আমি তখন শিশু বিভাগের ইন্টার্ন। আগের দিন এডমিশন ডে গেছে। সকালে ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করে কাজ করছি। হাতে পিজিটি দাদা কাজের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। রাউন্ড শুরুর আগে সব ইনভেস্টিগেশন পাঠিয়ে দিতে হবে। বেশ কয়েকজন থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। তাদের ব্লাড রিকুইজিশন করতে হবে।
সিস্টারদের টেবিলের উল্টোদিকে বসে এক মনে ব্লাড রিকুইজিশনের ফর্ম ভরছিলাম, একজন বয়স্ক সিস্টার বললেন, ‘আপনাদের ইউনিটের কোনো অতিথি ছিল না। গতকাল চলে এসেছে।’
বললাম, ‘দিদি, কী বললেন, বুঝতে পারলাম না।‘
সিস্টার বললেন, ‘কাল পুলিশ এসে ভর্তি করে দিয়ে গেছে। কলেজ স্কোয়ারে নাকি অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। ওই তো কোনের বেডে ভর্তি আছে। মন্দিরা ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছে। যান দেখে আসুন।‘
গিয়ে দেখি একটা বছর দেড়েকের ফুটফুটে মেয়ে। দিব্যি জ্ঞান আছে। একজন কম বয়সী সিস্টার বাচ্চাটার জামা পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। বাচ্চাটা প্রাণপণে হাত পা ছুড়ে মা মা বলে কাঁদছে।
আমি বাচ্চাটার হাত দুটো ধরলাম। সিস্টার দিদি কায়দা করে মাথা দিয়ে জামা গলিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘আমার মেয়ের জামা। একবারও পরেনি। না পরেই ছোটো হয়ে গেছিল। কী সুন্দর ফিট করে গেল।‘
বাচ্চাটির কোনো ইনভেস্টিগেশন পাঠানোর নেই। আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা কান্না থামিয়ে আমার স্টেথো ধরে টানছে। জিনিসটা যে ওর ভারী পছন্দ হয়েছে সেটা চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যাক গে। আমার তো এখন স্টেথো লাগছে না। স্পিরিট দিয়ে স্টেথোটা একটু মুছে বাচ্চাটির হাতে দিয়ে দিলাম। এটা নিয়ে খেললে খেলুক।
টেবিলে বসতেই সেই বয়স্ক সিস্টার দিদি আমাকে ধরলেন। বললেন, ‘কী সমস্যা বলুন তো। ওয়ার্ডে এরকম তিনটে বাচ্চা হয়ে গেল। একটা বাচ্চা তো বছর খানেক ধরে রয়েছে। এদের খাওয়ানো দাওয়ানো , স্নান করানো সব আমাদেরই করতে হবে। অথচ নতুন নার্সিং-স্টাফ চাইলেই এন এস বলছেন, আর স্টাফ দেওয়া যাবে না। পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট যে অন্য ডিপার্টমেন্টের থেকে আলাদা সেটা কেউই বুঝতে চায় না।‘
আমি হাসলাম। এ ব্যপারে আর কী মতামত দেব। তারপর পকেটে ভায়াল পুরে ব্লাড টানতে গেলাম। থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চাগুলো রক্ত দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিজেরাই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক বারের জায়গায় দুবার ছুঁচ ফোটালেও আপত্তি করছে না। ফুটফুটে মায়াবী চেহারার বাচ্চাগুলোর হাত থেকে রক্ত নেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে আর যাই করি, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হব না। দিনের পর দিন এই অসুস্থ বাচ্চাদের অসহায় পরিণতি দেখার মতো মনের জোর আমার নেই।
ভিজিটিং চিকিৎসক রাউন্ডে এলেন। এই রাউন্ড বড়ই মজার জিনিস। সাপের মতো ডাক্তারদের লাইন। মাথার দিকে থাকেন একজন বা দুজন ভিজিটিং প্রফেসর, তারপর আর এম ও, তারপর পিজিটি, তারপর হাউজস্টাফ, ল্যাজের মাথায় আমার মতো পাতি ইন্টার্ন। প্রত্যেকটি অসুস্থ শিশুর বেডের ধারে দাঁড়িয়ে রোগ নিয়ে আলোচনা চলছে। স্যার প্রশ্ন করছেন। পিজিটি হাউজস্টাফ দাদারা উত্তর দিচ্ছে। একদম লেজের দিকে থাকায় সেসব গুরুগম্ভীর আলোচনা আমার কানে কিছু পৌঁছচ্ছে- কিছু পৌঁছচ্ছে না। যদিও পৌছালেও বেশিরভাগ আলোচনা আমার মাথার উপর দিয়েই যাবে।
দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে যাচ্ছিল। কোনের বিছানাটার দিকে তাকালাম। বাচ্চা মেয়েটা আমার স্টেথোটা একমনে কামড়ে যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে স্টেথোটা নিতেই কাঁদতে শুরু করল। মন্দিরাদি এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনি যান। ওর খিদে পেয়েছে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।‘
রাউন্ডে বাচ্চাটির বেডের সামনে দাঁড়ানো হলো। ভিজিটিং প্রফেসর বাচ্চাটিকে দেখলেন। বুকে স্টেথো বসিয়ে শব্দ শুনলেন, তারপর বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। কাল কোনো মাদকের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। সম্ভবত শিশু পাচারের কেস। ভয় পেয়ে ফেলে পালিয়েছে। এর ওষুধ পত্র কিছু লাগবে না। এই যে বাবা, তোমার নাম কী যেন?’
উনি আমাকেই ডাকছেন। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘স্যার, ঐন্দ্রিল।’
স্যার হাসলেন। বললেন, ‘বাহ, নামটা তো জম্পেশ। তা তুমি বাবা সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার অফিসারকে একটা চিঠি লিখে রেখো। দাও দাও, একটা কাগজ দাও। আমি সই করে দি।
রাউন্ডের পর বসে বসে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসারকে চিঠি লিখছি। মেডিসিন ওয়ার্ডে পোস্টিং থাকা কালীন আত্মীয়স্বজনহীন রোগীদের কোনো হোমে পাঠানোর জন্য এরকম অনেক চিঠি লিখেছি। মেডিসিনের পিজিটি দাদা বলত, ‘এই সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসারের কোনো অস্তিত্বই নেই। তুই আসলে এক অশরীরীর কাছে চিঠি লিখছিস। ওই চিঠি কেউ পড়েও দেখবে না। আসলে বছরের পর বছর চিঠি লিখতে লিখতে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। যার কেউ নেই তাঁর এই সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার আছে।’
একমনে চিঠি লিখছি। এমন সময় সেই বয়স্ক সিস্টার দিদি বললেন, ‘একটা নাম বলুন তো তাড়াতাড়ি। আপনাদের ইউনিটের মেয়ে। আপনিই নামকরণ করুন।‘
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, ‘কার নাম, ঐ বাচ্চাটার?’
সিস্টার বললেন, ‘আবার কার। কিছু একটা বলে ডাকতে হবে তো।‘
কী নাম দেওয়া যায়? বললাম, ‘খুকু নামটা চলবে?’
সিস্টার দিদি বললেন, ‘সব চলবে, একটা নাম হলেই হলো। এই মন্দিরা, দেখ তো খুকু হিসি করবে কিনা? সকাল থেকে একবারও তো করেনি।‘
দিন চলে যায়। আমি আস্তে আস্তে বাচ্চাদের রক্ত টানায় এক্সপার্ট হয়ে উঠি। নবজাতকদের হাতে চ্যানেল পরাতে শিখে যাই। পেডিয়াট্রিকে মাত্র এক মাসের ইন্টার্নশিপ। দেখতে দেখতে একমাস প্রায় কাটার উপক্রম হয়।
কিন্তু এই একমাসে খুকু আমাদের সকলের খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেককেই চিনে ফেলে সে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হাত বাড়ায়। কোলে চলে আসে। গালে গাল ঠেকিয়ে আদর করে।
সেই বয়স্ক সিস্টার গজ গজ করেন, ‘সবাই মিলে খুকুকে এন্তার চকলেট আর চিপস খাওয়াচ্ছেন। এরপর ওর শরীর খারাপ হলে কিন্তু আপনারা ঝাড় খাবেন।‘
খুকু সিস্টারদের কোলে কোলে ঘোরে। সে আর কাঁদে না। খিল খিল করে হাসে। খুকুর এখন অনেক জামা, অনেক পুতুল। অন্য বাচ্চারা ঈর্ষার চোখে তার পুতুলদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমার শিশু বিভাগের ডিউটি শেষ হয়ে গাইনিতে ডিউটি শুরু হয়েছে। তবু দিনের মধ্যে একবার খুকুকে দেখে আসি। একদিন একজন সিস্টার বলেন, ‘খুকুর সত্যিকারে মা বাবার খোঁজ পাওয়া গেছে। পাথর প্রতিমায় বাড়ি। কাল ওকে হোমের লোকেরা নিয়ে যাবে। ওখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর খুকুকে মা বাবার হাতে তুলে দেবে।‘
শেষবার খুকুর বিছানার পাশে এসে দাড়াই। খুকু ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুম ভাঙাব না। একবার এর গালটা ছুই। খুকু কেঁপে ওঠে। পাশে সিস্টার-দিদি এসে দাঁড়ান। দিদির দু চোখে জল। কান্না গোপন করেন না। বলেন, ‘বাচ্চাগুলো এতো মায়ায় জড়িয়ে দিয়ে যায়।‘
ছেলেদের কাঁদতে নেই। ডাক্তারদের তো নেইইই। তাছাড়া কাঁদবোও বা কেন। ও মা বাবার কোলে ফিরে যাবে, এতো আনন্দের ব্যাপার। খুব ইচ্ছে করে ওকে তুলে কোলে নি। শেষবার বুকে চেপে আদর করি। সাহস পাই না। ভালোবাসা কখনো কখনো অজান্তেই কাঁদিয়ে দেয়।
আজ জীবনের অর্ধেকের বেশি অতিক্রম করে গেছি। প্রায় রাত দিন ডাক্তারি করি। যন্ত্রের মতো রোগী দেখি। ক্লান্তি লাগে, এক ঘেঁয়ে লাগে। এর থেকে অন্য যে কোনো পেশায় গেল অনেক ভালো জীবন কাটাতে পারতাম। সন্তানদের সময় দিতে পারতাম। তবু মাঝরাতে মনে হয় এই জীবনে যা পেলাম, সেটাও খুব কম পাওয়া নয়। এবং সেই সব অমূল্য অনুভূতি কেবলমাত্র একজন চিকিৎসকের ভাগ্যেই জোটে।