ইসাবেল আলেন্দে (আইয়েন্দে)-র ‘আ লং পেটাল অফ দ্য সি’ পড়েছেন?
সদ্য পড়ে উঠলাম। উপন্যাস শেষ হলো বটে, কিন্তু এ বইয়ের রেশ চট করে কাটিয়ে ওঠা মুশকিল।
গল্প বলার কী আশ্চর্য মুনসিয়ানা! চরিত্রগুলোকে যেন আপনি চোখের সামনে দেখতে পাবেন। পারিপার্শ্বিকের দীর্ঘ বিবরণ নেই, তবু সময়টা, চরিত্রগুলোর আশপাশ ঘরদোর দোকানপাট যেন রূপ-রস-গন্ধ সহ আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবে। আর গল্পের এমনই টান, যে, শেষ না হওয়া অবধি আপনার মন পড়ে থাকবে সেখানেই। এমনকি, উপন্যাস শেষ হওয়ার পরেও।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ। সেখানে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো-র জয়ে মিলিটারি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে কাতালোনিয়ার সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ পালিয়ে যেতে চান ফ্রান্সে। কিন্তু পালিয়ে যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়! পিছুটান, দুর্গম পথ, প্রবেশ আটকাতে ফ্রান্স-এর সীমানা বন্ধ করে রাখা। যাঁরা পৌঁছালেন, সেই শরণার্থীদের প্রতি ফরাসিদের তীব্র বিদ্বেষ – তাঁদের ঠাঁই হয় অমানবিক পরিবেশের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে – কতজন ফ্রান্স পৌঁছাতে গিয়ে রাস্তায় মারা যান, কতজন ফ্রান্সে পৌঁছে…
পাবলো নেরুদা একখানা মালবাহী জাহাজ ভাড়া করে হাজার দেড়-দুই শরণার্থীকে নিয়ে যান নিজের দেশে – চিলি-তে। সেখানেও শরণার্থীদের অপছন্দের চোখে দেখে দক্ষিণপন্থীরা – আরেকদিকে, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেগ নিয়ে একটা বড় অংশের মানুষ, যাঁদের কেউ কেউ বামপন্থী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ সেভাবে কোনও রাজনৈতিক দলেরই নন। তারপর, স্পেন থেকে পালিয়ে পৃথিবীর উল্টো প্রান্তের একটি দেশে গিয়ে মানুষগুলোর মানিয়ে নেওয়া।
ইসাবেল আলেন্দে একটি পরিবারের দৈনন্দিন জীবন, আবেগ, ভালোবাসা, সম্পর্কের ভাঙাগড়ার গল্পের মধ্যে দিয়েই পুরোটা ধরেছেন।
চিলি-তে সালভাদর আলেন্দের রাজনৈতিক জীবন – ভোটে জিতেও প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন কিনা, সেই অনিশ্চয়তা – শেষমেশ প্রেসিডেন্ট হওয়া – সে নিয়ে দক্ষিণপন্থী ও উচ্চবিত্তদের ক্ষোভ – আর আলেন্দের মর্মান্তিক পরিণতি – পিনোচেত-এর শাসন – অত্যাচার, রাজনৈতিক হত্যা… গল্পের কেন্দ্রে যে পরিবার, তাঁদের ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে যাওয়া… শেষে আবারও ফিরে আসা, চিলি-তেই…
প্রেম-ভালোবাসা-সম্পর্কেরই গল্প। অথচ কী বিপুল এক রাজনৈতিক পালাবদলকে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করেছেন ইসাবেল!!
আর গল্পের একটা বড় অংশ জুড়েই আবহে রয়েছেন নেরুদা। প্রতি অধ্যায় শুরু হয়েছে তাঁর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে, চরিত্র হিসেবেও তিনি কাহিনির মধ্যে এসেছেন – একাধিকবার। এ বই পড়লে বোঝা যায়, তাঁর দেশে – বা তাঁর মহাদেশে – পাবলো নেরুদা কেন শুধুই কবি নন, তার চাইতে অনেক বড় কিছু। নাকি, কবিদের এমনই হওয়ার কথা ছিল!!
গল্পের কেন্দ্রে যিনি, সেই ভিক্টর পেশায় ডাক্তার। ডাক্তারদেরও হয়ত এরকমই হওয়ার কথা ছিল।
না, এটা বইয়ের রিভিউ নয়। পাঠপ্রতিক্রিয়াও নয়। এ বইয়ের লিখনভঙ্গী যাকে বলে ডিসেপটিভলি সিম্পল। আর কাহিনির বিস্তার অভাবনীয়। স্রেফ সেই মুগ্ধতা ও আচ্ছন্ন হয়ে থাকার অনুভূতিটা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম, এটুকুই।