ডাক্তারিকে আমি বরাবর নিজের পেশা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। নামের আগে কখনও ডাঃ ব্যবহার করি না। আমার মনে হয় না এটা আমাকে আলাদা করে কোন ঔজ্বল্য দেয় বলে। আমার শিক্ষার জন্য আমি মানুষের শরীরের মেরামত করতে পারি, এইটুকুই। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে ডাক্তার হওয়াটা যেন আমার নিজের কাছেই মারাত্মক ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। আগে কখনও আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমার পেশার উপস্থিতি এই ভাবে টের পাইনি।
ইংল্যান্ডের বাকি সবকটা হাসপাতালের মতো আমার হাসপাতালও কোভিড-১৯ এর সাথে যুঝছে। অদৃশ্য এই শত্রুর সাথে লড়াইটা অসম। তাও আমরা সবাই লড়ছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। হাসপাতালে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইলেকটিভ অপারেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমার কাজ শুধু এমার্জেন্সিতে আসা রুগীদের দেখা। হাসপাতালের ৪০ বেডের এমার্জেন্সির মাত্র ৬ টি ছাড়া বাকি সবকটিই কোভিড রুগীদের জন্য।
গত সপ্তাহের কথা। রাতে অন কল ছিল। হ্যান্ড ওভারে জানলাম আমাকে একটি রুগীকে দেখতে হবে। তিনি কোভিডে আক্রান্ত।
এখন সবাই PPE-র কথা খুব শুনছেন চারদিকে। Personal Protective Equipment. যাতে চিকিৎসাপ্রদানকারীর নিজের শরীরে এই ভাইরাস না ঢুকে যায় তাই এই ব্যবস্থা নেওয়া। বাকি সব দেশের মতো এখানেও PPE র বন্দোবস্ত যথেষ্ট নয়। কোন PPE যোগ্যতম তাও এখনও আমরা ঠিক করে উঠতে পারিনি। তবু যা আছে তাই নিয়েই তো এগোতে হবে।
এমার্জেন্সির বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তার আগে জুনিয়রকে কল করে বললাম এখন আমি কোভিড এরিয়াতে যাচ্ছি, সামনের কয়েক ঘন্টা ফোনে পাওয়া যাবে না। দুজন নার্স আমাকে সাহায্য করছিলেন PPE পরার জন্য। প্রথমে গ্লাভস, তারপরে ক্যাপ, চোখের কভার, মাস্ক, পলিইথিলিনের ফুল স্লিভ গাউন, আবার গ্লাভস, পায়ের জুতোর কভার। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম কোন ব্যক্তিগত চিন্তা নিয়ে। আমার মুখ দেখে একজন নার্স বললেন,
-পুট অন আ স্মাইল ডক্টর।
আমি বললাম,
-ইয়েস, ইউ আর রাইট, উই মাস্ট স্মাইল নাও।
-কারেক্ট, উই মাস্ট স্মাইল টুডে। হু নোজ, টুমোরো কুড বি ওর্স।
টুমোরো কুড বি ওর্স।
আগামীর দিন আরো খারাপ হতে পারে।
তাই তো। আগামীর দিন আরো খারাপ হবে ধরে নিয়েই আমরা কাজ করছি। হাসপাতালের সবার মুখে চাপা ভয় কিন্তু ঠোঁটে টেনে রাখা হাসি। সবাই বলছে আর কয়েকটা সপ্তাহ,তাহলেই জিতে যাব।
ধড়াচুড়ো পরে ঢুকলাম কোভিড ওয়ার্ডে। ছটা বেডের একটা ঘর। এসি বন্ধ করা, যাতে করে বাতাস বাইরে না যায়। এখানে তিনজন ডাক্তার আর তিনজন নার্স, সবাই PPE পরা৷ এই অবস্থায় ৩ ঘন্টার বেশি একটানা থাকা যায় না। তাই শিফটে কাজ হয়। আমার রুগী স্তেফান ডোরির বয়স ৮০, স্ত্রী এর সাথে তিনি এসেছেন পেটের ব্যথা নিয়ে, সাথে ছিল জ্বর আর শ্বাসকষ্ট।
আমি যখন মিস্টার ডোরিকে দেখলাম তখনও তিনি ব্যথায় কাতড়াচ্ছেন, পাশে ওর হাত ধরে স্ত্রী বসে আছেন। ওর পেট ফুলে আছে অনেকটাই। সিটি স্ক্যান হয়েছে। দেখি ওতে কী আছে।
পেটের মধ্যে একটা টিউমারের জন্য নাড়ি জড়িয়ে গেছে। আমরা একে বলি ইন্টেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন। টিউমার শরীরের আর অন্য কোথাও ছড়ায়নি। সুতরাং ওঁকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করলেই বাঁচিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
কারণটা ওর ফুসফুসে।
কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি বয়স্ক হলে আর শরীর আগে থেকেই দূর্বল হলে মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ হয়। মিস্টার ডোরির বুকের সিটিস্ক্যানে দেখা গেল ওর দুটো ফুসফুস ই সাদা হয়ে গেছে। ভাইরাস খেয়ে নিয়েছে তার বেশির ভাগ অংশ।
এই অবস্থায় আমরা যদি মিস্টার ডোরির অপারেশন করি তাহলে পেটে নাড়ির জট ছাড়াতে পারলেও ওকে অজ্ঞান অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। ভেন্টিলেটরেই রেখে দিতে হবে। সেই ভেন্টিলেটরও ওকে বাঁচাতে পারবে না, এতটাই দূর্বল ওর শরীর এখন। অন্যদিকে অপারেশন চলাকালীন প্রায় ১০ জন ডাক্তার, নার্স, থিয়েটার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওর সংস্পর্শে আসবে। এদের প্রত্যেকের কোভিডে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তখন।
অতএব?
ফিরে গেলাম মিস্টার ডোরির কাছে। ওকে তখন ব্যথার জন্য মরফিন দেওয়া হয়েছে। তার প্রভাবে আচ্ছন্ন। ওঁর স্ত্রী আমাকে বললেন,
-সিটি স্ক্যান কেমন দেখলেন ডক্টর?
-বলছি, তার আগে মিস্টার ডোরির কী ইচ্ছা বলুন।
-আমি চাই স্তেফানের অপারেশন হোক। একটা সুযোগ তো নেওয়াই যায়, তাই না?
-আমি সরি মিসেস ডোরি, সেটা আর সম্ভব নয়।
হতভম্ব মহিলাকে তারপরের দশ মিনিট ধরে বোঝালাম মিস্টার ডোরির ফুসফুসের অবস্থা। বললাম অপারেশন করাটা কেন অসম্ভব।
-তাহলে?
-আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু গিভ ইউ এনি ফলস হোপ। মিস্টার ডোরিকে আমরা বাঁচাতে পারব না। ওকে যতটা সম্ভব কম্ফর্টেবল রাখার চেষ্টা আমরা করব।
ওঁর স্ত্রীর চোখের দিকে এর পরে আমি আর তাকাইনি। ডেস্কে ফিরে এসে মিস্টার ডোরির অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা লিখতে লাগলাম। সেই সময় অর্থোপেডিকের রেজিস্টার নার্সের কাছে বকুনি খাচ্ছে। একটা ভুল করে ফেলেছে সে।
৭০ বছরের বৃদ্ধ কোমর ভেঙে এমার্জেন্সিতে এসেছিলেন। তারও কোভিড, তারও ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। অক্সিজেন মাস্ক পরে বৃদ্ধ খাবি খাচ্ছেন, তিনিও মারা যাবেন আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে। অর্থপেডিক রেজিস্টার এই খবরটা ফোনে জানায় বৃদ্ধের ছেলেকে। সন্তান তার মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে শেষ বারের মতো দেখতে চায়। এই চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক, রোজই এমন রিক্যুয়েস্ট পাই আমরা। তাই স্বভাববশত রেজিস্টারও তাকে বলে হ্যাঁ চলে আসুন হাসপাতালে এখন।
সে ফোন রাখার সাথে সাথেই নার্স বলে আপনি ভুলে গেলেন এ কোভিডের পেশেন্ট? আমরা কী ভাবে বাইরের একজনকে এর সামনে এক্সপোজ করব? সেটা তো সম্ভব নয়!
আমি যখন কোভিড ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসছি তখন নার্স আবার সেই বৃদ্ধের ছেলের সাথে ফোনে কথা বলছে,
-উই আর সরি, আপনাকে আমরা হাসপাতালে আসতে দিতে পারব না। ইটস আ রিস্ক টু ইওর হেলথ…
মৃত্যুই তো এই জীবনের নিয়তি। মৃত্যুই পরম সত্যি। সেই দিকেই এগিয়ে চলেছি আমরা নিজেদের অজান্তেই। কিন্তু সেই মৃত্যুতে ন্যূনতম সম্মান তো মানুষ আশা করেই। আশা করে তার চিকিৎসার অন্তত শেষ চেষ্টা হবে, তার শেষ শ্বাস নেওয়ার মুহূর্তগুলোয় তাকে ছুঁয়ে থাকবে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, স্বামী।
এর কোনটাই এখন হচ্ছে না আর। বিছানায় শুয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষ মারা যাচ্ছে একা। তারপরে ঠান্ডা শরীর নীল ব্যাগে করে চলে যাচ্ছে হাসপাতালের মর্গে। রাস্তার কুকুর বিড়াল মারা গেলেও তার শোকে স্বজনেরা গলা মেলায়, কেঁদে ওঠে। এখানে কাঁদারও কেউ নেই।
এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু তো কেউ কখনও চায়নি, কেউ ভাবেওনি। কিন্তু এমন মৃত্যুই এখন প্রাত্যহিক, স্বাভাবিক।
এই ভাবেই এখন গোটা পৃথিবীতে ৭০,০০০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছে কিছু মানুষ, তাদেরও কিছু এই লড়াইটা লড়তে লড়তে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। কিছু মানুষ রাজনীতি করছে এটা নিয়ে। আরো কিছু ফানুস ওড়াচ্ছে, বাজার করছে জমিয়ে, বাড়িতে সারাদিন থাকা, চোব্যচোষ্য খেতে হবে তো নাকি?
পৃথিবীর গভীরতম অসুখ এখন।
সত্যি কথা, একদল মানুষের কাছে লকডাউন হলো উদযাপন,, চিকেন, মাটন খেয়ে,, কেক বানিয়ে তার ছবি দিয়ে, রোজ বাজার করার সাতকাহন শুনিয়ে, ফুর্তি করতে একটুও এদের বিবেকে বাঁধছে না,,
বুঝতে পারছি আপনাদের অবস্থা।ভীষন অসহায় লাগে।।এখনো ও মানুষ দাবি তুলছে না স্বাস্হ খাতে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।স্বাস্হ -শিক্ষা র মতো পরিষেবাগুলো কখনোই বেসরকারীকরন করা চলবে না। কিউবার মতো ছোট্ট দেশ এতো বাহ্যিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে যদি উদাহরণযোগ্য হতে পারে,আমরা কেন পারবো না?