এটা আমার এক বন্ধুর গল্প। নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প।
বাঁকুড়ায় পড়ার সময় আলাপ তার সঙ্গে। ক্লাসে অল্পস্বল্প পরিচয় ছিল – কিন্তু সে মস্ত বড়লোকের মেয়ে, তায় ইংলিশ মিডিয়াম, রীতিমতো ক্যাট গোত্রের ইংলিশ মিডিয়াম – বিপরীতে আমি মফস্বলি বাংলা মিডিয়াম – খুব একটা কথাবার্তা হয়নি। ঘনিষ্ঠ আলাপটা হল অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে।
একদিন এক সিনিয়র দাদা রাত্তিরে হস্টেলে এসে বলল, তোদের ক্লাসের অমুক, তার বাবা খুব অসুস্থ, ওকে বাড়ি যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু ও জীবনে কখনোই একা চলাফেরা করেনি, তোদের মধ্যে কোনও একজনকে সঙ্গে যেতে হবে।
তো শেষমেশ স্থির হলো আমিই যাব।
সিনিয়র দাদার বার্তার মধ্যে সহমর্মিতার সঙ্গে সঙ্গে একটা হাল্কা রাজনৈতিক স্বার্থও ছিল। নতুন ব্যাচের ছেলেমেয়েদের দলে টানার জন্য সহযোগিতা-সহমর্মিতা ইত্যাদি খুবই কার্যকরী পথ। (এবং সেই বন্ধু সে নিয়ে আজীবন, বিশেষত ঝগড়াঝাঁটি হলেই, আমাকে ঠেস দিয়েছে – ধান্দা দিয়েই যার শুরু, তা কি আর বন্ধুত্ব হয় রে!!) কিন্তু সে যা-ই হোক, পরদিন ভোরবেলা – ভোর বলতে প্রায় শেষ রাত্তির – লেডিজ হস্টেলে গিয়ে হাজির হলাম। দারোয়ানজি গিয়ে ডাকতে না ডাকতেই মেয়েটিও এলো। সঙ্গে আমাদের ক্লাসেরই দু-চারজন মেয়ে (যাদের মধ্যে একজন পরে টিপ্পনী কেটেছিল, আমি নাকি অত ভোরবেলায় আফটার-শেভ-এ প্রায় স্নান করে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম)। চারটে নাগাদ বাস, হস্টেলের সামনে দিয়েই। সেই বাসে চড়ে দুর্গাপুর স্টেশন। ছটা-পাঁচে ট্রেন। হাওড়া।
যেতে যেতেই আলাপ হলো। ওদের অনেকগুলো চায়ের বাগান। আসামে। বাবা সেখানেই থাকেন, ও থাকত কলকাতায়। বলছিল, বাবার সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই খানিকটা মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছে। কথাবার্তাও খুব নিয়মিত হয় না। কিন্তু তারপর যখন জানতে পারে, বাবা সেই আসাম থেকে বাঁকুড়ায় ফোনের চেষ্টা করে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না, তখন মনখারাপ তো হয়ই। এও জানলাম, বাবা অসুস্থ নন, আহত। গুরুতর আহত। শ্রমিক বিক্ষোভ ইত্যাদির মধ্যেই কে একজন বাবার ঘাড়ে ভোজালি দিয়ে কোপ বসিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির জীবনে যাতায়াত বলতে মূলত প্লেনে (আর আমি প্লেনে চাপা তো দূর, আকাশে ছাড়া প্লেন দেখিওনি), কচিৎ-কদচিৎ রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেস জাতীয় ট্রেনে (সেসব ট্রেনও আমার অধরা – আনন্দমেলা পুজোসংখ্যায় ‘রাজধানী এক্সপ্রেসে গোগোল’-এর ইলাস্ট্রেশন দেখে সেই স্বপ্নের ট্রেনের ছবি আঁকতাম) – এক কি দুবার মাত্র, যখন তাকে অন্য ট্রেনে চাপতে হয়েছিল, অগত্যা ফার্স্ট ক্লাসে। সাধারণ এক্সপ্রেস ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে চাপার এই প্রথম অভিজ্ঞতা। মেয়েটি যারপরনাই লজ্জিতও, কেননা এই বয়সে কলকাতা যাতায়াতের জন্য সমবয়সী কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হচ্ছে…
হাওড়া স্টেশন থেকে প্রিপেইড ট্যাক্সিতে চাপা, আমার ক্ষেত্রে, সেই প্রথম। গড়িয়াহাট মোড়ের একেবারে পাশেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাট – মূলত ওর পড়াশোনার জন্যই রাখা – সেখানে গিয়ে জানলাম, গুরুতর আহত নন, বাবা খুনই হয়ে গিয়েছেন। চা-বাগানেই মৃত। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আরও ডিটেইলস জেনেছিলাম, কিন্তু সেই কাহিনি এখানে অবান্তর। তো, যেটা হলো, সেবার বাড়ি থেকে ফিরে এসেই মেয়েটা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেল। আমার এবং আমাদের। অর্থাৎ আমাদের বন্ধুবৃত্তের সকলের। ঘনিষ্ঠ বলতে একেবারে গলায় গলায় বন্ধু। আমরা জনা-তিন-চার প্রায় সকাল থেকে সন্ধে একসঙ্গে কাটাতাম। পড়াশোনার বালাই ছিল না। সেই গুডি-গুডি মেয়েটা আমাদের পাল্লায় পড়ে ক্লাস ফাঁকি দিতে শিখল, সামনের মিষ্টির দোকানে বসে আড্ডা দিতেও শিখে গেল। এমনকি বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিও গজিয়ে গেল তার – যদিও সর্বদাই বলত, দ্যাখ, আমি কিন্তু ক্যাপিটালিস্ট।
এসবই অল্প কিছুদিনের গল্প। মাত্র কয়েকটা মাস। কয়েক মাসেই যে সারাজীবন স্থায়ী হওয়ার মতো বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে যেতে পারে, বিশ্বাস করা মুশকিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা-ই। কিছুদিন বাদেই জানতে পারলাম, ওর মা আর দিদি রাজ্যপালের কাছে দরখাস্ত করেছিলেন, ওর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে – দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে – মেয়েটি কলকাতার একটি মেডিকেল কলেজে চলে যাবে।
যাবার দিন আমরা জনাকয়েক বন্ধু এমন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম যে ওর দিদি খুবই অবাক হয়ে বলেছিলেন, এ কী, তোমরা এমন করছ যেন ও শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে!! আরে, দেখা তো হবেই… কলকাতায় গেলেই…
পাঁচতলা থেকে মেয়েটির লাগেজ নিয়ে আসতে আমাদের মধ্যে দুজন লেডিজ হস্টেলের পাঁচতলায় ওঠার অনুমতি পেয়েছিলাম – হস্টেল সুপারের কাছ থেকে পাওয়া অনুমতি – আসন্ন বন্ধুবিচ্ছেদের যন্ত্রণার মধ্যে স্মরণীয় উত্তেজনার ঘটনা তো বটেই…
আর হ্যাঁ, বাঁকুড়া থেকে চলে আসার আগের দিন মেয়েটি আমাদের দলের সদস্যা হয়েছিল। বলেছিল, দ্যাখ, আমি তো চলেই যাচ্ছি, কেউ বলতে পারবে না ভোট পাবার জন্য ইত্যাদি প্রভৃতি… আমি একেবারে নিঃস্বার্থভাবে তোদের দলের মেম্বার হলাম।
তো, যা হয়, ভৌগোলিক দূরত্ব আচমকা বেড়ে গেলে, যোগাযোগ থাকলেও, যোগাযোগ ক্রমশ কমে আসে। কিন্তু এটুকু জানতাম, আমার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে আমি যাদের নিঃসঙ্কোচে ডাকতে পারি, তাদের মধ্যে এই মেয়েটি পড়ে – যদিও ডেকে ওঠা হয়নি কখনোই। যোগাযোগ ক্রমশ এতখানিই কমে গেল যে মাসের পর মাস কথাবার্তা হয়নি। এসব তো মোবাইল-পূর্ব যুগের গল্প। এসটিডি বুথে লাইন দিয়ে স্রেফ আড্ডা মারার জন্যই ফোন করার মতো সাধ বা সাধ্য কোনোটাই ছিল না আমার। অতএব দূরত্ব অনেকখানিই বাড়ল। এমনকি ওর বিয়েতেও শেষমেশ যাওয়া হয়নি, যদিও নেমন্তন্ন তো বটেই, পইপই করে যেতে বলেছিল। নাকি গিয়েছিলাম শেষমেশ? সে-ও মনে নেই। অথচ তারপরও জানতাম, বন্ধুত্বটা আছেই…
মোবাইলের পরে যোগাযোগ খানিক বাড়ল। খবরাখবর পেতাম। অবাক হয়ে দেখতাম, অত্যন্ত ধনী পরিবারের মেয়েটা কর্পোরেট হাসপাতালে সাধারণ চাকরি করে। কেননা, কাজ শিখতে হবে। ঠাকুরদার নামে একটা জমি আছে। ওর ইচ্ছে সেখানে একটা ছোট হাসপাতাল করে। ঠাকুরদার নামেই। না, পুরো চ্যারিটেবল নয় – চ্যারিটিতে ওর বিশ্বাস নেই – কিন্তু সামান্য খরচে সবার সামর্থ্যের মধ্যে চিকিৎসা – কেননা, ওর ভাষায়, তোরাই তো আমার মাথাটা বিগড়ে দিলি… তো সেই হাসপাতাল চালাতে হলে ওকেও হাসপাতালের মেকানিক্সটা ভালো করে বুঝতে হবে।
শেষমেশ হাসপাতালটা ও করতে পেরেছে, সেও বেশ কয়েকবছর হলো। ধাপে ধাপে খানিকটা বড়ও করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে কথা হয়। একদিন যেমন দুঃখ করছিল, কী বলব বল, যা অবস্থা… আমাদের তো সরকারও মারছে, ডাক্তাররাও মারছে… শুরু করেছিলাম একভাবে… ভেবেছিলাম, কাউকে কোনও কমিশন বা কাটমানি দেব না… তো দেখলাম, সেটা একদম অসম্ভব… পেশেন্ট তো পাঠায়ই না, উলটে পেশেন্ট আসতে চাইলে বদনাম করে… বলে, ওখানে ভুল রিপোর্ট দেয় ইত্যাদি….
আরেকদিন দুঃখ করল, তোদের সব ডাক্তারদের যা অবস্থা (সব ডাক্তার যে কবে আমার বা আমাদের হয়ে গেল, জানি না – কিন্তু, বন্ধুটি, আফটার অল, বড়লোকের মেয়ে, নিজেও বড়লোক, তাদের সঙ্গে তর্ক না করা-ই ভালো)… জানিস, ডিমানিটাইজেশন-এর পর, হাতে ক্যাশ নেই… বললাম, কমিশনটা চেকে দিই… কেউ কিচ্ছু বলল না, চেক নিল, চেক ক্যাশ করল, কিন্তু পেশেন্ট পাঠানো বন্ধ করে দিল… এখন, ভেবে দ্যাখ, আমি জিএসটি দিই যে টাকার উপর, সেই টাকাকে ক্যাশ হিসেবে… সাদা টাকাকে কালো করে… এতে পেশেন্টদেরই খরচ বাড়ছে, কিন্তু এই সিস্টেমের বাইরে কিছু করতে গেলে আমার নার্সিংহোমটাই আর চালানো হবে না…
সেদিন বলছিল, পেশেন্টদের নিয়েই বা কী বলব!! সেদিন একজন দাবি করেছে, উডল্যান্ডস-এ ডিনারে তন্দুর চিকেন দেয় (সত্যিই দেয় নাকি!!), আপনারা দেবেন না কেন? কী বলি বল! আমার বেড ভাড়া যে উডল্যান্ডস-এর চারভাগের এক ভাগেরও কম, সেটা যদি সবাই ভুলে যায়…
তো আচমকা এত গল্প কেন?
দুদিন আগেই আমার সেই বন্ধুর জন্মদিন পার হয়ে গেল। আমার জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই তার জন্মদিন। আমাকে হ্যাপি বার্থডে বলতে সে কখনও ভুলে গেছে, এমন হয়নি। আর আমি মনে করে ঠিক দিনে হ্যাপি বার্থডে বলতে পেরেছি, এমন ঘটনাও কখনও ঘটেনি। এ বছরও তেমনই।
এই লেখাটা এজন্যই, যাতে আমার সেই বন্ধুটি বুঝতে পারে, জন্মদিনের তারিখ ভুলে গেলেও এটুকু আমি নিশ্চিত জানি যে সে আমার বন্ধু।
এবং এমন অসাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পারাটা আমার পক্ষে গর্বের।
পুনঃ- অস্বস্তিতে পড়ে চেঁচামেচি করবে, সেই ভয়ে আমার সেই বন্ধুর নাম এখানে লিখলাম না। তদুপরি, এই লেখার কিছু কিছু অংশ – বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে গেলে – তার নার্সিংহোমটির স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক হিসেবে স্থাপিত হতে পারে। কাজেই…