কিছুদিন আগে ছোটদের নিয়ে একটা খুব ছোট লেখা লিখেছিলাম। যার শেষ লাইনটা ছিল ইঁদুর দৌড়ে জিতলেও ইঁদুর আর হারলেও ইঁদুর। তারা মানুষ হোক।
আজ এই ইঁদুর দৌড়ের শুরুর দুটো গল্প শোনাই।
প্রথম ঘটনা
বাচ্চারা যখন পেটে থাকে তখন তারা কেমন বাড়ছে তা জানার জন্য আমরা Growth scan করি। তারপর তার মাথার Circumference, পেটের Circumference বা পায়ের হাড়ের মাপ Femur Length গ্রাফের ওপর প্লট করি। যাতে বুঝতে পারা যায় বাচ্চা ঠিকমতো বাড়ছে কিনা।
সেদিন দেখি চেম্বারের বাইরে কিছু হবু মায়ের জটলা। সবাই মিলে একজোট হয়ে কিছু কাগজপত্র দেখছে। পরে একজন যখন ভিতরে এসেছে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাইরে সবাই মিলে বসে কীসের মিটিং করছিলি রে?” সহেলী এক গাল হেসে বলল, “চার্ট মেলাচ্ছিলাম”।
“মানে?”
“না, অহনার বাচ্চাটা একটু কম বাড়ছে। ওই নিচের লাইনটাতে। আমারটা স্যার একদম ওপরের লাইন ধরে বাড়ছে, দেখুন স্যার দেখুন”। দেখলাম সহেলীর বাচ্চা গ্রাফের ওপরের লাইনে 90th centile এ আছে। তার মুখে বিজয়িনীর হাসি। হায় ভগবান! বাচ্চাগুলো এখনো পৃথিবীর আলোই দেখলো না, আর ইঁদুর দৌড়ে নেমে গেল! এই মায়েরাই কিছুদিন বাদে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতার নম্বর মেলাবে।
দ্বিতীয় ঘটনা
মধ্য কলকাতার অভিজাত নার্সিংহোম। শেয়ার রুম। চারজন এক সঙ্গে থাকে। মাঝে ফিনফিনে সুন্দর সাদা পর্দা। ঘটনাচক্রে চার জনের বাচ্চা একই দিনে হয়েছে। রাউন্ডে গেছি। দেখি আমার পেশেন্ট পারিজাত মনমরা হয়ে বসে আছে। “কী হোল রে?” জিজ্ঞাসা করতেই শুরু হল কান্না। “স্যার আমি ভালো মা হতে পারলাম না”।
“মানে? গতকালই তো মা হলি? ২৪ ঘন্টাও হয়নি। এর মধ্যেই বুঝে গেলি?”
“না স্যার, আমার জন্য আমার বাচ্চা পিছিয়ে যাবে। ”
“ওতো এখনও হাঁটতে চলতেই শিখল না, শুয়ে শুয়ে কী করে পিছবে?”
“না, সবার বুকে দুধ চলে এসেছে আমার আসেনি। আমি টোটাল ফেলিওর।”
পারিজাতকে অনেক করে বুঝিয়ে লিফটের দিকে হাঁটা দিলাম। মা হওয়াটাও পরীক্ষা,এখানেও পাশ, ফেল আছে। আছে প্রতিযোগিতা। এই সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুও ইঁদুর দৌড়ে নেমে গেল। বাচ্চাদের,এই প্রতিযোগিতার স্টার্টিং পয়েন্টে বাবা,মায়েরাই কখন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে! আর বেশি এগিয়ে দিতে গিয়ে আমরা বাচ্চাগুলোকে এগনোর বদলে পিছিয়ে দিচ্ছি। এদের শৈশব কাড়তে গিয়ে আমরা আমাদের বার্ধক্যকে হয়ত আরো নিঃসঙ্গ করে তুলবো। কিন্তু দোষটা তো বাবা – মায়েদের নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি সবই এখন হরির লুটের বাতাসা হয়ে গেছে। টপ করে তুলে খপ করে মুখে পুরে দাও, না হলে কিছুই পাবে না। জীবনের মন্ত্রই হয়ে উঠছে ‘ করে খেতে হবে ‘ নয়, ‘কেড়ে খেতে হবে ‘।
ভুলে গেলে চলবে না, এই ধোঁয়াশায় সব কুড়িরই ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এই সূর্যমুখীরা সূর্যের আলো চুমুক দিতে দিতে মনের আনন্দে বড় হোক, এটাই তো সবার চাহিদা হওয়া উচিত। আমরা যেন ওদের শুধু নিজের জন্য, নিজেকে নিয়ে বাঁচতে না শেখাই। আমার নয়, ‘ আমাদের ‘ সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
এক কথায় অনবদ্য ।