1994 এর 2 অক্টোবর আন্দোলনে এক আংশিক বিজয়ের পর কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নেন এক হাসপাতাল গড়ে তোলার। দু’বছর ধরে আন্দোলন চালাতে যাঁরা সাহায্য করেছেন, অর্থ দিয়ে, চাল ডাল দিয়ে, সেই এলাকাবাসীর জন্য ভালবাসার প্রতিদান।
কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের আন্দোলনে ডাক্তার কয়েকজন ছিলেন বটে কিন্তু তাঁরা স্বাস্থ্য আন্দোলনের কাজ করতেন না, করতেন ট্রেড ইউনিয়নের কাজ। চন্দনাদি (মিত্র) তখন সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাংকের মেডিকেল অফিসার, ভাবা হলো চন্দনা দি সপ্তাহ দুয়েক দিন অটোয় করে বিভিন্ন গ্রামে ডাক্তারি করে বেড়াবে।
বাসুদেবদা (মুখোপাধ্যায়–তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের প্রধান চিকিৎসক) এক ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে ফেলল। এক বিশাল হাসপাতাল, তাকে ঘিরে অনেকগুলো স্বাস্থ্য কেন্দ্র…, এখনো ফাইল ঘাটলে সেই পরিকল্পনা খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে ফুলেশ্বরের সঞ্জীবন হাসপাতাল দেখলে। আমি যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কথা বলব তা কিন্তু সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে নি কোনদিন, তার কাছে স্মল ইজ বিউটিফুল।
হাসপাতাল তৈরীর জন্য জমি লাগবে। পন্ডিত রবিশংকরের আড়াই বিঘা জমি ছিল চেঙ্গাইলে, রবি শংকর নিজেও জানতেন না। তাঁর তুতো ভাই ছিলেন তাঁর ম্যানেজার, তাঁর স্ত্রী ব্রজবালা চট্টোপাধ্যায় রবিশঙ্করের নামে জমিটা কেনেন। রবিশংকর তো কখন এই জমির দখল নেবেন না, ব্রজবালা ঠিক করলেন এই জমি কানোরিয়ার শ্রমিকদের দেবেন রবিশঙ্করের মায়ের নামে এক হাসপাতাল তৈরি করার জন্য।
চেঙ্গাইল ফুলেশ্বরে যখন এসব ঘটছে তখন আমি ছত্তিশগড়ে। 1986 তে গিয়েছিলাম ছত্তিশগড় মাইনস শ্রমিক সংঘের শহীদ হাসপাতালে কাজ করতে। 1991 এর ভিলাই এর মিলমালিকদের গুন্ডার হাতে শঙ্কর গুহ নিয়োগী শহীদ হলেন। কিছুদিন পর তাঁর সংগঠন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চায় দু লাইনের সংগ্রাম শুরু হল শ্রেণিসংগ্রাম বনাম শ্রেণিসমঝোতা, সংগঠনে গণতন্ত্র বনাম স্বেচ্ছাচার। এই দুই লাইনের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম 1984-এর মাঝামাঝি সময়। তখনো ছেড়ে আসার কথা ভাবি নি, ভিলাই এ আস্তানা গেড়েছি, চেষ্টা করেছি শ্রমিকদের সংগঠিত করার। পারিনি, পারার কথাও ছিল না, আমি তো রাজনৈতিক বা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক ছিলাম না কখনো।
যখন পশ্চিমবঙ্গে ফেরার কথা ভাবছি, কাদের সঙ্গে কাজ করব ভাবনাচিন্তা চলছে। কারুর মত ছিল কলকাতা এলাকায় এ আই টি ইউ সি র সঙ্গে কাজ করার। স্বচ্ছন্দ বোধ করিনি। কানোরিয়া শ্রমিকদের প্রস্তাব এলো প্রফুল্লদা (চক্রবর্তী) আর পূর্ণেন্দু বসুর মাধ্যমে।
কানোরিয়া জুট মিলের তিন হাজার শ্রমিক মাসে এক টাকা করে দিতে প্রতিশ্রুত হলেন। 3000 টাকা আমার হোল টাইমারস অ্যালাউন্স।
যে জমি হাসপাতালের জন্য পাওয়ার কথা সেখানেই এক অনুষ্ঠান হল 1995 এর 20 মার্চ। কানোরিয়ার অসংখ্য শ্রমিক সর্মথকরা ছাড়াও বিশিষ্ট মানুষদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগবিদ সত্রাজিত দাশগুপ্ত, মনোরোগবিদ ধীরেন নন্দী, সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নাম রাখা হয়েছিল শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্রজবালা চট্টোপাধ্যায়ের আউট হাউসের এক ছোট ঘরে তার পথ চলা শুরু। ভিলাই থেকে শ্রমিক স্বাস্থ্যকর্মী সঞ্জয় প্রসাদ এসেছিল আমার সঙ্গে। কানোরিয়া আন্দোলনের সময় মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে শ্রমিক পরিবারের যে ছেলেমেয়েরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতেন, তাঁরা কাজ করা শুরু করলেন এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
3 হাজার টাকা ছিল ওষুধ কেনার জন্য–প্যারাসিটামল, মেবেনডাজল, আয়রন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, কোট্রাইমোকসাজল, ইঞ্জেকশন প্রোকেন পেনিসিলিন–এইরকম কিছু ওষুধই কেবল কেনা গেছিল।
ঠিক করা হলো রোগীদের কাছ থেকে ফি বাবদ নেওয়া হবে এক টাকা করে।
শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র কাজ শুরু করেছিল 1995 এর 21 শে মার্চ, আজ থেকে ঠিক 27 বছর আগে।