আজ আনন্দবাজার পত্রিকায় বাড়ির বাইরে শৌচাগারের প্রয়োজন এবং নারীবাদের সীমা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ পড়ছিলাম। বেশ কিছু পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দিল প্রবন্ধটি।
অনেক অনেক বছর আগে, সালটা সম্ভবত ১৯৯৭, চার বন্ধু মিলে বৃষ্টিদিনে কোলাঘাটে রূপনারাণের শোভা দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে। ডে-ট্রিপ মানে হাওড়া থেকে লোক্যাল ট্রেনে কোলাঘাট নেমে ইতিউতি ঘোরাঘুরি, নদীপাড়ে বসে গল্পগাছা, দুপুরে হাটুরে হোটেলে ইলিশ-ভাত ভক্ষণ এবং ফের ট্রেন ধরে কলকাতা ফেরা। ‘সোনার বাংলা’র অস্তিত্ব রবিকবিতায়/ আবেগী বাঙালির মননে ছিল — রিসর্ট ফিসর্ট হয়নি। হলেও আমরা খরচা চালাতে পারতাম না — সরকারি চাকরি জোটেনি তখনো।
তা, সব কিছু হিসেবের মধ্যে ধরলেও টয়লেটকে (তখনো তাকে ওয়াশরুম বলার রেওয়াজ হয়নি) ধরতে ভুলে গিয়েছিলাম। চারজনের মধ্যে দুজন পুরুষ — তাদের বর্জ্য হৃদয়ে ধারণ করার জন্য উন্মুক্ত পৃথিবী কোল পেতে রেখেছে — আরেকজন বুদ্ধিমতী নারী — সে যাবার পথে হাওড়া স্টেশনে হালকা হয়ে নিয়েছে। আমি বিশুদ্ধ হাঁদা, ‘এখন কেন যাব, পায়নি তো’ বলে এড়িয়ে গিয়েছি।
ঝামেলা মালুম হলো বেলা গড়ালে।সারা কোলাঘাট ঢুঁড়ে আমার বন্ধুরা একটিও ভদ্র টয়লেটের খোঁজ পেল না যখন, হাল ছেড়ে ছুটলাম স্টেশনে। দক্ষিণ পূর্ব রেলের মানচিত্রে কোলাঘাট নেহাত হল্ট স্টেশন তো নয়, একখানি শৌচালয় থাকবে আশা করেছিলাম। বলতে নেই, ছিলও। উপরে কাঁচা হাতে ‘মহিলা’ লেখা একটা দরজাহীন ঘর — তার মেঝের দিকে তাকালে অন্নপ্রাশনের ভাত দূরস্থান, গোটা অন্ত্রটাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার ঘোরতর ঝুঁকি রয়েছে। তাও উপেক্ষা করতে পারতাম, কিন্তু বিনা আড়ালে জৈবকর্মটি করি কেমন করে? শেষে তিন বন্ধু আমার দিকে পিছন করে দাঁড়াল দরজা আটকে, আর বন্ধুত্বের ঢালের আড়ালে আমার করুণ মূত্রথলি ভারমুক্ত হলো।
বছর পাঁচেক পরে একবার উত্তরবঙ্গের চাকরিস্থল থেকে কলকাতা ফিরছি বাসে। আমার কর্মস্থলের জেলাটির সঙ্গে কলকাতার ট্রেন যোগাযোগ তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে, অতএব বাসই ভরসা। দীর্ঘ যাত্রাপথে ভদ্রস্থ টয়লেট সহ দুটি ‘স্টপেজ’ রয়েছে সে বাসের। বহরমপুর এবং কৃষ্ণনগর। যাত্রার দিন সকাল থেকেই আমার ‘ফ্লুইড রেসট্রিকশন’ আরম্ভ হয়ে যেত — যথাসম্ভব কম জল খেতাম। তা, সেবার প্রচন্ড গরম পড়েছে — শুভবুদ্ধির সাবধানবাণী ভুলে রাত আটটায় বাস ছাড়ার আগে অবধি দু’আড়াই লিটার জল পান করে ফেলেছি অদূরদর্শীর মতো।
রাত একটা-দেড়টা হবে — বহরমপুর আসতে তখনো মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাকি, সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠল। সিএসটিসির লঝঝড়ে বাস, ততোধিক লঝঝড়ে একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক আমার বেদনাকে বাড়িয়ে তুলল বহুগুণ। লজ্জার মাথা খেয়ে ড্রাইভার দাদার শরণাপন্ন হলাম — অপরিচিত সহযাত্রী ক’জন তো ঘুমে অচেতন। সৌভাগ্যক্রমে বাসের সারথি আমার কর্মস্থলের শহরেরই বাসিন্দা, আমাকে চিনতেন। অন্ধকার হাইওয়ের ধারে দাঁড়াল বাস — তিনি বাঁ হাত দিয়ে রাস্তার পাশের অন্ধকার ঝোপ দেখিয়ে বললেন — “চলে যান দিদি, ভয় নেই। হেলপার পাহারায় থাকবে”।
নিম্নাঙ্গে সূচালো ঘাসের খোঁচা খেয়ে, জোঁক-ফাঙ্গাস-পোকামাকড় প্রভৃতি শত্রুপক্ষের আক্রমণের আশঙ্কায় চোখে জল এলেও ড্রাইভারদাদার সহানুভূতির কথা ভেবে ঈশ্বরের চরণে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
তারপরের কয়েক বছরে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে। কখনো হরিদ্বার থেকে মসুরি যাবার পথে, কখনো চেন্নাই থেকে কাঞ্চিপুরমের রাস্তায়, তো কখনো জনবিরল দিল্লি জয়পুর হাইওয়েতে। ভদ্র, নিরাপদ পরিবেশে একটি পরিচ্ছন্ন, ব্যবহার্য শৌচাগারের জন্য মা-মেয়েতে হন্যে হয়েছি অনেকবার।
মাস কয়েক আগে জরুরি প্রয়োজনে একবার স্বাস্থ্য ভবনে যেতে হয়েছিল। সেখানে কাজ মিটতে ঘন্টা তিনেক লাগার পরে শৌচাগারের প্রয়োজন অনুভব করলাম।
একতলায় সিকিওরিটি ভাইদের জিজ্ঞাসা করলাম — “লেডিজ ওয়াশরুমটা কোন দিকে ভাই?”
তারা আঙুল তুলে দূরে করিডোরের একটা অনির্দেশ্য প্রান্ত দেখিয়ে দিল। ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে ছ’টা — কর্মচারীদের কলরব স্তিমিত হয়ে এসেছে, আমি অনালোকিত করিডোরের গোলকধাঁধায় ওয়াশরুম আবিষ্কার করতে এগোলাম। ডানদিক, বাঁদিক, ফের ডানদিক — প্রায় সওয়া পাঁচ প্যাঁচ ঘুরে অভীষ্ট জায়গাটিতে পৌঁছলাম। না, দু’একটা ছিটকিনি আর দু’চারটে জলের কল বাদ দিয়ে সেই কমন টয়লেট খুব খারাপ/অব্যবহার্য ছিল না, স্বীকার করি।
কিন্তু, একটি ঝাঁ চকচকে আধুনিক সরকারি ভবনে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো, কর্মীদের ওঠাবসার মূল জায়গা থেকে তিন ক্রোশ দূরে, ছায়া ছায়া আলো আঁধারি রহস্যের ঘেরাটোপে এই দরকারি জায়গাটির অবস্থান কেন হবে, আজও বোধগম্য হয়নি।
নিজ বর্তমান কর্মস্থলেও দেখি, মেশিনপত্র, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র, বাতি, জানলার কাঁচ মায় চেয়ার টেবিলেরও ভগ্নদশা হয়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটার অব্যবহিত আগে মেরামত/বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়, ব্যতিক্রম শুধু টয়লেট।
সেখানে অবিশ্যি পুরুষ-নারী উভয়েই ভুক্তভোগী হই, আমাদের রাশভারী বিভাগীয় প্রধান সমেত।
একেবারে নিখুঁত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।