খুব প্রাচীনকাল থেকেই হিস্টেরিয়া (Hysteria) এক অদ্ভুত, রহস্যময় জটিল রোগ হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে বর্ণিত হয়ে আসছে! প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সবেতেই এর কিছু না কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। মিশর, পারস্য, গ্রিস হয়ে চিন সমস্ত জায়াগার প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে এর উল্লেখ আছে!
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শাস্ত্রে মহিলাদের হিস্টেরিয়া (Female Hysteria ) রোগের ডায়াগনোসিস বাড়তে থাকে। বিশেষত ভিক্টোরিয়ান সময় পর্ব জুড়ে মেয়েদের একটু আলাদা ধরণের, অনেকগুলো শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথা বললেই তাদের হিস্টেরিয়া বলে দাগিয়ে দেওয়ার এক প্রবণতা শুরু হয়! মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, বুকে চাপ লাগা, শ্বাস নিতে না পারা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, খিদে কমে যাওয়া, অত্যাধিক দুশ্চিন্তা, মুড সুইং, এই সমস্ত সমস্যাগুলো হলেই মহিলাদের স্বামীরা তাঁদেরকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।এবং বেশিরভাগ সময়েই তাঁদের চিকিৎসা শুরু হত হিস্টেরিয়া রোগী বলে চিহ্নিত করে! এবং এনাদের চিকিৎসাও সেই সময়কার ভিক্টোরিয়ান যুগের ডাক্তাররা করতেন বিভিন্ন অদ্ভুত রকম পদ্ধতিতে। যেমন ‘পেলভিক কিম্বা ইউটেরিয়ান (Uterus) জরায়ু ম্যাসেজ’, বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া, গরম জলে স্নান, বিভিন্ন যৌন সংগমের অবস্থান। তখন মনে করা হত এই ‘হিস্টেরিয়া’ মূলত মেয়েদের ইউটেরাস (uterus) বা জরায়ুর জন্যেই হয়। সেই জন্যেই অনেকে ‘হিস্টেরিকাল সাফোকেশান’ (Hysterical suffocation) বলত। হিস্টেরিয়া (Hysteria) শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘Wandering Uterus’- ভ্রাম্যমান জরায়ু। অতৃপ্ত যৌনতায় জরায়ু শরীরের উপরে বা নীচে নেমে ঘুরে বেরাচ্ছে । তাই একে তৃপ্ত করে সঠিক জায়গায় আবার নিয়ে আনতে হবে, অতি দ্রুত।তাই জরায়ু উপরে উঠে গেলে নাক বা মুখের জায়গায় টক ও তিক্ত গন্ধের কিছু জিনিস রাখা এবং ভ্যাজাইনা বা দুই উরুর সংযোগস্থলের জায়গায় কিছু মিষ্টি জাতীয় জিনিস রাখা। হ্যাঁ একবিংশ শতকের পাঠক আপনারা ঠিকই পড়েছেন। জরায়ু শরীরের উপরে উঠে গেছে, তাই উপরের দিকে খারাপ আর নিচে ভাল জিনিস রেখে জরায়ুকে নামিয়ে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টাই ছিল এক চিকিৎসা পদ্ধতি। অনেকেই বলতেন হিস্টেরিয়া রোগীদের মূল সমস্যা শরীরে নোংরা তরল (Bad Fluid) পদার্থের ভারসাম্যহীনতা, যেমন মাসিকের রক্ত জমা হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখা হত, এবং পুরুষের শরীরের সিমেন (Semen) বা বীর্য পদার্থকে উপকারী হিসেবে ভাবা হত। তাই ঘন ঘন শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া, কুমারী মেয়ের বিয়ে করে নেওয়া, এইরকম পরামর্শও দেওয়া হত।
এখানে বলে রাখা ভালো যে আজকের দিনে হিস্টেরিয়া বলে কোনও মানসিক রোগ ডায়াগনোসিস বা নির্ধারণের ক্ষেত্রে করা হয় না!
হিস্টেরিয়ার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা অনেক বড় এক আলোচনা। তার অবকাশ আজ নেই। খুব সংক্ষেপে বলা যায় বিশ্ববিখ্যাত নিউরোলজিস্ট শার্কো (Jean-Martin Charcot) প্রথম একে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে শুরু করেন, ১৮৮০ সালের পর থেকে। তারপর সিগময়েন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) একে অবচেতন মনের (Unconscious Mind) এক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্যাখা করার চেষ্টা করেন। মনে রাখতে ইতিহাসের এই বিশাল সময় পর্ব জুড়ে হিস্টেরিয়াকে সব সময় দেখা হয়েছে মেয়েদের নিজস্ব সমস্যা হিসেবে। অনেক বেশি মেয়েদের রোগ বলে ট্যাবু করা হয়েছে। প্যাট্রিয়ারকি বা পিতৃতান্ত্রিকতা অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে চিকিৎসা শাস্ত্রে। বিংশ শতকের শুরু থেকে আস্তে আস্তে হিস্টেরিয়া রোগ যে মেয়েদের জরায়ু থেকে হয় না তার ধারণা পোক্ত হতে থাকে! ১৯৫০ সালের পর থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি, আরও বেশিকরে মানবধিকারের উপর জোর দেওয়া,নারীবাদী আন্দোলন (Second wave Feminism) সমস্ত মিলিয়েই হিস্টেরিয়া রোগের বৈধতা এমনকি এই শব্দটির মান্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে থাকে। ১৯৮০ সালের পর DSM III (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders ) প্রকাশিত হওয়ার পর হিস্টেরিয়া বলে কোনও রোগ আর রইল না।
হ্যাঁ তো যা বলছিলাম! সেই অদ্ভুত সময়ে সুইডিশ আর্মি মেজর থুর ব্রান্দে (Thure Brandte ১৮১৩-১৮৯৫) শুরু খুলে ফেললেন প্রচুর ক্লিনিক এই জরায়ু মেসাজ পদ্ধতিতে হিস্টেরিয়া রোগীদের সারানোর জন্যে! যিনি ছিলেন আসলে একজন গাইনোকলিজিকাল থেরাপিস্ট। তিনি ৫ জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, ১০ জন মহিলা থেরাপিস্ট নিযুক্ত করলেন। সবচেয়ে প্রচলিত যে পদ্ধতি ছিল তা হল বাইম্যানুয়াল(Bimanual) অর্থাৎ এক হাতে তল পেটের উপরে আর এক হাত ভ্যাজাইনা কিম্বা অ্যানাস (গুহ্যদ্বার) যে যেটায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন, রেখে ম্যাসাজ শুরু করা হত যতক্ষণ না অবধি কাঁপুনির মতো এক ঝটকা অনুভূতির সর্বোচ্চ মাত্রায় সমস্ত শরীর বেয়ে চলে যায়- তখন একে বলা হত প্যারক্সিসিমাল কনভালশান (paroxysmal convulsion), আজকের দিনে আমরা যাকে এখন অরগ্যাসাম (Orgasm) বলে থাকি! এই পদ্ধতি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে এক দিনে প্রায় ১১৯ জন মহিলাকে এই ম্যাসেজ করতে হত। প্রতিটি সেশান এতটাই পরিশ্রমসাধ্য ও সময়ব্যাপী ছিল দিনের শেষে ডাক্তার এবং তাঁর সহকর্মীদের হাত ও আঙ্গুলের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠত! তাই ওই সময় তাঁরা এই মুশকিল থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে এক যন্ত্র আবিষ্কার করলেন, যা কাঙ্খিত জায়গায় একটা ছন্দময় কম্পনের সৃষ্টি তৈরি করতে পারে ম্যাসাজ দিতে পারে, এটা অনেক সহজে এবং তাড়াতাড়ি এই paroxysmal convulsion বা অরগ্যাসাম ঘটায়-এভাবেই আধুনিক ভাইব্রেটর(Vibrator ) এর উৎপত্তি!
যদিও জোসেফ মরটিমার গ্র্যানভিলে (Joseph Mortimer Granville) বৈদ্যুতিক এক ভাইব্রেটরের আবিষ্কার করেছিলেন আগেই! অনেকে আবার বলেন তারও আগে নাকি রাণী ক্লিওপেট্রা(Cleopetra) প্রথম ভাইব্রেটর ব্যবহার করেছিলেন!
যাই হোক সেই সময় বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রেই অন্যরকম চিকিৎসা হিসেবে একে ব্যবহার করা হত! সেই সময় এটি হয়ে উঠেছিল চিকিৎসার এক বিকল্প পদ্ধতি, অনেক ধনী এবং মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের মহিলারা একে নিজেদের ঘরে রাখতেন, এবং যখনই হিস্টেরিয়ার লক্ষণ একটু কম বেশি আসতে শুরু করত তাঁরা এই যন্ত্র ব্যবহার করতেন। ১৯১০ সালের পর উটেরাস বা জরায়ু ম্যাসাজ পদ্ধতিরও ব্যবহার কমতে থাকে! কারণ হিস্টেরিয়া যে আসলে জরায়ুর জন্যে হয় না সবাই মানতে শুরু করে!পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্ণোগ্রাফি এবং যৌন উদ্দীপনামূলক ইন্ডাস্ট্রিতে ভাইব্রেটরের ব্যবহার ধীরে ধীরে বেড়ে যাবার ফলে একে ‘পাপ’ জাতীয় এবং অন্যায় এক কাজ হিসেবে দেখতে শুরু করা হয়!ফলত এর ব্যবহার কমতে শুরু করে!
কিন্তু ১৯৬০ সালের পর আবার এর প্রচলন বাড়তে থাকে, বিশেষ করে আমেরিকাতে। আজকের দিনে প্রায় ৫২% আমেরিকান মহিলা একে একবার হলেও ব্যবহার করেছেন, ছেলেদের মধ্যেও এর ব্যবহার ক্রমবর্ধমান!
যদিও এই ভাইব্রেটরের আবিষ্কার ও হিস্টেরিয়া রোগীর চিকিৎসায় এর ব্যবহার নিয়ে কিছু ঐতিহাসিক দ্বিমত রয়েছে। তবুও বেশিরভাগ তৎকালীন সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, পত্র-পত্রিকা মারফত এই ভাইব্রেটরের বহুমুখী ব্যবহার ছিল একথা পরিষ্কার! সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে হিস্টেরিয়া (Hysteria 2011) এক সিনেমাতে এর ব্যবহার দেখানো হয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে! ইতিহাসের কোন সময়ে কত যে আশ্চর্য ঘটনা লুকিয়ে আছে এবং আজকের দিনে তার অবস্থান যে কতটা পরিবর্তিত তা সত্যিই অবাক করার মতো!