মা,
সক্কাল সক্কাল একঝাঁক দেখা/অদেখা পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের ফোনবাহিত শুভেচ্ছা দিয়ে শুরু হয়েছিল তোমার আমার ৫৬তম নাইনথ এপ্রিল।
তারপর পার্বতীদির যত্নে রেঁধে রাখা চিকেনের ঝোল-ভাত আর গত পুজোয় তোমার পছন্দ করে যাওয়া না পরা মুর্শিদাবাদী সিল্কের সঙ্গতে এগিয়ে চলল দিনটা — যে দিনের ভয়ে গত ছ’মাস সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সবরকম জায়গায় লুকিয়ে পড়ার প্ল্যান করে চলেছিল তোমার বোকা খুকু। আধ শতকের স্মৃতি কি আর কনে বউয়ের পালকি, যে ঘাটে আঘাটায় নাবিয়ে দিয়ে ছুট্টে পালিয়ে গেলেই তার ভার থেকে রেহাই পাবো?
চললাম কাজে। আমার ব্লাডব্যাঙ্কে। সহকর্মীদের মিষ্টিমুখ করাতে গিয়ে দেখলাম, সবাই, প্রায় সক্কলে মনে রেখে দিয়েছে আজ আমার জন্মদিন।
প্রথম মাতৃহীন জন্মদিন। বেশি কথা নয়, সান্ত্বনা নয়, শুধু হাতটা মুঠোয় নিয়ে একটু চাপ দিয়ে বলা — দিদি, আমরা আছি।
বেলা গড়িয়ে দুপুর। অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ‘আপনার একটা কেক ডেলিভারি আছে। মেডিক্যাল কলেজ ব্লাড ব্যাঙ্ক। আপনি সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন তো?”
ভয়ঙ্কর অবাক হলাম। আমার জন্মদিন মনে রেখে কে পাঠাবে কেক, মা?
বাবা থাকলে ঠিক বুঝতাম, এ বুড়োরই কীর্তি! কিন্তু এখন!
সংশয়ের নিরসন হলো আধঘন্টার মধ্যেই।
জানো, দেশ আর বিদেশের দুই অদেখা বন্ধু মিলে পাঠিয়ে দিয়েছেন জন্মদিনের বিশাল কেক — বাবা যেমন অর্ডারি কেক আনতো ছোটবেলায়, সেই ব্যারাকপুরের ইউবিক রেস্তোরাঁয় ক্রিকেটপাগল মেয়ের আবদারে গাভাসকরের ‘সানি ডেজ’ এর মোড়কের সঙ্গে খোলা হতো গাবদা কেকের বাক্স — তেমনি কেক।
কৃতজ্ঞ হবো কি, আমি তো অবাক হতেও ভুলে গেলাম মা!
সারা ব্লাডব্যাঙ্ক মিলে সেই কেক কাটার সাক্ষী থাকল মোমবাতি জ্বালিয়ে, আর আমার আনাড়ি হাতে ভাইবোনদের খাইয়ে দিলাম তোমার একলষেঁড়ে মেয়েটার রাংতামোড়া জন্মদিনের একটুকরো খুশি! অবাক কান্ড কি জানো মা, যখন কেক কাটা হলো, ঠিক তখনই চোখ চলে গেল হালদার স্যারের হাতঘড়ির দিকে। ঘড়িতে তখন ঠিক দুপুর তিনটে বিয়াল্লিশ!
কি সমাপতন বলো, তোমার মেডিক্যাল কলেজের পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে জ্বলজ্বল করছে টাইম অফ বার্থ অফ ফিমেল বেবি টু মিসেস ডলি ব্যানার্জি — থ্রি ফর্টি টু পি এম, এপ্রিল নাইন, নাইনটিন সিক্সটি নাইন।
তুমি বলেছিলে, আমি যেখানেই থাকি, সবসময় তোকে ঘিরে থাকব, জানবি। কোত্থাও যাব না আমি তোকে ছেড়ে, যেতে পারবই না।
সত্যিই, তোমাকে জড়িয়ে ধরার অনুভবেই কেটে গেল আমার পৃথিবীর মাটিতে পা রাখার দিনটি, তোমার কোলে মাথা রাখার দিনটি, বাবার চওড়া বুকে মুখ গোঁজার প্রথম দিনটি —
হ্যাপি বার্থডে মা — তোমাকেও মা হওয়ার জন্মদিনের শুভেচ্ছা — জানি, যেখানেই আছো, আমার ডাক তুমি শুনবেই, আমার শুভকামনা তোমায় ছুঁয়ে দিয়ে যাবে ঠিক।
ভাল থেকো।
খুকু।