এই প্রতিবেদন ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ও নটরাজ মালাকারের যৌথ রচনা।
সত্তর দশক। মুক্তির দশক। এমনটাই তো লেখা থাকত দেওয়াল জুড়ে। যে-মুক্তির জন্য লড়াই সেই মুক্তি কি এল? পদ্মার এপারে হয়তো শুধু “কিছু মায়া রয়ে গেল”! কিন্তু পদ্মার ওপারে? সেখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্ম দিল। মুক্তি এল খানসেনাদের অত্যাচার থেকে, পাক হানাদারদের থেকে। কিন্তু মুক্তিসন্ধান শুধু ‘সোনার বাংলা’ সাকার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না। মুক্তিসন্ধান চলল নানান ক্ষেত্রে। তার মধ্যে এক বড় ক্ষেত্র স্বাস্থ্য। আর সেই মুক্তি সংগ্রামে যিনি ছিলেন দিশারী সেই জাফরভাইকে সম্প্রতি হারালাম আমরা। কে এই জাফরভাই? তাঁকে জানতে, চলুন আরও এক দশক পিছিয়ে যাই।
১৯৬০-এর দশক। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ঢুকলেন এক তরুণ। নাম জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছাত্রজীবনেই জড়িয়ে পড়লেন বাম ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে। পরে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও হলেন। মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে লড়াই করার চিন্তাভাবনার শুরু সেখান থেকেই। মেডিকেল কলেজের চত্বর থেকে মানুষের জন্য কাজ করার ভাবনা ছড়িয়ে পড়ছিল হাসপাতাল চৌহদ্দির বাইরেও। পড়ার পাশাপাশি চলছিল মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা। তার মধ্যে ছিল রাতের অন্ধকারে দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর মতো কাজও। সেটাই তো হয়। যে দেশে অর্থনৈতিক গতির সঙ্গে সামাজিক গতির পার্থক্য থাকে, সেই দেশের যুবকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বেশি হয়। তাছাড়া সেই দেশ যদি বিদেশী শাসনাধীনে থাকে তাহলে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাও প্রখর হয়। তাঁদের মূল লক্ষ্য হয় সমাজ। সমাজবিজ্ঞানী আইজেনস্টাডটের এই তত্ত্ব যেন সত্যি হয়ে উঠল জাফারুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রে। তাঁর নেতৃত্বে ডাক্তারি-পড়ুয়া তরুণরাও সমাজটাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন মেডিকেল কলেজের অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়ালেন চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। সময়টা ১৯৬২-৬৩। ছাত্ররা সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। পেশ করলেন তাঁদের দাবি। কী আশ্চর্য! তাতে ছাত্রস্বার্থের দাবি ছিল না। দাবি ছিল, হাসপাতাল থেকেই বিনামূল্যে সব ওষুধ দিতে হবে।
ডাক্তারি পাশ করার পর জাফরুল্লাহ সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলেন ইংল্যান্ডে। সেখানে তিনি গড়ে তুললেন ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’। অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জাফরুল্লাহর ভাষায়, ‘সে এক রোমান্টিকতার যুগ। আমরা প্রভাবিত হয়েছিলাম চে গেভারার দ্বারা।’
এরপর এল সত্তর দশক। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। দেশের মানুষের সংগ্রামের শরিক হতে জাফরুল্লাহ ছুটে এলেন স্বদেশে। যুদ্ধফ্রন্টে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়ে তোলা হল ৪৮০ বেডের ফিল্ড হাসপাতাল, যার প্রধান কারিগর জাফরুল্লাহ। হাসপাতাল হলেও ডাক্তার আর নার্স কই? ফের মুশকিল-আসান হলেন জাফরভাই। তিন সপ্তাহের মধ্যে একশোর বেশি মহিলাকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্মের পর কাজ গেল আরও বেড়ে। ১৯৭২ সালে গড়ে তোলা হল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। শুরু হল এক বিরাট স্বাস্থ্য আন্দোলন। সমস্যা তৈরি হল সংগঠনের নাম নিয়ে। ভাবা হল নাম হবে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু ‘জনস্বাস্থ্য’ বলতে তো শুধু সরকারি উদ্যোগ বোঝায়। ফলে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার পর ঠিক হল, সংগঠনের নাম হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। শুধু চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া নয়, লক্ষ্য মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
ঢাকা শহর থেকে ২২ মাইল দূরে সাভার গ্রামে স্বাস্থ্যপ্রকল্প গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ শুরু। ১৯৭৫ সালে দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ১:৩০,০০০। তাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র মূলত জোর দিয়েছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনসমাজের অংশগ্রহণের ওপর। গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্যারামেডিক্যাল ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হল সংগ্রামী স্বাস্থ্যকর্মী। চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ভাসেকটমি ও টিউবেকটমি অপারেশন করানো হল সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে। বন্ধ্যাত্বকরণ অপারশনে তাঁদের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য পুস্তিকা বের করা, পরিবার পরিকল্পনার প্রচার, নিরক্ষরতা দূর করা, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হল তাঁদের কাজ। সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠায় নারীদের অংশগ্রহণের জরুরি কাজও হয় এঁদের হাত ধরে। দ্রুত চলাচলের জন্য গ্রামের মহিলাদের সাইকেল চালানোর ওপর জোর দেওয়া হল। কাজটা সহজ ছিল না। রক্ষণশীল অংশের বাধা অতিক্রম করে এগোতে হচ্ছিল। বিশ্ব নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করতে ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে গণস্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তেইশজন মহিলা সাইকেলে চড়ে সাভার থেকে ঢাকায় গিয়ে আলোড়ন ফেলে দিলেন। মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব দূর হওয়ার ফলে মহিলা রোগীরা বোরখা না পরেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রবেশ করার সাহস পেলেন। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগও নিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে-সব গ্রামে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করল সেখানে শিশু মৃত্যু, প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু, চর্মরোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্যভাবে কমল। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরীক্ষার-নিরীক্ষার জায়গা ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা শিখেছিলাম কীভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনসমাজকে যুক্ত করা যায়’।
১৯৬০-এর দশকে লাতিন আমেরিকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনসমাজকে যুক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তিনি লিখেছিলেন হোয়ার দেয়ার ইজ নো ডক্টর। ১৯৮২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এই গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ বের করে যেখানে ডাক্তার নেই শিরোনামে। অনূদিত গ্রন্থের মুখবন্ধে বলা হয় ‘গ্রন্থটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হল যখন সরকার একটি জাতীয় ওষুধ নীতি ঘোষণা করছেন। ওষুধ নীতি বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা – এ-গ্রন্থ সেই সচেতনতা দিতে সাহায্য করবে।’ ১৯৭০ সালে মহারাষ্ট্রের জামখেদে রজনীকান্ত ও মাবেল্লে আরোলে নামে চিকিৎসক-দম্পতি কম্প্রিহেন্সিভ রুরাল হেলথ প্রজেক্ট নামে একই ধরনের প্রকল্প চালু করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ‘আলমাআটা ঘোষণা’য় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি ও জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়ার কথাই বলা হয়েছিল। ২০০৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রুরাল হেলথ মিশন নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনসমাজের অংশগ্রহণ, মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি (আশা) ইত্যাদি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তা ছিল এক মাইলফলক।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী লড়াই করেছিলেন ‘ওষুধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে’। ১৯৭৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে প্রতিটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজন এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কাঠামো অনুযায়ী অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা তৈরির কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ কমিটি অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের ফলে বাংলাদেশে ওষুধের দাম ছিল খুব বেশি। তাই জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেদের ওষুধ নিজেরাই তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হল গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। টনিক, ভিটামিনের পরিবর্তে জেনেরিক নামে অত্যাবশ্যক ওষুধ উৎপাদন ছিল এর উদ্দেশ্য। ১০-১৫ শতাংশ লাভ রেখেও বহুজাতিক কোম্পানির ওষুধের দামের থেকে ৩৫-৫০ শতাংশ কম দামে ওষুধ বিক্রি করতেন তাঁরা। তবে শুধু ওষুধ কারখানা তৈরি করে সমস্যা সমাধান হবে না, চাই জনমুখী জাতীয় ওষুধনীতি। বাংলাদেশে নথিভুক্ত ওষুধের মূল্যায়ন ও জাতীয় ওষুধ নীতির খসড়া তৈরি করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সালে আট সদস্যের এক কমিটি গঠন করে। কমিটি বলেছিল সাশ্রয়ী মূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ করতে না পারলে ২০০০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’র লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছতে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গেই চাই জাতীয় ওষুধ নীতি। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ১৬৬৬টি অপ্রয়োজনীয় ওষুধকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাজের ক্ষেত্র শুধু বাংলাদেশ ছিলনা। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে যে-মানুষের শৈশবের একটা সময় কেটেছে কলকাতায়, সেই শহরে তিনি বারবার এসেছেন। তাঁর কাজের কথা বলেছেন এদেশের মাটিতে। তাঁর কাছ থেকে ভারতের স্বাস্থ্য আন্দোলন দিশা পেতে চেয়েছে। ১৯৮৪ সালে কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে ওষুধ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে ভলেন্টারি হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার এক সেমিনারে এসে তিনি শুনিয়েছিলেন বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদনের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের গল্প। পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগ অ্যাকশান ফোরাম নামের একটি সংগঠন এইরকম এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই ধরনের বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে তৈরি হয়েছিল অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশান নেটওয়ার্ক। ভারতের সংগঠনগুলো বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। আশির দশকে এক স্কুলছাত্রের গণস্বাস্থ্য নামটার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল একটা পত্রিকার সুবাদে। কৈশোরে গণস্বাস্থ্য পত্রিকার পাতা ওল্টানো সে-ছেলে পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ নিজের চোখে দেখেছিল বাংলাদেশে সাভারে গিয়ে, কথা হয়েছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গেও। এতদিন ধরে শুনে আসা গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের পীঠস্থানে গিয়ে সে প্রত্যক্ষ করেছিল স্বপ্নদ্রষ্টা এক মানুষের স্বপ্নপূরণের কাহিনি। মানুষটি চলে গেলেন কিন্তু তাঁর স্বপ্ন আর তার সফল রূপায়ণের ঝিলিমিলি লাগিয়ে দিয়ে গেলেন পৃথিবীজোড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের চোখে।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক।