়ে যায় না – আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন নির্দেশিকা অনুসারে তো কেস থেকে ক্লাস্টার তৈরী হওয়া ঠেকানোই লক্ষ্য – সেক্ষেত্রে তো হটস্পট তৈরী হওয়া আটকানো জরুরী – তাহলে??
বাড়াবাড়ি উপসর্গ থাকলে তো বটেই, এমনকি জ্বর-সর্দি-কাশি-শ্বাসকষ্ট হলেও পরীক্ষা করার কথা। হচ্ছে কি? সত্যি বলতে কি, এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে সিজন চেঞ্জের বাজারে জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন এমন সব মানুষের ব্যয়বহুল পরীক্ষা করে ফেলা আদৌ সম্ভব?? তবু, পরীক্ষা যতজনের হওয়া উচিত, তার সামান্য একটা ভগ্নাংশের মধ্যেই পরীক্ষা করা হচ্ছে – আরো অনেক বেশী করে পরীক্ষা হওয়া উচিত – এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
কাজেই, ব্যাপারটা খুব সহজ বা সরল নয়। র্যাপিড টেস্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন বিষয়টাকে আরো জটিল করে দিয়েছে।
একদিকে যথেষ্ট সংখ্যায় টেস্ট না হওয়ায় সাধারণভাবে সংক্রামিত কজন, তার আন্দাজ পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দাজ না পাওয়ার বিপদ কিন্তু অন্যত্র – এর ফলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপক হারে সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা – খেয়াল করবেন, জ্ঞাত করোনা-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার সাথে জড়িত যারা, অর্থাৎ ফ্রন্টলাইন হেলথ পার্সোনেল, তাঁদের থেকেও বেশী করে আক্রান্ত হচ্ছেন সেই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা, যাঁরা অজ্ঞাতে করোনা-আক্রান্তের চিকিৎসা করেছেন। এইবার উপসর্গহীন করোনা-আক্রান্ত মানুষের অন্যান্য সমস্যার চিকিৎসার সাথে জড়িত যে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা, তাঁদের মধ্যে কতজন আক্রান্ত, তার হিসেব পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একদিকে, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করলে, পুরো সমাজেই সংক্রমণ লাগামছাড়া হয়ে দাঁড়ানোর ভয় – অন্যদিকে, বড় সংখ্যায় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ার্যান্টাইনে চলে গেলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিই বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
আবার আরেকদিকে, করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু রাখঢাকের সুবাদে গুজব ছড়ানো যাচ্ছে ঢালাও – চাপা আতঙ্ক আর প্যানিকের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।
কারা কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন, কাদের কাদের পরীক্ষা করা দরকার – এ বিষয়ে জরুরী ফিডব্যাক পাওয়া যেতে পারত যথেষ্ট সংখ্যায় কমিউনিটি পার্টিসিপেশন নিশ্চিত করা গেলে। একজন আক্রান্ত/সংক্রামিত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন ঠিক কতজন, কতজনকে কীরকমভাবে আলাদা রাখা জরুরী – বিশেষত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে – বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বা বস্তির মধ্যে – এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে কমিউনিটি পার্টিসিপেশন ছাড়া পথই নেই। দুর্ভাগ্যজনক, সে প্রয়াস একেবারেই হয়নি – উল্টে, আগেই বলেছি, কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে বা ঘনবসতিপূর্ণ কোনো অঞ্চলে অসুখের খবর পাওয়ামাত্র তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচার এমন হয়েছে, যাতে তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতার আশা তো দূর, তাঁদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে ঢালাও।
অথচ, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই সব্বার সক্রিয় সহযোগিতা ভিন্ন সম্ভব নয়।
আমাদের অভ্যেস দাঁড়িয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, জাতের ভিত্তিতে, শ্রেণীর ভিত্তিতে মানুষকে অপর হিসেবে ভাবা – সবসময় ব্যাপারটা ঘৃণা-বিদ্বেষের পর্যায়ে না পৌঁছালেও, অবিশ্বাসের শিকড় অনেক গভীরে। মাথায় রাখুন, করোনা-উত্তর বিশ্ব অন্যরকম দাঁড়াবে।
প্রথমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, এই ভাইরাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কোনো আশা তাঁরা দেখছেন না। লক্ষ্য একটাই, একজনের শরীর থেকে অন্যের শরীরে ছড়ানোকে যতদূর সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞানী-গবেষকদের অনুমান, এই কোভিড-উনিশ পর্ব চলতে পারে অনেকদিন – এবছর তো বটেই, সামনের বছরেও – এমনকি, অনেকের অনুমান, দুহাজার বাইশ কি চব্বিশ অব্দি। কাজেই, ভাবনা দীর্ঘমেয়াদী হওয়া জরুরী। অতদিন, নিশ্চিতভাবেই, লকডাউন চলবে না – দিন-আনি-দিন-খাই-রা তো বটেই, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আপনিও আর্থিকভাবে নিরাপদ থাকবেন না।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সর্বত্র ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে বাকি সারা বিশ্বই নতুন সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে – অর্থাৎ, ইথিওপিয়ায় অসুখের বাড়াবাড়ি হবে আর ইন্ডিয়া নিরাপদ – এমন আশার যুক্তি নেই। সবাই সুস্থ না হলে সবাই অ্যাট রিস্ক।
এমতাবস্থায়, পাশের বস্তিতে অসুখ ছড়াবে আর আপনার অভিজাত আবাসন নিরাপদ – সে সুখের দিন ভুলে যান, প্লীজ। আর মাথায় রাখুন, আপনার সুস্থ থাকাটা তাদের সচেতনতা ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে। ধর্ম বা সম্প্রদায় জেনে যাঁদেরকে মনে মনে ঘৃণা করেছেন, মনে রাখুন, আপনার সুস্থ থাকার জন্যে তাঁদেরও সুস্থ থাকা জরুরী।
লকডাউন বাড়ানো উচিত কি উচিত নয় – সাধারণের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হবে কি হবে না – সে তর্কের বিষয় এবং পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির অভাব নেই।
কিন্তু, এই বিধিনিষেধের মধ্যেও যাঁরা রাস্তায় বেরোচ্ছেন, তার অন্তত একটা অংশ (তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাকি বেশীর ভাগই বেরোচ্ছেন তেমন কোনো প্রয়োজন ছাড়া, সেও তর্কযোগ্য) বেরোচ্ছেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। না বেরোলে এঁদের অনেকেরই ঘরে উনুন জ্বলবে না।
পণ্যপরিবহন খাতায় কলমে চালু থাকলেও ইতিমধ্যেই খবর আসছে – চাষী ক্ষেত থেকে সব্জি তুলে বিক্রি করতে পারছেন না। ফুল ক্ষেতেই শুকোচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক সুরক্ষার দিকে বাড়তি নজর দিতে বললেও, আবারও বলি, এদেশে তেমন কিছু নজরে পড়ছে না। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট কমালেন কি বাড়ালেন – সে দিয়ে সমাজের তলার সারির মানুষের সুবিধে হওয়া মুশকিল।
বিধিনিষেধ দীর্ঘায়িত করা-ই যায় – হয়ত তার পক্ষে যুক্তিও প্রচুর – পুলিশ কি প্যারামিলিটারি এমনকি সশস্ত্র সেনা নামিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত সেই নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্যও করা যায়, সম্ভবত – কিন্তু, সামাজিক সুরক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দ বহুগুণ বাড়ানো আর সমাজের সবস্তরের মানুষকে পাশে নিয়ে চলার মানসিকতা – এ দুটি না হলে সব মানুষকে নিয়ম মানানো যাবে না, নিশ্চিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অনেক গরীব দেশের পক্ষে লকডাউন আর বেশীদিন চালু রাখা সম্ভবপর হবে না – সেসব দেশে আস্তে আস্তে বিধিনিষেধের ফাঁস আলগা হওয়া অবশ্যম্ভাবী। বিধিনিষেধ আলগা হওয়ার পরে সেসব দেশে সাবধানতা কতটুকু মেনে চলা যাচ্ছে, সংক্রমণের গতিপ্রকৃতিই বা কীরকম দাঁড়াচ্ছে – এসব দেখে বিশ্বের ভবিষ্যত কোভিড-উনিশ পরিস্থিতি ঠিক কীরকম হবে, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে।
আপনি চাইলে আমাদের ইন্ডিয়াকে পৃথিবীর ধনী বা উন্নত দেশের অন্যতম বলে ভাবতেই পারেন – তবু মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ইন্ডিয়ার উল্টোপিঠে যে ভারতবর্ষ, সে কিন্তু নিতান্ত গরীব – যাকে বলে, লো রিজার্ভ কান্ট্রি।
সেই দেশটির দীর্ঘমেয়াদী করোনা মোকাবিলা ঠিক কোন পথে হতে পারবে? ইন্ডিয়ার বাসিন্দাদেরও কিন্তু সে ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে, তাই না??
লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, তাছাড়া বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বেশ সহজেই বোঝা যায়।
একটা কথা আমার মাথায় আসছে না, কোভিড 19 কি অন্যান্য অসুখগুলোকে আপাত ভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে !
খবরে মাঝে মধ্যে দেখছি, সাধারণ অসুস্থতার জন্য মানুষকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়ে বেড়াতে হচ্ছে। আচমকা কেউ অসুস্থ হয়ে পরলে, সহজে চিকিৎসক পাচ্ছেন না, (আর বাড়িতে চিকিৎসক আসা, সে তো বহু দিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে)। লেখায় উল্লেখিত, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষই কেবল নন, শহরের মানুষকেও নিকটবর্তী হাসপাতালে যেতে হলে, সেটাও বেশ কষ্টকর। এর জন্য অনেকের মানসিক অজ্ঞতাও দায়ী। অনেক গাড়ি, অটোর চালক, হাসপাতালে যেতে হবে শুনলেই, যাত্রী প্রত্যাখান করছে।
টিভির সংবাদে দেখলাম, সরকার বলেছেন, হাসপাতালে যেতে গেলে পুলিশে ফোন করুন। আমার কাছে অবশ্য তেমন কোন ফোন নাম্বার নজরে এলো না।
সামগ্রিক ভাবে শিশুদের টিকাকরণ কর্মসূচীও কেন বন্ধ সেটা বোঝা গেল না, যেখানে তা জরুরিভিত্তিতে চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে হয়।
যে হেতু ভাইরাস আক্রান্ত মানুষকে সবসময় উপসর্গ দিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না, অন্তত চিকিৎসা পরিষেবায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে, তাঁদের সান্নিধ্যে আসা প্রতিটি মানুষকেই সাসপেক্টেড করোনা আক্রান্ত বলে ধরে নিয়ে সেই মতো আচরণ করতে হবে। সরকারকেও দেখতে হবে তাঁদের যেন যথোপযুক্ত সুরক্ষা পোশাক দেওয়া হয়, নতুবা একসময় দেখা যাবে সমস্ত হাসপাতালগুলো আংশিক খোলা থাকলেও চিকিৎসা করার কেউ নেই।
বিষাণ বসুকে ধন্যবাদ।
ডাক্তারবাবুর আগের লেখাগুলির মতো সহজবোধ্য এবং যুক্তিগ্রাহ্য লেখা। তাঁর বক্রব্যের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার সুযোগ খুব বেশি নেই। সাধারণ অবস্থায় ভারতের দরিদ্র বা দারিদ্র্য নিয়ে, ভারতের শাসন ব্যবস্থা এবং তার সমস্যা নিয়ে যে সব প্রশ্ন তোলা যেত এখন সে সব খুব অর্থবহ নয়।
যদি দীর্ঘ মেয়াদেই ভাবতে হয়, তবে এইসব দরিদ্রদের দারিদ্র্যের মূলগত কারণ যে ‘অশিক্ষা’ আর ‘শিক্ষা’র যে আমাদের সমাজে খুব একটা মূল্য নেই আর সে সব কথা চলেই আসে। ভারতে ভূমিহীন জনতা আর দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী জনতার হিসেব কেমন কে জানে?
আমি যে দরিদ্র শ্রেণিটির মধ্যে বসবাস করি, তাদের মধ্যে ভূমিহীন মানুষ নেই। হ্যাঁ শূন্য। কিন্তু বিপিএল কার্ড সম্ভবত ৯৫ শতাংশ বা আরো বেশি। জনপ্রতিনিধিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝায়, সরকার দিচ্ছে যখন, নেবেন না কেন? দুর্নীতিকে সার্বিক করে দিতে পারলে সেটি আর দুর্নীতি থাকে না। সরকারি নির্দেশ ক্রমে সবাই মিলে বেড়ালকে রুমাল বললে সেটা যে রুমাল হয়ে যায়, সংখ্যা গণতন্ত্র নিশ্চই আমাদের তাই শেখায়।
দারিদ্র্যকে আমরা ভাঙাতে ভালোবাসি। আমাদের শিক্ষা ধনীকে ঘৃণা করতে শেখায়, দরিদ্রকে করুণা করতে। আমি আমার চারপাশের তথাকথিত সুবিধাভোগী মানুষজনকেও সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য যে হ্যাংলামো, স্তাবকতা, পেশি প্রদর্শন করতে দেখা যায়, সেটির উৎস কী, দীর্ঘ মেয়াদে ভেবে দেখা হোক।
পূর্ব মেদিনীপুরে এলাকায় কী পরিমাণ কৃষিজমি দিন দিন ভেড়ি হয়ে যাচ্ছে, বা পতিত হয়ে যাচ্ছে, আর সে সব জমির মালিকরা কী ভাবে ভিনরাজ্যে মজুর হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, আর তার কারণ কী, সে সব নিয়ে নানান বয়ান গবেষকের পূর্ব নির্ধারিত ছকে একদিন সন্দর্ভ হয়ে দেখা দেবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু অশিক্ষা আলস্য দুর্নীতি আর দরিদ্র নির্মান আর দারিদ্র্য কেনাবেচার ছকবাজি তাতে কিছু বদলাবে, ওইসব তথাকথিত ‘দরিদ্র’ মানুষদের জীবন যাতে কিছু পরিবর্তিত হবে কি না, কে জানে? করোনা জীবন বদলে দেবে? সে’ও ওই নতুনতর কোনো নির্মিত বয়ান হবে হয়তো!