৪-ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ সাল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে একটি তার পৌঁছল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লেখা এই চিরকুটের মাথায় লেখা ‘আলেন্দের জয়’। নীচে নাটকীয় ভঙ্গীতে লেখা, ‘চিলির জনগণ শান্তভাবে এক মার্ক্সীয়-লেনিনীয় রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ভোট দিল। তারাই দুনিয়ার প্রথম জাতি যারা স্বাধীনভাবে এবং জেনেশুনে এই পথ বেছে নিল। আমাদের জঘন্য পরাজয় ঘটেছে, যার প্রভাব পড়বে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আঙিনায়। কিছু নির্দেশে এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হবে, বাকী দেশগুলোতে বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।’ তারটি পাঠিয়েছিলেন চিলিতে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড কোরি।
লাতিন আমেরিকা তথা তামাম বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক পথে কোন সমাজতান্ত্রিক নেতার রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবার ঠিক পঞ্চাশ বছর পর মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা মহাফেজখানা যেসব গোপন নথি প্রকাশ করে, সেখান থেকেই প্রথম জানা যায় এই তথ্য।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সালভাদোর আলেন্দে চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল পড়ার সময় থেকেই মার্ক্সবাদী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। জঙ্গী ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে দু’বার গ্রেপ্তার হয়েছেন, একবার কলেজ থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন। ১৯৩২ সালে তিনি ডাক্তারী পাশ করার পরের বছরেই দেশে চিলির সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেই দলে যোগ দেন। সক্রিয় বাম রাজনীতি করেন বলে সরকারী চাকরী থেকে বঞ্চিত হন। কিছুদিন প্যাথলজিস্ট হিসেবে মর্গে শব-ব্যবচ্ছেদের কাজ করেন। তারপর নিজের জন্মস্থান ভালপারাইসো শহরতলীতে গরীব মানুষের চিকিৎসার জন্য নামমাত্র পারিশ্রমিকে প্র্যাক্টিস শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে দেশের সংসদের নিম্নকক্ষে তিনি নির্বাচিত হন এবং তার দু’বছর পর বামপন্থী জোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সারাদেশে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় মজবুত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন ও স্বাস্থ্যের সামাজিক নিয়ামকগুলির সংস্কারে হাত দেন তিনি। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা গবেষণামূলক বই ‘দ্য চিলিয়ান সোশ্যিও-মেডিক্যাল রিয়েলিটি’ আজকের দিনেও জনস্বাস্থ্যের এক প্রামাণ্য নথি, যার ছত্রে ছত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে দারিদ্র, সামাজিক ও আর্থিক অসাম্যই সিংহভাগ রোগভোগের আসল কারণ। তাঁর গবেষণায় উঠে আসে শ্রমিকদের কম মজুরি ও নিম্নমানের কাজের পরিবেশই মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় ধরণের রোগের বাড়বাড়ন্তের মূলে।
১৯৪৫ সালে তিনি সেনেটে নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সাল থেকে পরপর তিনবার রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেলেও চতুর্থবারে ত্রিমুখী লড়াইয়ে ৩৬ শতাংশের বেশী ভোট পেয়ে জয়ী হন। তবে তাঁর জয় ঠেকাতে মার্কিন প্রশাসন চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি দেশ কমিউনিস্টদের দখলে চলে যেতে বসেছে সে দেশেরই দায়িত্বহীন মানুষের জন্য। আর বিষয়টি শুধু বসে বসে দেখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।’ টিম ওয়েনারের বই সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৭০ সালের ২২ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তখন ওয়াশিংটন থেকে পাঁচ হাজার মাইল দক্ষিণে সান্তিয়াগোর রাজপথে বন্দুকযুদ্ধ চলছিল। চিলির সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রেনে শ্নাইডারকে অপহরণ করে গুলি করে একদল দুর্বৃত্ত। দু’দিন পর তিনি মারা যান। রেনেকে হত্যার কারণ হল, তিনি সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং আলেন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে অসম্মত হন। এরপর নিক্সন প্রশাসন বুঝে যায় যে এই বামঘেঁষা সেনাপ্রধান থাকলে আলেন্দেকে সরানো সহজ হবে না। তাই তারা তাঁকে সরিয়ে দিয়ে একজন দক্ষিণপন্থী সেনাপ্রধানকে বসানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। আর সেনাবাহিনীকে যদি বিশ্বাস করানো যায় যে এই হত্যার পেছনে আলেন্দের হাত আছে, তাহলে তারা নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর ক্ষুব্ধ হবে। নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে সিআইএ প্রধান রিচার্ডসন হেলমকে আলেন্দের শপথ গ্রহণের পথ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। হেনরি কিসিঞ্জার ৭ অক্টোবর কমান্ডার কারামেসিনসকে সান্তিয়াগোয় অবস্থিত সিআইএর স্টেশন-প্রধানকে একটি তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠাতে বলেন – ‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করো এবং তাদের জানাও যে মার্কিন সরকার সামরিক সমাধান চায়। আমরা তাদের সমর্থন করব এখন এবং ভবিষ্যতেও। অন্তত অভ্যুত্থানের পরিবেশ তৈরি করো। সামরিক অভিযানে মদত দাও।’ প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে চালিত হত্যা ষড়যন্ত্রের ধরনধারণ পাল্টে যায়। আলেন্দের দিকে তাক করা রাইফেলে আমেরিকান আঙুলের ছাপ রাখতে চাননি কিসিঞ্জার। কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার নির্দেশ দিয়েছেন যে সিআইএ চিলিতে এমন একজন জেনারেলকে বেছে নিক, যিনি সামরিক সমাধান করতে আগ্রহী হবেন। সে সময়ে সিআইএ সান্তিয়াগো সামরিক ঘাঁটির প্রধান জেনারেল কামিলো ভেলেনজুয়েলাকে উৎকোচ দিয়ে বশে এনেছিল এবং তিন ধাপে সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র আঁটছিল।
এক, সেনারা জেনারেল স্নাইডারকে অপহরণ করে আর্জেন্টিনা নিয়ে যাবে ও এর মাধ্যমে তারা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেনাপ্রধানকে অপসারণ করবে। দুই, এরপর সেনাবাহিনী আলেন্দের নির্বাচনকে অনুমোদন দেওয়ার আগেই চিলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেবে। তিন, তারা সশস্ত্র বাহিনীর নামে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবে।
সাম্রাজ্যবাদের সব ছক ব্যর্থ করে বিজয়ের পর আলেন্দের শপথগ্রহণের দিনে রাজধানী সান্তিয়াগোতে আট লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়, যা চিলির তৎকালীন জনসংখ্যার দশ শতাংশ। ক্ষমতায় এসেই তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয়ে যায় চিলির নিজস্ব রাস্তায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর মহড়া। সরকার সংসদে আইন প্রণয়ন করে চিলি জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করে। বিনামূল্যে সর্বসাধারণের চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও মজবুতীকরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের প্রভূত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশ করা হ’ল। বহু নতুন হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লিনিক খোলা হল গ্রামাঞ্চলে ও শহরতলিতে, সেখানে পর্যাপ্তসংখ্যক ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ করা হ’ল, জোর দেওয়া হ’ল স্যানিটেশনে, সার্বিক পুষ্টিবিধানে ও নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহে। মাথাপিছু ক্যালোরিগ্রহণ দেড়গুণ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা হল রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। হেলথ অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন বিকেন্দ্রীকৃত করে তা স্থানীয় কাউন্সিলের হাতে তুলে দেওয়া হল। বাজেট থেকে শুরু করে পরিকল্পনা সবটাই ছাড়া হ’ল উপভোক্তাদের সমষ্টিগত হাতে। একে একে শুরু হল ব্যাঙ্ক ও খনি জাতীয়করণ, সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, স্কুলে শিশুদের ও মহল্লায় প্রসূতি ও স্তনদাত্রী মায়েদের বিনামূল্যে দুগ্ধ বিতরণ, মিড ডে মিল চালু, পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ফ্রেইয়ের অসমাপ্ত ভূমি সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে আমূল ভূমি সংস্কার, বিপুল কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি, বিনামূল্যে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বেঁধে দেওয়া, পেনশন ও সোশ্যাল সিকিউরিটি স্কিম চালু, সার্বিক সাক্ষরতা অভিযান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া, বিত্তশালীদের আয়কর বাড়িয়ে মধ্যবিত্তকে ছাড়, কৃষকদের সমবায় গঠন ও বিনামূল্য বীজ, সার ইত্যাদি সরবরাহ। সেনাদের বেতন বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে একবছরেই মাথাপিছু ক্রয়ক্ষমতা শতকরা ২৮ ভাগ বৃদ্ধি পেল, জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ বেড়ে হল শতকরা ২৭ ভাগ, মুদ্রাস্ফীতি একধাক্কায় ৩৬ শতাংশ থেকে কমে ২২ শতাংশে দাঁড়ালো, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেড়ে গেল, স্কুলে ও বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে এনরোলমেন্ট কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেল। বিনামূল্যে টেক্সটবুক সরবরাহ হ’ল সরকারী ছাপাখানা থেকে। কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর অব্দি টিউশন ফিস উঠে গেল। শিল্পকলায় বিপুল সরকারী বিনিয়োগ এল, লোকশিল্প, কারুকলা, সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য চর্চায় জোয়ার আনতে দেশজুড়ে মানুষের অংশগ্রহণে অসংখ্য জন-পাঠাগার, নাট্যশালা, সঙ্গীতমেলা, সাংস্কৃতিক উৎসবকেন্দ্র গড়া হ’ল। মাতৃত্বকালীন ছুটি দ্বিগুণ বাড়িয়ে তিনমাস করা হ’ল, মহিলাদের ক্ষমতায়নে পৃথক সেক্রেটারিয়েট গঠন হ’ল। আঠারো বছর বয়সে সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আইন আনা হল। তিনিই প্রথম প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। প্রবর্তন করেন শিক্ষাবৃত্তির। শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের বেতন ৫৬ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় দিতে প্রতি বছর গড়ে ৫২ হাজার গৃহ নির্মাণ করেছিলেন।
এইসব কর্মকান্ডের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় সরব হন আলেন্দে। চিলি নতুন করে বন্ধুত্ব স্থাপন করে চীন ও কিউবার সঙ্গে। কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে। ফিদেল কাস্ত্রোর দীর্ঘ চিলি সফরের পর আলেন্দের বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে আরো গতি আসে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় তাঁর দেড় মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর টানা তিন মিনিট তুমুল করতালি দেয় তামাম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তিনি বলেন, ‘আমরা বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের এক সত্যিকারের মুখোমুখি সংঘর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক – বিশ্বব্যাপী কর্পোরেশনগুলির চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেশনগুলি কোন রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল নয়। তাদের কাজকারবার কোন পার্লামেন্ট বা সাধারণ স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ নয়, তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন নয়। এককথায় বিশ্বের মূল রাজনৈতিক কাঠামোটিই আজ বিপন্ন। বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি শুধু উন্নয়নশীল দেশসমূহের সঙ্গত স্বার্থেরই বিরোধী নয়, এমনকি যেখানে সেগুলি প্রতিষ্ঠিত সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর উপরেও লাগামহীন আধিপত্য বিস্তার করছে। আমাদের নিজেদের উপর আমাদের বিশ্বাস মানবজাতির মহৎ মূল্যবোধের উপর আমাদের প্রতীতি বাড়িয়ে দেয় যে এই মূল্যবোধ নিশ্চিতভাবেই বজায় থাকবে এবং একে ধ্বংস করা যাবে না।’
আলেন্দে সরকারের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ভীত-সন্ত্রস্ত মার্কিন প্রশাসন শুরু করে দেয় নতুন ষড়যন্ত্র। নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার দুটি সমান্তরাল গোপন অপারেশন হাতে তুলে নেয়। ট্র্যাক ১ – চিলির গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরীর মাধ্যমে সরকারকে বিপদে ফেলা ও ট্র্যাক ২ – সেনাবাহিনীকে কব্জা করার মাধ্যমে আলেন্দেকে হত্যা করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো। প্রত্যক্ষ মার্কিন মদতে আলেন্দের বিরোধিতা শুরু করল মুনাফা কমে যাওয়া বিজনেস হাউস, তামার খনির পুরনো মালিক গোষ্ঠী জমি হারানো জমিদারবর্গ, প্রতিপত্তি কমে যাওয়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ, বিরোধী দুই দল ন্যাশনাল পার্টি ও খ্রীষ্টান ডেমোক্র্যাট এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। সিআইএ-র মাধ্যমে বিপুল ডলার ঢেলে এদের বিভিন্ন অংশকে ও বেসরকারী পেশাজীবীদের দিয়ে পরপর ধর্মঘট করিয়ে অর্থনীতিকে পঙ্গু করার চেষ্টার পাশাপাশি নিক্সন সরকার কিউবার মত চিলির উপরেও অন্যায়ভাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। বেআইনী অত্যাধুনিক অস্ত্র চালান করা হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে।
ট্র্যাক ১ ব্যর্থ হওয়ায় ট্র্যাক-২ অনুযায়ী জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে চিলির সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে। আলেন্দেকে সেনাবাহিনী শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেনি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন মর্মে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আলেন্দে হত্যার পর পিনোশে সামরিক শাসন জারি করে আলেন্দের অনুসারীদের নিবির্চারে হয় হত্যা, নয় গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ৫০ হাজার বামপন্থী নেতাকর্মীকে কোতল করা হয়। আলেন্দের মন্ত্রিসভার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করেও বাঁচতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রে একটি গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডেও পিনোশের হাত ছিল। শিশু, নারীসহ প্রায় চল্লিশ হাজার মানষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। আলেন্দের নেওয়া সমস্ত পদক্ষেপ উল্টে দিয়ে দেশের প্রায় সব সম্পদ ও পরিষেবার বেসরকারীকরণ করা হল। সামাজিক সুরক্ষা কবচগুলি একে একে তুলে দেওয়া হল। পেনশন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হ’ল। চিলিই প্রথম দেশ যেখানে নয়া উদারবাদের পরীক্ষা চালু হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল্টন ফ্রিডম্যানের নেতৃত্বে সেখানে ঢালাও বেসরকারীকরণের যে রাস্তা নেওয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে দুনিয়াজুড়ে প্রয়োগ করা হয়েছে। আলেন্দে-হত্যা ও নয়া উদারনীতির যাত্রা একই সূত্রে গাঁথা।
১৯৯০ অব্দি চলেছে পিনোশের এই স্বৈরাচারী শাসন। তারপরেও আলেন্দেকে ভোলেন নি সেদেশের মানুষ। ব্রিটেনের কারাগারে পিনোশের মৃত্যুর আগেই চিলির জনগণের দাবীতে আলেন্দের দেহ কবর খুঁড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনরায় সমাধিস্থ করা হয় সান্তিয়াগোতে। চিলিতে বামপন্থার পুনর্জন্ম হয়। গতবছর ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত বামপন্থী ব্রড ফ্রন্টের প্রার্থী, ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বোরিক চিলির রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়েই বলেন সালভাদোর আলেন্দে ও ভিক্টর জারার দেখানো পথেই চলবে চিলির সরকার। কিন্তু বাধাও রয়েছে। পিনোশের আমলে সংবিধান বদলের জন্য নির্বাচনে তৈরী হয়েছিল গণপরিষদ। তাদের পেশ করা প্রস্তাব নিয়ে আবার ভোট হয় এবছর ৪-ঠা সেপ্টেম্বর, যে দিনটিতে আলেন্দে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু খানিকটা বিষ্ময়কর হলেও খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব ভোটে হেরে গেছে। কেন হারল তার বিশ্লেষণ চলছে। চিলির গরীব, নিম্নবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিক প্রশ্নে আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করছেন।
১৯৭৩ সালে আজকের দিনে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ধুলিস্যাৎ হবার মুখে সেখান থেকে আলেন্দের শেষ বার্তা প্রচারিত হয়েছিল, ‘শ্রমিকগণ, চিলি এবং তার ভবিষ্যতের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এক উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে স্বাধীন মানুষ যে পথে হাঁটবে অচিরেই সেই রাস্তা খুলে যাবে – এটা জেনে এগিয়ে চলো।’ আলেন্দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা নোবেলজয়ী কমিউনিস্ট কবি পাবলো নেরুদার কথায় বলতে হয়, ‘তোমরা ফুলগুলি সব ছিঁড়ে ফেলতে পারো, কিন্তু বসন্ত সমাগম কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’