পরিবেশ দূষণ, অতিমারি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ
সার্বিক ও ব্যাপক পরিবেশ দূষণ হয়ে উঠেছে প্রধানতম বিপদ। সমস্ত মানবিক চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলি এবং বিশ্বের তাবৎ ধনিককূল নিজেদের স্বার্থ, মুনাফা ও বিলাসিতা বজায় রাখতে এবং বল্গাহীন ভোগবাদ চরিতার্থ করতে যথেচ্ছ ওজোন স্তর ছিদ্র, ফসিল ফুয়েল পোড়ানো, মিষ্টি জলের অপচয় সহ গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমান বাড়িয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছেন। যার ফল আবাহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ, হিমবাহের গলন, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, ঝড় – বন্যা – বজ্রপাতের প্রকোপ বৃদ্ধি, পতঙ্গবাহিত মহামারি ইত্যাদি।
এর সাথে সাথে দূষিত হয়ে পড়া জল ও বায়ুর কারণে অসুস্থতা বেড়ে চলা। ভূপৃষ্ঠের জল অতিরিক্ত উত্তোলন, বেলাগাম খনি, গাছ কাটা ও অরণ্য নিধন, অপ্রয়োজনীয় বাঁধ ও নির্মাণ, ক্ষতিকর বর্জ্য নিক্ষেপ, প্লাস্টিকের বেপরোয়া ব্যাবহার, পারমাণবিক বর্জ্য, দূষণ ও যুদ্ধের বিপদ ধরিত্রীকে এবং তার পরিবেশ ও প্রাণীকুলকে বিপন্ন করে তুলেছে। অসাধু বাণিজ্যচক্রের অবিমৃশ্যকারী নির্মাণযজ্ঞয় সিকিম থেকে উত্তরাখণ্ড একের পর এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। এর উপর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির জীবাণুযুদ্ধের ফসল কোভিড অতিমারি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, নিপা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ইত্যাদির মহামারি কিংবা প্রতিরোধী যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, স্ট্রোক, দুর্ঘটনা, অবসাদ, আলঝাইমার প্রভৃতির প্রাদুর্ভাব বিশ্ববাসীকে ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্থান ও সম্পদ সীমিত, কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বেড়ে চলেছে জনসংখ্যা গরীব, পশ্চাৎপর ও ধর্মীয় মৌলবাদী দেশগুলিতে।
যুদ্ধের দুন্দুভিঃ
এত বিপদের মধ্যেও সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং প্রভাবশালী মারণাস্ত্র প্রস্তুতকারক ও কারবারিরা একটির পর একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ সৃষ্টি করছে ও চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন, ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ, সিরিয়া, লিবিয়া, আই এস ও ইয়েমেন যুদ্ধ, সুদান ও নাইজিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার যুদ্ধ। অন্যদিকে চীন – ভারত, চীন – তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া – দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত – পাকিস্তা্ন, ইজরায়েল – লেবানন প্রভৃতি সীমান্ত উত্তেজনা ও মারণ অস্ত্রসজ্জা জারি রেখেছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দু বছর অতিক্রান্ত এবং দু পক্ষের সাধারণ মানুষ ও সেনা মিলিয়ে পাঁচ লক্ষের বেশি মৃত্যু হলেও যুদ্ধ থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ ইউক্রেন রাশিয়ার লাগাতার মিসাইল, বোমা ও ড্রন বর্ষণে ছারখার হয়ে গেলেও মার্কিন ও ন্যাটোর সমরসজ্জার কারণে রাশিয়া এখন অবধি ইউক্রেনের সামান্য অঞ্চলই দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
হামাসের ইজরায়েল আক্রমণ, সহস্রাধিক নাগরিক হত্যা ও ২৫০ র মত পণবন্দির প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল মার্কিন সহায়তায় গত তিন মাস ধরে গাজা ভূখণ্ডকে দুরমুশ করে চলেছে, হত্যা করেছে ২০ হাজারের বেশি প্যালেস্তানীয়কে। উত্তর ও মধ্য গাজা জনশূন্য করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেও আশ্চর্যের বিষয় না পেরেছে হামাস নেতৃত্ব কে স্পর্শ করতে, না পেরেছে বন্দীদের উদ্ধার করতে কিংবা হামাসের টানেল জালিকার থৈ পেতে।কুম্ভীরাশ্রু দেখালেও প্যালেস্তানীয়দের তাদের পড়ে থাকা মরুভুমিতেও আশ্রয় দিতে নারাজ প্রতিবেশী ও ইসলামিক সহোদর মিশর, জর্ডান বা সৌদি আরব।ইজরায়েলের দানবিক বোমা বর্ষণের মধ্যে তাই দক্ষিণ গাজার ছোট এলাকায় ২১ লক্ষ প্যালেস্তানীয়র করুণ অবস্থা।
ইউক্রেনে স্থিতাবস্থা, অর্থনীতি ও সৈন্য সঙ্কট এবং দুনিয়া জুড়ে এক ঘরে হয়ে পড়া থেকে বেরিয়ে আসতে ভ্লাদিমির পুতিনের ইরানের মাধ্যমে হামাস্ কে দিয়ে ইজরায়েল আক্রমণ অত্যন্ত কুশলী চাল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টে ব্যস্ত এবং দুনিয়ার কাছে আনেক টা একঘরে হয়ে পড়েছে। মার্কিন সহযোগী কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এই যুদ্ধে প্যালেস্তানীয়দের তো কোন লাভ হয়ই নি, উল্টে গাজার পাশাপাশি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এও তারা ইজরায়েলের কাছে জমি হারাচ্ছেন।
ইউক্রেনের চাইতে গাজা ফ্রন্ট মার্কিন ও পশ্চিমী দেশগুলির কাছে বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় ভলদমির জেলেনস্কির অর্থ, অস্ত্র ও জ্বালানির ভাণ্ডারে টান পড়েছে।অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া, চীন ও ইরানের থেকে বেশি অস্ত্র সংগ্রহ করে রাশিয়া ইউক্রেন পুনর্দখল আভিযানের জন্যে আবার ঝাঁপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মধ্য এশিয়ায় মার্কিন – রুশ ভুরাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে লেবানন – ইজরায়েল সীমান্ত যেখানে ইরানের সমর্থনপুষ্ট হেজবল্লাহ শিয়া সামরিক গোষ্ঠী শক্তিশালী। এছাড়াও রয়েছে সিরিয়ায় থাকা রুশ ভাড়াটে ওয়াগনার সেনাদল এবং ইয়েমেনের হুথি শিয়া সামরিক গোষ্ঠী। লোহিত সাগরে হুথিদের উপর্যুপরি মার্কিন – ইজরায়েল স্বার্থে আক্রমণ ভূমধ্যসাগরের পর লোহিত সাগরে মার্কিন বিমানতরী আগমনের সম্ভবনা বাড়িয়ে যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিতে পারে। বহুদিনের মার্কিন নিশানা ইরান আক্রান্ত হলে পারমাণবিক ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় থেকে যায়। এছাড়াও চীনের শক্তিশালী পারমাণবিক পরীক্ষা, চেরনোবিল ও ফুকিয়ামা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনা এবং ঝাপরিঝা পরমাণু কেন্দ্রে বিস্ফোরণ পারমাণবিক দূষণের মাত্রা ও সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে।
অর্থনীতির সঙ্কট ও বৈষম্যঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্ব অর্থনীতি খুঁড়িয়ে চলছে। ২০২৪ এ ০.১% বৃদ্ধি হলেও সর্বকালীন গড়পরতা বৃদ্ধির কম। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশাল কৃষিক্ষেত্র, দক্ষ প্রাযুক্তিক ও শ্রমিকের উপস্থিতি এবং ১৪৪ কোটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার শ্রমের ফসল মোট জি ডি পি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও জার্মানির পর পঞ্চম স্থানে পৌঁছে দিলেও মাথাপিছু বার্ষিক আয়ে ভারতের স্থান ১৪৩ তম (২৬১২ ডলার)। আদানি, আম্বানি কেন্দ্রিক পারিবারিক পুঁজিময় বর্তমান ভারতীয় আর্থিক ব্যাবস্থায় ১০% ধনকুবেরের হাতে ৫৭% এবং ১% শীর্ষ ধনকুবেরের হাতে ২২% জাতীয় সম্পদ। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার খনিজ তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এই ভারতীয় ধনকুবেররা রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে অন্য রাষ্ট্রে বিক্রি করে ফুলে ফেঁপে উঠলেও দেশজুড়ে ক্রমাগত দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংকোচন ও কর্ম সংস্থানের অভাব, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি বন্ধ বা কাটছাঁট করে দেওয়া ইত্যাদি নাগরিকদের বেজায় সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশের যখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তখন বিপুল অর্থের অপচয় করে তৈরি করা হচ্ছে নতুন সংসদ, সেন্ট্রাল ভিস্তা, বড় বড় মূর্তি ও মন্দির।
ভারতের বেকারত্বের হার ৭.৯৫%, মানব উন্নয়ন সূচক ০.৬৩৩ (বিশ্বে ১৩২ তম), উর্বরতার হার (টি এফ আর) ২.০৫, মাতৃ মৃত্যু হার ৯৭ (এক লক্ষ জীবিত প্রসবে), শিশু মৃত্যু হার ২৭.৬ (হাজারে) প্রভৃতি পরিসংখ্যান এবং বাস্তব পরিস্থিতি শাসকের ধর্ম ব্যাবসা, উগ্র জাতিয়তাবাদ, উন্নয়নের জোয়ার এবং মিথ্যাচারের কল্পকথাকে বেআব্রু করে দেয়। কোভিড পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের এবং বর্তমানে বেকারদের দুরবস্থা মানুষ দেখেছে ও এখন দেখতে পারছে। মধ্যপ্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে অভিভাসন হয়ে দাঁড়িয়েছে যুবকদের একমাত্র লক্ষ্য।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ করে টেলে-কমিউনিকেশন, কম্পিউটার সায়েন্স, মেডিকেল সায়েন্স, মহাকাশ বিজ্ঞান, পরমাণু বিজ্ঞান, মলিকুলার বায়োলজি, ন্যানো টেকনলজি, কৃত্রিম মেধা (এ আই) প্রভৃতিতে প্রভুত অগ্রগতি ঘটলেও এগুলির প্রযুক্তি, নিয়ন্ত্রন ও পেটেন্ট এর অধিকার কিছু পাশ্চাত্যের বহুজাতিক সংস্থার একচেটিয়া দখলে রয়েছে। এগুলির মাধ্যমে নির্মম শোষণ করে তারা নিজেদের মুনাফা ও বিত্ত বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের জীবনধারণ এদের সংস্থা ও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে চলছে মানুষের উপর নিরন্তর নজরদারি। এই প্রযুক্তির সাইবার হানায় এক লহমায় মানুষের সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি আবার কর্ম সংকোচন ও মজুরি হ্রাসের পথ দেখাচ্ছে।
স্বৈরতন্ত্রের বোলবোলাঃ
সামরিক (জুন্তা), কম্যুনিস্ট ও ইসলামি স্বৈরতন্ত্রের পাশাপাশি ইদানিং একধরনের নির্বাচনী সংসদীয় ব্যাবস্থাযুক্ত, জনপ্রিয়তাবাদী (পপুলিস্ট) এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরতন্ত্রগুলির প্রাধান্য। যেরকমঃ তুরস্ক, ভারত ও ব্রাজিল। ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি দলের এমন এক শাসন ব্যাবস্থা গড়ে উঠেছে যা দক্ষিণ ভারতে পরিত্যাক্ত হলেও জনবহুল (সুতরাং বেশি সংখ্যক সাংসদ) উত্তর ভারতের গোবলয় বা হিন্দি হ্রদয়ভুমি সহ বেশ কিছু রাজ্যে হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতিয়তাবাদ, সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং আর জনগনের দেওয়া করের টাকা থেকে কিছু জনপ্রিয়তাবাদী প্রকল্পের মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে ক্ষমতাসীন। ধর্মের নেশায় তারা সাধারণ মানুষকে এমন বুঁদ করে রেখেছেন যে প্রতিদিন ভারতীয়দের যে মৌলিক, নাগরিক, গনতান্ত্রিক, সাংবিধানিক অধিকারগুলি একের পর এক হরণ করা হচ্ছে তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। নোটবন্দির কুফল, অর্থনীতিতে ধারাবাহিক মন্দা, কোভিডের ধাক্কা ও সেই সময়কার ভুল নীতি, রেকর্ড বেকারত্ব, গগনচুম্বী দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, রাস্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের টাকা সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি হয়ে উঠেছে মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য। প্রতিদিন প্রতিরাতে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা লুঠ হয়ে যাচ্ছে। ললিত মোদী, নীরব মোদীদের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে বিদেশে।টাকার মুল্য সর্বকালীন কম। লাভজনক রাস্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিকে বেসরকারি শিল্পের মালিকদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।দেশ বিদেশের সমস্ত বরাত পাচ্ছেন মোদী বান্ধব গৌতম আদানি।
জাতীয় পরিস্থিতিঃ
কাশ্মীর উপত্যকায় ষ্টীম রোলার চালানোর পর ষ্টীম রোলার চলছে ইম্ফল উপত্যকায়। হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তানির এক ব্যক্তি, এক সংস্কৃতি, এক দলীয় শাসনের একইরকম নাগরিক ক্লোন তৈরির কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে যার ভিত্তি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ, ব্রাহ্মন্যবাদ, জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্য, জনজাতি ঘৃণা এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। অন্তরজাল এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত, কণ্ঠরুদ্ধ ও একমুখী প্রচারমূলক। বিজ্ঞান চর্চা ও উচ্চ গবেষণাকে বন্ধ রেখে শিক্ষা ব্যাবস্থার গইরিকিকরণের মাধ্যমে চিন্তা চেতনার মানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক বৈদিক যুগে। মূল সংগঠন আর এস এসের স্বয়ংসেবকদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনী, বিশ্ব বিদ্যালয়, বিচার ব্যাবস্থা সহ সমস্ত দপ্তরের শীর্ষে। চারিদিকে শুধু কল্পকাহিনীর নায়ক থেকে ভোটের ভগবানে রূপান্তরিত শ্রী রামের জয়ধ্বনি। অযোধ্যায় সঙ্ঘ পরিবার কর্তৃক নবকলেবরে রাম মন্দির উদ্বোধনের পর আগামি লোকসভা নির্বাচনের এবং আর এস এসের জন্ম শতবর্ষে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার ধর্মযাত্রা। সত্তর দশকে কংগ্রেসের ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্র ও জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে দেশজুড়ে যে গণআন্দোলন জারি ছিল বর্তমানে সেটি অনুপস্থিত। জনগণ ধর্ম ও মোবাইলে মজে, প্রতিবাদ ও আন্দোলনে নিঃস্পৃহ। দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত বিরোধী নেতা নেত্রীরা মোদী – অমিত শাহের চরণে আত্মসমর্পণকারী। প্রধান বিরোধী দল সার্ধ শতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস অর্বাচীন নেতা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে দিশা, উদ্যোগ ও আন্দোলনহীন। সমাজবাদী এবং বামপন্থীরা শতখণ্ডিত এবং ক্রমশ প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। বঞ্চিত যুবক যুবতীরা তাই সংসদে প্রতিবাদের পথে।
রাজ্যের পরিস্থিতিঃ
পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেকগুলি রাজ্যেই নির্বাচিত, জনপ্রিয়তাবাদী, জনগণের টাকায় জনগণকে খয়রাতি দেওয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসনগুলি প্রতিষ্ঠিত। ৩৪ বছরের বাম অপশাসনের আবসান ঘটিয়ে সততার প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে লড়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার তৃণমূল দল ক্ষমতায় এসে লুঠপাট, অপশাসন, পারিবারিক দুর্নীতি, নৈরাজ্য ও গণহত্যার এমন এক দীর্ঘ শাসন উপহার দিলেন যা বামফ্রন্টের সময় পশ্চিমবঙ্গ যে পেছিয়ে পড়েছিল তার কফিনের উপর শেষ পেরেকটি পুঁতে দিলেন । স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন শৃঙ্খলা, গণপরিবহন, পরিবেশ সব কিছু ভেঙ্গে পড়েছে। পুলিশ দলদাস, প্রশাসন নির্বিকার। চারিদিকে কদর্য তোলাবাজি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, খুনখারাপি। নেতা, মন্ত্রী, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ। সারদা, নারদা, রোজভ্যালী, কয়লা, বালি, গরু পাচার, নিয়োগ, রেশন প্রতিদিন নিত্যনতুন কেলেঙ্কারির ঝাঁপি উন্মোচিত হচ্ছে।
অথচ শিক্ষিত উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা এক হাজার দিনের বেশি খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করছেন চাকরি না পেয়ে। সরকারি খরচে আমোদ, ফুর্তি, উপহার, মেলা, উৎসব, পুজো, কার্নিভাল, পরামর্শদাতা নিয়োগ ইত্যাদিতে অর্থের অভাব নেই , অথচ সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা অমিল।অফিস আদালতে কাজ হয়না, অথচ কর্মদিবসগুলি নষ্ট করে ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি নির্বাচন বিরোধীদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ ও প্রহসনে পরিণত হয়েছে।খয়রাতি নির্ভর নাগরিকরা প্রতিবাদহীন। প্রধান বিরোধী দল অপর দক্ষিণপন্থী কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির সাথে তৃণমূলের সম্পর্ক একাধারে বোঝাপড়া অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। উভয়ে মিলে পরিকল্পিতভাবে সমগ্র রাজনৈতিক পরিসর দখল করে নিয়েছে। সিপিএম অতীতের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য গণভিত্তি হারিয়ে এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবহেলায় ও উদ্যোগ হারিয়ে কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়েছে। এস ইউ সি, নকশাল গোষ্ঠীগুলি, মাওবাদীরা কার্যত অস্তিত্বহীন। এদের কেউ কেউ এবং তথাকথিত বিদ্দ্বজ্জনেরা মুখ্যমন্ত্রীর অনুগ্রহ ও অনুপ্রেরণাপুষ্ট। তৃণমূলের সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই চালিয়ে মুসলমান প্রধান এলাকাগুলিতে আই এস এফ দলটি উঠে আসার চেষ্টা করছে।
কিং কর্তব্যম?
আমরা কেউ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এবং বর্তমান প্রবণতাগুলি পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতির অধঃপতন এখন চলবে। মানুষ দুর্গতি থেকে সহজে মুক্তি পাবেন না। এই তানা শাহী গুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম আগামিদিনে আরও কঠিন হবে।
প্রকৃত দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, জনমুখী শক্তিগুলিকে তাই গোঁড়ামি এবং ব্যাক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ইগো ঝেড়ে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের উপযুক্তভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নিজেদের মধ্যে জীবন্ত যোগাযোগ ও কাজের সমবায় গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং আশু, মধ্যবর্তী, দীর্ঘস্থায়ী ও চূড়ান্ত কর্মসূচী স্থির করতে হবে। এবং সেই অনুযায়ী দৃঢ়কল্পভাবে কাজ করে যেতে হবে। এলাকা, অঞ্চল , কর্মক্ষেত্র প্রতিটিতে মানুষের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হবে, তাদের ধৈর্যশীলভাবে বোঝাতে হবে এবং তাদের মৌলিক দাবিগুলি নিয়ে সৃজনশীল ও কার্যকর আন্দোলন করতে হবে। ধর্ম, কুসংস্কার, লিঙ্গবৈষম্য, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষা কেবলমাত্র সংসদীয় ও সশস্ত্র পথ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে গণআন্দোলনের পথে বারবার সাফল্য এসেছে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। ছোট ছোট কাজগুলি সম্পন্ন করে বড় বড় কাজের দিকে এগোতে হবে। বিজ্ঞানের নিয়মেই মিথ্যাচার, অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি, অত্যাচারের উপর দাঁড়ানো এই সাম্রাজ্য গুলির পতন হবে। সামাজিক দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। প্রকৃত পরিবর্তনকামীরা সজাগ, প্রস্তুত ও সক্রিয় থাকলে ইতিবাচক এবং জনমুখী পরিবর্তন সম্ভব।
________
৩১.১২.২০২৩