১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে নবনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু বলছেন, ‘আমার মনে কোন দ্বিধা নেই যে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও রোগ নির্মূল করা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন ও বন্টনের প্রশ্নে আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলোর কার্যকরী মোকাবিলা একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পথেই সম্ভব। পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটা সার্বিক পরিকল্পনার জন্য আমাদের আগামী জাতীয় সরকারকে সর্বপ্রথম একটা কমিশন গঠন করতে হবে। পরিকল্পনার দুটি অংশ থাকবে – স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী।’
কয়েকমাস পরেই তিনি গঠন করলেন জাতীয় যোজনা কমিটি। নেতাজী এই কমিটির নেতৃত্বে চাইছিলেন পন্ডিত নেহরুকে, কিন্তু তিনি অসম্মত। বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহার পরামর্শে নেতাজী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হলেন। কবির নির্দেশে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অনিলচন্দ্র চন্দ নেহরুকে চিঠিতে লিখলেন, ‘হাইকম্যান্ডে এই মুহূর্তে দু’জন আধুনিক মানুষ রয়েছেন – আপনি ও সুভাষবাবু। সুভাষবাবু জাতীয় সভাপতি। সুতরাং আপনাকেই যোজনা কমিটির চেয়ারম্যান হতে হবে।’ নেহরু কবির এই অনুরোধ ফেরাতে পারলেন না। কমিটির প্রথম সভাতেই নেহরু অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি স্পষ্ট করে দিলেন যে স্বাধীন ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু দৈনিক ২৪০০-২৮০০ ক্যালোরির সংস্থান, মহামারী নিয়ন্ত্রণ, সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি হবে জাতীয় অগ্রাধিকার।
এর ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৪৩ সালে কেরালার আইসিএস অফিসার যোশেফ ভোরের নেতৃত্বে গঠিত হল ‘হেলথ সার্ভে এন্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটি’।
কমিটিতে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়সহ সারাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ছিলেন, ছিলেন আইএমএ-সহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরের বহু বিশেষজ্ঞ। ১৯৪৬-এ কমিটি রিপোর্ট পেশ করল। তিন খন্ডের বিস্তারিত রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার সোশ্যাল মেডিসিন মডেলের সাফল্যের নানা দিকের উল্লেখ ও প্রভূত প্রশংসাই শুধু নয়, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে এদেশে একটা শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হল। কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা সুইস চিকিৎসক হেনরী সিজারিস্টকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে লেখা হল, ‘স্বাস্থ্য এমন একটি সম্পদ যার উপর মানুষের অধিকার মৌলিক। যেখানেই এই ধারণাকে মান্যতা দেওয়া হয়, সেখানেই স্বাস্থ্যরক্ষা ও স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা বিনামূল্যে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে এটাই যুক্তিসঙ্গত। শিক্ষার মত মেডিসিনও সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় হবে না, বরং তা রাষ্ট্রের সরকারী দায়িত্বের মধ্যেই পড়বে।’
কমিটির পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘জাতির স্বাস্থ্য গড়তে গেলে রুগীর চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যের উপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্যের কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরী।’ স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে ভাগ করে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার বিস্তারিত রূপরেখার প্রস্তাবনার পাশাপাশি নব্যচিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সোভিয়েত আদলে ‘সোশ্যাল ফিজিসিয়ান’ তৈরীর সুপারিশ ছিল ভোর কমিটির।
১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতে পন্ডিত নেহরুর সভাপতিত্বে জাতীয় যোজনা কমিশন গঠিত হবার পর থেকেই ভোর কমিটির সুপারিশ মেনে জনস্বাস্থ্যকে জাতীয় জনকল্যাণ কর্মসূচীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখা শুরু হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকেই রাষ্ট্রীয় ব্যয়বরাদ্দ ও জনগণের অংশগ্রহণের উপর দাঁড়িয়ে দেশে একটা মজবুত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ঘোষণার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ১৯৮৩ সালে গৃহীত হয় ভারতের প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, যার মূল ভিত্তি ছিল অর্থাভাবে কোন নাগরিক যেন স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত না হয় – এই নীতি। জেনেভায় ৩৪-তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণে বললেন, ‘জীবন মানে কোনমতে বেঁচে থাকা নয়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেঁচে থাকা। জাতির স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের স্বাস্থ্য আমাদের কাছে প্রধান চিন্তার বিষয়। স্বাস্থ্য কখনই শুধুমাত্র রোগহীনতা নয়, বরং একটা দীপ্তিমান ওজস্বিতা, নিরবিচ্ছিন্ন বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির সামর্থ্যসহ এক পূর্ণতার অনুভূতি।’
কিন্তু নয়ের দশক শুরু হতেই হায়নাদের সর্বগ্রাসী লোলুপ দৃষ্টি পড়ল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে –
নয়া উদার অর্থনীতি যে বাণিজ্যিক চোখে দেখে জীবনের সমস্ত পরিসরকে, স্বাস্থ্যকেও সেই চোখেই দেখতে শুরু করল। এদেশে চিকিৎসা ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় এসে গেল। বৃহদাংশের চিকিৎসকের কাছে যা ছিল মানবসেবা, নয়া উদারবাদের খপ্পরে তা সংকুচিত হয়ে হয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে নেমে এল বিক্রয়যোগ্য পরিষেবায়। রোগী-চিকিৎসকের পারস্পরিক সম্পর্কে ভরসার যে ভিত ছিল, তা যেমন ক্রেতা-বিক্রেতার বাণিজ্যিক কূটকচালিতে প্রবেশ করল, তেমনি চিকিৎসকের সামাজিক মূল্য হ্রাস পেয়ে তার উপর অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মূল্য আরোপিত হল।
বাজপেয়ী জমানায় ২০০২ সালে দ্বিতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে উদার অর্থনীতির ছোঁয়া লাগল। বাজেটে বরাদ্দ কমল, বেসরকারীকরণের দরজা খুলে গেল। তবে ২০০৫ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে বামপন্থীদের চাপে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন গৃহীত হয়, যেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নত করার পাশাপাশি নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ, স্যানিটেশন, নারীশিক্ষা, পুষ্টি, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও লিঙ্গসাম্যের মত স্বাস্থ্যের সামাজিক নিয়ামকগুলোর উন্নয়নের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
এর ঠিক এক দশকের মাথায়, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছরেই যোজনা কমিশন বিলোপের মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়নকে বাজারের হাতে সম্পূর্ণ সঁপে দিল। এতকাল যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা যোজনা প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, এই পদক্ষেপের ফলে তা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হল। ২০১৭ সালে সরকার তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করে, যেখানে খুল্লামখুল্লা কর্পোরেটাইজেশন ও প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে সওয়াল করে লেখা হল, ‘সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেসরকারী স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, যাতে বেসরকারি ক্ষেত্র আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরো কার্যকরী, সক্ষম, যুক্তিযুক্ত, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নীতিনিষ্ঠ করে তোলার প্রশ্নে অবদান রাখতে পারে।’ তারপরেই মার্কিন মুলুকের মেডিকেয়ারের আদলে আয়ুস্মান ভারত প্রকল্প ঘোষিত হয়, যা নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হলেও প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ জুটল যৎকিঞ্চিৎ। ২০১৮ সালের বাজেটে ঐ খাতে মাত্র ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হল, যা দিয়ে দেশের সব হাসপাতালের রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহটুকুও সম্ভব ছিল না। কিন্তু অগ্রিম থোক টাকা প্রিমিয়াম ও বিপুল মুনাফার লোভে বহু নতুন দেশী-বিদেশী কোম্পানী বীমা ব্যবসায় নেমে দ্রুত স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দখল নিল, ঠিক যেভাবে শস্যবীমার নামে তারা কৃষিক্ষেত্রে থাবা বসাচ্ছে। সরকারী মদতে এই কর্পোরেট ধান্দাবাজির প্রবণতা এখন বেআব্রু।
তিন দশক উদার আর্থিক নীতিতে চলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছালো? স্বাস্থ্য পরিষেবায় অধিগম্যতার নিরীখে ভারতের স্থান ১৯৪-টি দেশের মধ্যে ১৭৮-তম, গ্লোবাল ডিজিজ বার্ডেন স্টাডি অনুসারে ভারতের স্থান ১৫৪-তম। ভারতে এই মুহূর্তে ১৮৮৭ জনপিছু একটি মাত্র হাসপাতালের শয্যা, যেখানে জাপানে ৮৩ জনপিছু একটি, চীনে ২২৩ জনপিছু একটি শয্যা। সারাদেশে গড়ে ১৬৮৮ জনপিছু একজন মাত্র চিকিৎসক, ৬১১ জনপিছু একজন মাত্র নার্স রয়েছেন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অন্ততঃ ৫০০ জনপিছু একজন করে চিকিৎসক ও ৩০০ জনপিছু একজন করে নার্স। ২০১৯-২০ সালের সরকারী তথ্য অনুযায়ী দেশে দেড় লক্ষের কিছু বেশী উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল, যেখানে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। এই দেড় লক্ষের এক তৃতীয়াংশ আজও ভাড়াবাড়িতে চলে, দশ শতাংশ কেন্দ্রে কোন এএনএম নেই। সারাদেশে মাত্র ত্রিশ হাজার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ভোর কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী থাকার কথা আরো অন্ততঃ হাজার পাঁচেক বেশী। সাম্প্রতিক অতিমারীর ধাক্কায় পরিকাঠামো ও মানবসম্পদের এই ঘাটতি আরো নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। এই সময়কালে কোভিড ও অন্যান্য রোগে এত বেশী মৃত্যুহারের কারণ এই ঘাটতিগুলো। নমুনা নথীভূক্তিকরণ সমীক্ষা ২০১৮ অনুসারে ভারতে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩২, লাখে ১১৩ মাতৃমৃত্যু। গতবছর প্রকাশিত পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে এসেছে ভারতীয় মহিলা ও শিশুদের অর্ধেকের বেশী রক্তাল্পতায় ভুগছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সমীক্ষা চালানো ২২-টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ১৫-টিতেই, অর্থাৎ কেরালা ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো বাদে দেশের প্রায় সর্বত্র এই চিত্র। সরকারী পোষণ ট্র্যাকার অ্যাপের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত অক্টোবরে ৩৩ লক্ষেরও বেশী শিশু অপুষ্টিতে ভুগছিল, যার মধ্যে পৌনে আঠারো লক্ষ গুরুতর অপুষ্ট।
স্বাস্থ্যে জিডিপির ২.৫ শতাংশ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে ১.১৬ শতাংশে আটকে গেল মোদী সরকার, যা ভারতকে ১৯৪-টি দেশের মধ্যে ১৮৭-তম স্থানে রেখেছে। অথচ বিশ্বের তাবড় দেশের অভিজ্ঞতা হল জিডিপি-র অন্ততঃ ৫ থেকে ৬ শতাংশ ব্যয় না করলে জনগণের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয় না। ভারতের স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের ৫৮ শতাংশই জনগণকে পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই শতাংশ বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ – পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঠিক পরেই। ২০০৬ সালে তৃতীয় জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে এসেছিল সারাদেশে শহরাঞ্চলের ৭০ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলের ৬৩ শতাংশ পরিবার বেসরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তার পরের দেড় দশকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস ও বেসরকারী ক্ষেত্রে পরিষেবার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে গতবছর প্রকাশিত পঞ্চম সমীক্ষায় দেখা গেল উল্টোপুরান – সরকারী ক্ষেত্র থেকে পরিষেবা নেবার প্রবণতা বাড়ছে। ফলস্বরূপ বেসরকারী ক্ষেত্রের আর্থিক বৃদ্ধির গতি কিঞ্চিৎ শ্লথ হতেই স্বাস্থ্যবীমার নামে জনগণের করের থোক টাকা সরাসরি বেসরকারী ক্ষেত্রে চালান করা হল। ভারতের হেলথকেয়ার ইন্ডাস্ট্রির বর্তমানে কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট ১৭ শতাংশ। অতিমারীর প্রথম বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল এই ইন্ডাস্ট্রির ভল্যূম, এবছর ৩৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছনোর লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে বিনিয়োগকারীরা। রোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচীগুলো সব অর্থাভাবে ধুঁকছে। রোগ না হলে কর্পোরেট হাসপাতাল, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, ওষুধ ও বীমা কোম্পানীর ব্যবসা লাটে উঠবে যে! যত রোগভোগ, মহামারী, ওদের তত পোয়াবারো!
স্বাধীনতার পৌনে শতাব্দী পরে ভারতের জনগণ দুটো বিপদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে – একদিকে সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঢালাও বেসরকারীকরণ, অর্থবরাদ্দে কার্পণ্য, অন্যদিকে বেসরকারী বীমানির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একদিকে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে সরকারী কোষাগার থেকে সরাসরি বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলোর পকেটে অগ্রিম টাকা ঢোকানোর বন্দোবস্ত হয় সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার নাম করে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এক শতাংশের আশেপাশে বেঁধে রাখায় সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ফলে বেসরকারী বীমানির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থা ক্রমে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে প্রতিস্থাপিত করছে।
মোদী সরকারের স্বাস্থ্যনীতি রাষ্ট্রের ভূমিকাকেই বদলে দিয়েছে – যে রাষ্ট্র স্বাধীনতার লগ্ন থেকে জনগণের হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার ছিল, সে হয়ে গেল শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবীমার ফাইন্যান্সার। কিন্ত রাষ্ট্র কাকে ফাইন্যান্স করছে? অবশ্যই বেসরকারী বীমা কোম্পানী আর কর্পোরেট হাসপাতালকে। এই ভূরিভোজের আয়োজনে কর্পোরেট শিবির তাদের উল্লাস গোপন রাখেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা কোম্পানীগুলোর বিলগ্নীকরণ, তিনটি কোম্পানীর একত্রীকরণের পাশাপাশি বীমা ও ফার্মা সেক্টরে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা আসলে কি চায়। রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধ কোম্পানীগুলিকে বসিয়ে দিয়ে বা বিক্রী করে দিয়ে বেসরকারী ফার্মা সেক্টরকে মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ওয়ালমার্ট ও অ্যামাজনকেও ওষুধের রিটেইল ব্যবসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। মেডিক্যাল শিক্ষাকেও কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন গড়া হয়েছে দেশজুড়ে চিকিৎসকদের ধর্মঘট অগ্রাহ্য করে। ওষুধের দামের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে ধাপে ধাপে, উৎপাদন-ব্যয়ভিত্তিক মূল্য নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ঐতিহ্য মুছে ফেলে বাজারের হাতে মূল্যের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে। তার উপর ভ্রান্ত পদ্ধতিতে জিএসটি চাপিয়ে ওষুধকে আরো মহার্ঘ করা হয়েছে। ভারতের ফার্মা মার্কেটের গ্রোথ রেট কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের শুরুতে ছিল ৫১.৫ শতাংশ। এই সেক্টরে বার্ষিক টার্নওভার ১.৫ ট্রিলিয়ন কোটি টাকার। অর্থাৎ অতিমারীতে কর্পোরেট শিবির মুনাফা লোটার বাড়তি সুযোগ নিয়েছে। অতিমারীর সময়ে একদিকে দেশে মাল্টিবিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে ক্ষুধা সূচকে ১২৭-টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান নামতে নামতে ১০১-এ গিয়ে ঠেকেছে!
দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ক্রমশঃ পণ্যায়িত হতে হতে আজাদী কা অমৃত মহোৎসবের প্রাক্কালে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাই এক ঝাঁ-চকচকে বৃহৎ শপিং মলে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাহারী পসরা সাজিয়ে বসেছে নানা কর্পোরেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি, বহুজাতিক ফার্মা হাউস, চিকিৎসার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সংস্থা ও স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানী। অন্যদিকে সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ঐ শপিং মলের উল্টোদিকের ফুটপাতে ঝুপড়ি দোকানগুলোর মত, যেখানে গরীব মানুষ চা খেতে ভীড় জমান, কিন্তু বসার জায়গা নেই, দাঁড়ানোর ঠাঁইটুকুও মেলে না, অথচ যৎসামান্য বেতনে ঘেমেনেয়ে দিনরাত চা বানাচ্ছেন দোকানের কর্মচারী। আর চায়ে চিনি কমবেশী হলেই জুটছে গণধোলাই!
এ কোন ভারতবর্ষ! নেতাজী, নেহরু, রবীন্দ্রনাথ, ডঃ মেঘনাদ সাহা, পি সি মহলানবিশ, ডাঃ বিধান রায় প্রমুখদের দেখানো পথ ছেড়ে এ কোন অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়েছে আমার দেশ!
এই প্রবন্ধটি গণশক্তি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত।