চাকরিটা ছাড়া তোমার উচিৎ হয়নি মা।
নাহয় নতুন বিয়ে, বাবা’র কাজের জায়গা ট্রেনে ঘন্টা তিনেক,
তাবলে স্থায়ী বাংলাশিক্ষকের পদ ছেড়ে তোমার পতিনির্ভর গৃহবধূ হয়ে যাওয়া মোটেই ঠিক হয়নি তোমার।
মানছি,
সেটা উনিশশো সাতষট্টি,
মানছি তখন বাংলায় এম এ’র চাকরি সহজলভ্য,
মানছি বিবাহিত মেয়েরা বেশি চাকরি করতেন না,
তাই বলে তুমিও?
মেয়েদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার স্বপক্ষে তোমার গলা
আমরা তো জন্মইস্তক শুনছি।
তুমি বলবে ‘তোদের বাবা হাত পুড়িয়ে খেতো কী করে?’
তারপর আরেকটু হেসে যোগ করবে ‘তারপর তো তুই এসে গেলি.. ওই দস্যি ছেলেকে সামলাতো কে!’
তুমি তো বাবার মতোই বিয়ের আগে রান্না জানতে না মা,
যেভাবে হাত পুড়িয়ে,
ভাত পুড়িয়ে আর স্বপ্ন গুঁড়িয়ে শিখে নিয়েছিলে,
তার দশভাগের একভাগ শ্রমে কি বাবাও শিখতে পারতো না?
আসলে তোমার বা বাবার ধারণাই ছিলো না,
পুরুষ রাঁধতে পারে,
নারী বর ছাড়া দূরে চাকরি করতে পারে,
সন্তানপালন করতে মা’য়ের চাকরি ছাড়ার দরকার নেই।
তোমার ওই গৃহবধূতে রূপান্তর আমরা দুভাই আজ যেখানে, সেখানে এনে দিয়েছে,
তুমি থাকলে ভয়ানক ধমকে বলতে,
এতেই তোমার তৃপ্তি,
এই অভীষ্টই তোমার লভ্য ছিলো।
দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে তোমার টিউশনি’র ছাত্র ছাত্রীরা তো আছেই,
আজও যারা ‘জ্যেঠিমা’ বলতে অজ্ঞান।
মানছি মা মানছি,
আমরা আজ ‘আমরা’ হয়েছি তোমার ওই ত্যাগের জন্য,
কোনো ঝগড়ার মুহূর্তে বাবা তোমায় একবারও খোঁচা দেয়নি সিঙ্গল ইঞ্জিন সংসারের জন্য।
কিন্তু ভাবো তো,
সে ইঞ্জিন কোনোভাবে বন্ধ হয়ে গেলে,
আমরা দুভাই ঠিক ততটা তোমার মনের মতো না হলে,
অথবা সব ঠিক হয়েও স্রেফ বাবা তোমাকে ‘শুধু গৃহবধূ’
বলে তাচ্ছিল্য করলে,
তখন প্রতিকার পেতে কোনো উপায়ে,
অবলম্বন করতে কোন আশ্রয়কে,
সংসার ধরে রাখতে কোন ম্যাজিক দিয়ে?
রিস্কটা কি একটু বেশি নিয়েছিলে না মা?
আমরা যে যার মতো হয়েছি,
কিন্তু তোমার যেরকম হওয়ার কথা ছিলো,
সেই তুমি তো কখনো হলে না!
তোমাকে চেনার কথা ছিলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রছাত্রীর,
গবেষণা করার কথা ছিলো জীবনানন্দের কাজ নিয়ে,
কি ক্ষতি হতো, যদি বাবা সপ্তাহের শেষে তোমার কাছে ফিরতো,
আর তুমি শীত গরম পুজোর ছুটিতে বাবার কাছে?
আমরা কি তাতে মানুষ হতাম না মা?
চাকরিটা তোমার ছাড়া উচিৎ ছিলো না মা,
অমুকের বউ, তমুকের মা,
তা ছাড়াও আরো অনেক বড় পরিচয় তোমার প্রাপ্য, তোমার অধিকার ছিলো।
তুমি তো সংসারকে গোটা জীবন দিলে, সংসার তোমাকে কী দিলো মা?