রোগীর নাম কমলা সাহা। বাড়ি বেহালায়। ছেলেরা আজ বেঁচে নেই। কিছুদিন আগে শেষজনও চলে গেছেন আশি বছর পার করে। কাছের মানুষ বলতে দুই নাতি সুবীর (৫১ বছর), এবং গৌতম (৪৭ বছর)।
নার্সিংহোমের ফাইলে কমলাদেবীর বয়স ১০২ বৎসর লেখা দেখে আমি আদৌ বিস্মিত হইনি। একশো বছরের অধিক বয়সী রোগীর অস্ত্রোপচার সচরাচর না হলেও এই রাজ্যে নজিরবিহীন নয়। অনেক সার্জন এবং অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট তাদের কর্মজীবনে এরকম রোগী পেয়েছেন এবং সফলভাবে অস্ত্রোপচার করেছেন।
আমি আগেও এরকম দু’জন রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছি যারা সফলভাবে সার্জারির পর হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন।
প্রথমজন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে, এমডি ফাইনাল ইয়ারে। তখন ছাত্র ছিলাম আর মাথার ওপর অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ ভট্টাচার্য্যের ছাতাটা ছিল। ফলে বিশাল সাইজের হার্নিয়া কাটাতে আসা থুড়থুড়ে দাদুর পিঠে সুঁই ফোটাতে ঘেমে নেয়ে একসা হলেও বুক দুরুদুরু ব্যাপারটা একেবারেই অনুভব করিনি। দুই নম্বর দাদু এসেছিলেন প্রস্টেট কাটাতে। প্রাইভেট সেট আপে একক প্রচেষ্টায় সেটাই ছিল আমার প্রথম কোনো শতবর্ষাধিক রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া।
বর্তমানে টানা কয়েকবছর এইরকম রোগী পাই নি। তার অবশ্য কিছু কারণও আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হ’ল, চিকিৎসকদের মনোভাবের পরিবর্তন। বর্তমানে অধিকাংশ ডাক্তারবাবুই এতো বয়ষ্ক রোগীর দায়িত্ব নিতে চান না। এই পরিবর্তন কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। গত সাড়ে তিন বছরে ছয় শতাধিক চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন শুধুমাত্র চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগে। গতবছর আসামের চা বাগানের একজন ডাক্তারবাবুকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে ভুল চিকিৎসার অভিযোগে। এরমধ্যে ৯৯ শতাংশ অভিযোগই ভিত্তিহীন অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ডাক্তারবাবুরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন চিকিৎসা করতে গিয়ে যদি পান থেকে একটুও চুন খসে তো কপালে অশেষ ভোগান্তি রয়েছে। আর রোগী মারা গেলে তো কথাই নেই! তাই ঝাড়ের বাঁশকে আশ করে কেউই আর নিতে চান না।
দ্বিতীয় কারণটি হ’ল, বাড়ির লোকের গা-ছাড়া মনোভাব। বহু পরিবারের কাছেই বৃদ্ধ মানুষজন হলেন সংসারের বোঝা। আশি বছর পেরিয়ে যাওয়া মানে অনেকেই ধরে নেয় যে জগৎ-সংসারে মানুষটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। সেক্ষেত্রে একশো বছর মানে তো “অনেক হয়েছে বাপু….!”
আমি নিজেই জানিনা একশো বছর হয়ে গেলে একজনের মেডিক্লেম চালু রাখতে বছরে কত টাকা প্রিমিয়াম ঢালতে হয়। নিশ্চয়ই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো কিছু একটা অ্যামাউন্ট হবে। এহেন রোগীর জরুরিকালীন কোনো অপারেশনের প্রয়োজন হলে ক’জন বাড়ির লোক পকেটের টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসাপ্রার্থী হবে তা সন্দেহ আছে। অনেককেই বলতে শুনেছি “থাক বাবা! বহুকাল বেঁচেছে। বাকি ক’টা দিন বিছানায় কাটিয়ে চলে গেলে উনিও বেঁচে যান আর আমরাও বাঁচি। এই বয়সে অপারেশন-টপারেশনে না যাওয়াই ভালো।”
অনেক বকবক করলাম। এবার আসি আসল গল্পে। কমলা ঠাকুমা গত ২৯শে নভেম্বর বাড়ির বিছানা থেকে নামার সময় মেঝেতে পা পিছলে পড়ে যান এবং কোমরে আঘাত পান। তাঁর বয়োঃভারে জর্জরিত ক্ষয়িষ্ণু হাড় এই আঘাতের ধকল নিতে পারে নি। ফলে কোমরের বামদিকের হাড়টি ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়। ডিসেম্বরের ২ তারিখে দুই নাতি মিলে ঠাকুমাকে পার্ক সার্কাসের মাঝারি মানের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সমস্তরকম জরুরি পরীক্ষানিরীক্ষা করে ফেলা হয়।
কিন্তু শুধু পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলেই হয় না। তার সাথে দরকার সদিচ্ছা, আত্মবিশ্বাস, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আর ভীষণভাবে প্রয়োজন রোগীর বাড়ির লোকের সহযোগিতা এবং অভয়দান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানবদেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কমজোরী হতে শুরু করে। হৃপিণ্ডের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। ফুসফুসে গ্যাসের আদানপ্রদান ঠিকমতো হয় না। কিডনির রক্ত পরিশ্রুত করার ক্ষমতা লোপ পায়। এছাড়া প্রেসার-সুগার ইত্যাদি নানা অসুখ শরীরে বাসা বাঁধে। বেশি বয়সে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে বলে অপারেশনের ক্ষত শুকোতে চায় না এবং একবার সংক্রমণ শুরু হলে খুব তাড়াতাড়ি তা রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়।
তাই যে কোনো পরিস্থিতিতেই আশি বছরের বেশি রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোভিড পরিস্থিতিতে একজন একশো বছরের বেশি বয়ষ্কা বৃদ্ধাকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে সার্জারি করতে গেলে প্রতিপদে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। এই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেও রোগীকে তাঁর আপাত স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমরা বলতে, অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ বিপ্লব কুমার দলুই এবং আমি।
অবশেষে সুবীরবাবু এবং গৌতমবাবুর সাথে রিস্ক এবং বেনিফিট সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে গতকাল সকালে আমরা কমলা দেবীর সফল সার্জারি করতে সক্ষম হয়েছি। সকলের শুভকামনায় ঠাকুমা এখন বিন্দাস আছেন।
*************************************************
চিত্র ১: সার্জারির পর ওয়ার্ডের বেডে কমলা দেবী।
চিত্র ২: অপারেশন থিয়েটারে ডাঃ বিপ্লব কুমার দলুই এবং আমি।
(বিঃদ্রঃ- এই লেখা এবং চিত্র প্রকাশের পূর্বে রোগীর কনিষ্ঠ পৌত্র গৌতমবাবুর লিখিত সম্মতি নেওয়া হয়েছিল।)