১০০ কোটি সংখ্যাটা দেখলে – সে টাকা বা টিকা যাই হোক না কেন – আমরা একটু ঘাবড়ে যাই। ২০২১-এর ১৬ জানুয়ারি থেকে টিকাকরণ শুরু হয়েছিল। ২৭৮ দিনের মধ্যে এই মাইলফলকে পৌঁছনো (উপলক্ষ্য মোদীজির জন্মদিন) ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনতা পার্টির যৌগপদ্যে সম্ভব হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন সকালবেলা। ২১ তারিখ সন্ধের পরে দেশের উল্লেখযোগ্য ১০০টি স্মৃতি সৌধ (লালকেল্লা, কুতুব মিনার, খাজুরাহো ইত্যাদি জায়গা) আলোয় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সাফল্য উদযাপন করতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবিয়া ফিল্ম শো এবং গানের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পিয়ার “বেন্টিঙ্ক অ্যান্ড এডুকেশন” প্রবন্ধে বলেছিলেন – “পশ্চিম সবসময়েই কোন বৃহৎ চিহ্নকে ভালবাসে, যেমন বিরাট বিল্ডিং “দ্য স্মিথ কলেজ” বা “দ্য জোন্স হাই স্কুল” ইত্যাদি। যদি এগুলো কোন স্থানে খুঁজে না পায় তাহলে সেখানে শিক্ষাদীক্ষা আছে বলে মনে করেনা।” এরই এক প্রতিরূপ আমরা পেলাম যখন ১০০ কোটিতম টিকাটি দেওয়া হল। অর্থাৎ প্রায় ১৪০ কোটি ভারতবাসীর মর্মস্থলে পৌঁছে দিতে হবে যে ১০০ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে – এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য যাই থাকনা কেন।
এই অতিবৃহৎ কর্মযজ্ঞ আশাপ্রদ ফলাফল দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। ২১ অক্টোবর, ২০২১-এ বিবিসি নিউজের খবর “কোভিড ভ্যাক্সিনঃ ইন্ডিয়া অ্যাডমিনিস্টারস মোর দ্যান ওয়ান বিলিয়ন কোভিড জ্যাবস”। একইদিনে সিএনবিসি নিউজের খবরের শিরোনাম “ইন্ডিয়া অ্যাডমিনিস্টারস মোর দ্যান ওয়ান বিলিয়ন কোভিড কোভিড ভ্যাক্সিন ডোজেজ”। নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম “ইন্ডিয়া গিভস ২৫ মিলিয়ন কোভিড ভ্যাক্সিন শটস অন মোদি’জ বার্থডে” (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১)। ২১ তারিখের এই সংবাদপত্রের খবর হল “ইন্ডিয়া’জ কোভিড ভ্যাক্সিন ক্যাম্পেইন হিটস ১ বিলিয়ন ডোজেজ”।
এবার ১০০ কোটির হিসেবটিকে একটু ভেঙ্গে দেখা যাক। ভারতে প্রথম পর্যায়ে টিকা দেওয়া হয়েছিল ৪৫ থেকে ষাটোর্ধ অংশের মানুষকে। পরের পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের। এখানে স্মরণে রাখতে হবে, ভারতে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের সংখ্যা প্রায় ৫৯.৫ কোটি। ফলে জনসংখ্যার এই অংশকে বেছে নিয়ে যদি সরকার এবং পার্টির যৌথ উদ্যোগে গণটিকাকরণ প্রক্রিয়া জোরকদমে শুরু হয় তাহলে ১০০ কোটির মাত্রা ছুঁয়ে ফেলা খুব শক্ত কাজ নয়। আগস্ট থেকে এই কাজটি সুচারুভাবে করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে এই অংশের জনসংখ্যার মধ্যে “ভ্যাক্সিন দ্বিধাগ্রস্ততা”ও কম। কিন্তু এখনো শিশু থেকে ১৮ বছর বয়সী বয়ঃসীমার মধ্যে থাকা জনসংখ্যার টিকাকরণ শুরুই করা যায়নি। অনুমিত তৃতীয় ঢেউয়ে এদের সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। সম্ভাবনা বেশি রোগ ছড়িয়ে পড়ারও। ফলে ১০০ কোটি ডোজের সংখ্যার চাইতে জরুরী কতসংখ্যক মানুষ বাস্তবে টিকাকরণের আওতায় এল। বিবিসির পূর্বোক্ত নিউজে এ কথা বলা হয়েছিল যে ৪৫-ঊর্ধ প্রায় ৭ কোটি “ভালনারেবল” মানুষ এখনো টিকার একটি ডোজও পায়নি। এবার ১০০ কোটির কুহকের মধ্যে আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ২৩ অক্টোবর, ২০২১-এর হিসেব অনুযায়ী মোট ১,০১,৩০,২৮,৪১১ জনের টিকাকরণ হয়েছে। “আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা”-র ২১.১০.২১-এর তথ্য অনুযায়ী যত সংখ্যক মানুষের দুটি ডোজের পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে সে সংখ্যা ৩০ কোটির কাছাকাছি, শতকরা হিসেবে ২১.৩%। কোন কোন হিসেবে এ সংখ্যা ৩০%। “হার্ড ইমিউনিটির” জন্য ৭০-৮৫% মানুষের টিকাকরণ প্রয়োজন। যদি ৭০%-এর হিসেবও ধরি তাহলেও আরও ৫০%-এর বেশি মানুষের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করতে হবে। অন্তত একটি ডোজ পেয়েছে এ সংখ্যা শতকরা হিসেবে ৫২%। আংশিক টিকাকরণের সমস্যা হচ্ছে এতে স্বল্প পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। যত বেশি সংক্রমণ হবে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস তত বেশি মিউটেশন ঘটানোর সুযোগ পাবে। এজন্য বেশিরভাগ (অন্তত ৭০%) টিকাকরণ এত জরুরী। চিনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে মোট ১০৫ কোটি মানুষের। মোট টিকার ডোজ দেওয়া হয়ছে ২২৩ কোটি। (সূত্রঃ আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা, ২১.১০.২০২১)
একই সূত্র অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে এখন অব্দি মোট টিকাকরণ হয়েছে ৩৭% মানুষের, আংশিক টিকাকরণ হয়েছে ১২% মানুষের। একজনও টিকা পায়নি এ সংখ্যা ৪৮%। এ মানুষদের অধিকাংশই আফ্রিকার দেশগুলোতে বাস করে। এরা “উন্নত” পৃথিবীর কাছে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার জন্য দরজা খুলে রাখতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কি এবোলা, কি কোভিড সব ক্ষেত্রে এরাই বেশিরভাগ বলি হবে।
মোদী সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের টিকাকরণ। হাতে সময় ৭০ দিনের কম। এই হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১.৫১ কোটি করে টিকা দিতে হবে। ১৬ থেকে ২১ অক্টোবর দৈনিক গড়ে ৩৯ লক্ষ করে টিকাকরণ হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে আমরা একবার ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে ফিরে তাকাতে পারি। সেসময় একদিনে ভারতের স্বাস্থ্যকর্মীরা ১২৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ১২ কোটি ৭০ লক্ষ শিশুর পোলিওর টিকা দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে একদিনে ১৩৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৩ কোটি ৪০ লক্ষ শিশুর টিকাকরণ করা হয়েছিল। (সূত্রঃ হিস্টরি অফ ভ্যাক্সিনস, কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস অফ ফিলাডেলফিয়া)
তিন ধরনের ভ্যাক্সিন এখনও অবধি ভারতে দেওয়া হচ্ছে – অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড (উৎপাদক সিরাম ইন্সটিটিউট), কোভ্যাক্সিন (ভারত বায়োটেক) এবং রাশিয়ার ভ্যাক্সিন স্পুটনিক ভি। নেচার জার্নালে ২৪ জুন, ২০০১-এ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় “হোয়াই ইন্ডিয়া’জ ভ্যাক্সিনেশন ড্রাইভ মুভস ইন ফিটস অ্যান্ড স্টার্টস” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা, ট্রায়াল, দাম, নির্দিষ্ট ডোজের স্ট্র্যাটেজি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে এসব সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হবে। তাহলে রাষ্ট্রের ওপরে মানুষের ট্রাস্ট (আস্থা) বাড়ে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ (জুলাই ১০, ২০২১) প্রকাশিত “অ্যাভার্টিং ফিউচার ভ্যাক্সিন ইনজাস্টিস” প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে নির্ণায়ক নিয়মকানুনগুলো হল দ্রুত প্যাথোজেন স্যাম্পেল এবং এতদসংক্রান্ত তথ্যকে শেয়ার করা।” ল্যান্সেট-এ “ইন্ডিয়া’জ কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনেশন ড্রাইভঃ কি চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড রেজলিউশনস” প্রবন্ধ জানাচ্ছে – সিরাম ইন্সটিটিউট এবং ভারত বায়োটেক সর্বাধিক দৈনিক ১০ কোটি এবং ৮ কোটি টিকা উৎপাদন করতে পারে।” এ বছরের মধ্যে সার্বজনীন টিকাকরণ কি সম্ভব?
টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় (২৩.১০.২১) মোদীজির একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলছেন – “ভ্যাক্সিনেশন ড্রাইভের ক্ষেত্রে ভারত সমগ্র পৃথিবীর কাছে দেখিয়েছে ‘গণতন্ত্র বিতরণ’ করতে পারে’।” গণতন্ত্রের আরেকটি পরীক্ষা হল ভ্যাক্সিন ‘পাবলিক গুড’ হবে এবং ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ বলা “ভারতের অ-স্বীকৃত এবং মজুরিহীন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীবাহিনী”র (২২.১০.২১) সুরক্ষা এবং স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে।
খুব সম্ভববর্তমানে বাইশ দশমিক তিন শতাংশমানুষ দুই খান মাত্রা সম্পূর্ণ করেছে।
গোয়েবলিংজ্যেঠু নজ্জায় আঙ্গা হয়ে’ মুখ নুকিয়েছেন।
মোদীর নেতৃত্বে আর কত ভাঁওতাবাজি আমাদের শুনতে হবে জানিনা….. প্রচারে গল্পের গরু গাছে উঠছে…..
মোদির মেগানোম্যালিয়া। যে কোন ইস্যুতে আত্মপ্রচারে তার জুড়ি মেলা ভার।
তথ্যপূর্ণ ভালো প্রবন্ধ – লেখক কে অনেক ধন্য়বাদ
এত দিনে মাত্র ৩০কোটি মানুষ দুটো ডোজই পেয়েছে অথচ মোদিজীর এমন আত্মপ্রচার, . নিজেদের জাহির করতেই সচেষ্ট।
নেট এ একটা সুন্দর রূপক পেলাম, একটা মোষ চুরি করতে তিন জন লাগে। প্রথম জন মোষের গলা থেকে ঘন্টা খোলে, দ্বিতীয় জন মোষের ঘন্টা বাজাতে বাজাতে গ্রামের উত্তর দিকে যায়, তৃতীয় ব্যক্তি মোষ টাকে গ্রামের দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় চোর গ্রামের লোকের সাথে মিশে ঘন্টা খুঁজতে উত্তর দিকে গিয়ে ঘন্টা উদ্দ্বার করে আর ঘন্টা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এই মোষ চুরি চলছে আমাদের দেশে। তবে লেখক কে কুর্নিশ।
নেট এ একটা সুন্দর রূপক পেলাম, একটা মোষ চুরি করতে তিন জন লাগে। প্রথম জন মোষের গলা থেকে ঘন্টা খোলে, দ্বিতীয় জন মোষের ঘন্টা বাজাতে বাজাতে গ্রামের উত্তর দিকে যায়, তৃতীয় ব্যক্তি মোষ টাকে গ্রামের দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায়। প্রথম চোর গ্রামের লোকের সাথে মিশে ঘন্টা খুঁজতে উত্তর দিকে গিয়ে ঘন্টা উদ্দ্বার করে আর ঘন্টা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এই মোষ চুরি চলছে আমাদের দেশে। তবে লেখক কে কুর্নিশ।
স্যার আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ❤️?
সত্যিগুলোকে এভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য আপনাকে কুর্ণিশ । কেন্দ্র তো এমন প্রচার করছিল যে মনে হয়েছিল দেশে টীকাকরণ এই সম্পূর্ণ হয়ে এল বলে।
তথ্য আমার, বিশ্লেষণ আমার, উপসংহার আমার।
কোন প্রশ্ন নয়।