একটুখানি ঘেরা জায়গা, সামনের দিকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি গেটের দুই পাশে দু’টি কদম এবং পেছনে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। আর গেটটা ছেয়ে আছে ফুটন্ত মাধবীলতার ঝাড়ে। মাটির দেওয়াল আর টালির চালের একঘরের বৈকুন্ঠপুর পোস্ট অফিস। কালো রং করা কাঠের অনুচ্চ দরোজা আর সেই দরোজার পাশে একটা লাল লম্বাটে টিনের বাক্স ঝোলানো। একটা ছয় সংখ্যার নম্বর লেখা, সেটা পিন কোড।
সমরবাবু খালি গায়ে খুপরি জানালার কাছে বসে একটা তালপাতার হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন। ছ’টা চিঠি যাবে, সেগুলোয় ছাপ মেরে নাম্বার ফেলে বসে আছেন। এক জন দুটো অল্প দামের স্ট্যাম্প নিতে এসেছিল, তারা চলে গেছে। এখন জায়গাটা ফাঁকা। অবশ্য ফাঁকাই থাকে বেশির ভাগ সময়।
গতকালের খবরের কাগজটা পড়েছিল টেবিলে। সমরবাবু টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। এটা গত কালের কাগজ, তবে সত্যি সত্যি গতকালও নয় এটা শহরে মুখ দেখিয়েছে পরশু দিন। কাল হেড অফিস থেকে ডাক আনার সময় ননীগোপাল এনে দিয়েছে। ননীগোপাল এই পোষ্ট অফিসের রানার বা ডাকহরকরা। সে ডাক বিলিও করে। টেলিগ্রামও পৌঁছে দেয়। অবশ্য গত পনের বছরে একবার মাত্র টেলিগ্রামের তার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দরকার পড়েছিল। সেটেলমেন্টের কাজে আসা বড়বাবুর মা গত হয়েছিলেন তার দুঃসংবাদটা ওই টেলিগ্রামে এসেছিল ।
সময় বাবু বিজ্ঞাপনের পাতাটা দেখছিলেন। বার বার দেখেন। বোরোলীন, বাটার জুতো, লিলি বিস্কুট, টসের চা, কুন্তলীন মাথার তৈল এগুলো তার চেনা বিজ্ঞাপন। আর এগুলো দেখতে তিনি ভালোও বাসেন।
অনেক কাল আগে তিনি শিয়ালদহের কাছে একটা মেসে থাকতেন। ছিলেন বছর দু’য়েক। তাই এইসব বিজ্ঞাপনের ঠিকানা গুলোর অনেকগুলো তাঁর চেনা চেনা ঠেকে।
সে সময় পায়ে হেঁটে কলেজ স্কোয়ারের কাছে কলুটোলায় ক্লাস করতে যেতেন। সে কি আর আজকের কথা। তিনি পাশ করেছিলেন। ভালো ভাবেই শেষ করেছিলেন স্নাতকোত্তর পাঠক্রম । শেষ করে বাড়ি ফিরেছিলেন। আশা ছিল আবার ফিরে যাবেন।
তখন বাবার কাঁধে সংসার। বাবার ইচ্ছায় ও মায়ের অসুস্থতার কারণে আর ফিরে যাওয়া হয়নি মহাশহরে। বন্ধুবান্ধবরা চিঠিতে খোঁজ খবর করত। কেউ কেউ চাকরির সুখবর দিত।
এভাবেই চলছিল সব।
সমরবাবু পাশের গ্রাম রেবতীপুরের আদি বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই বৈকুন্ঠপুর পোষ্ট অফিতে তিনি আসতেন। তখন এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলো না। বুড়ো কালীপ্রসন্ন ভাদুড়ি মশাই পোস্ট মাষ্টার ছিলেন। চোখে ছানি পড়াতে ভাল দেখতে পেতেন না। তাকে চিনতেন। তাই চিঠি আনতে গেলে বলতেন, – বাবু তোমার চিঠি আছে কিনা দেখে নাও। আর চেনা জানা কারো থাকলে নিয়ে যাও, দিয়ে দিও।
সে কাজও অনেকবার করেছেন। শুধু চিঠি নিয়ে গেলে তো হল না পড়ে দিয়ে আসতে হত। তখনও ননীগোপাল কাজে যোগদান করেনি। ছোট নারায়নপুরের পূর্ণ দলুই চিঠি লিখেছিল । সে থাকত রানীগঞ্জে। কয়লা খাদানে খালাসির কাজ করত। মাকে লেখা দু’ লাইনের পোস্ট কার্ড।
‘মা আমি আসব সামনের মাসে দশ তারিখে। মানে এখনও একমাস বাকি। তুমি কষ্ট করে চালিয়ে নাও।’
ভাদুড়িবাবুর কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে তাঁর নতুন সাইকেল বেয়ে দলুই বাড়িতে গিয়ে, ‘মাসি মাসি তোমার চিঠি’, বলতে বলতে দেখেন দরজা খুলে পূর্ণ নিজেই হাজির চিঠি নিতে । আর তারপর দুজনের কি হাসি।
তবু চিঠি পৌঁছায়। দেরি হলেও আসে। আবার যায় ও ।
ছয় বিঘা চাষের জমি আর হালের গরু, একটা টিনের চালা তিন কামরার পাকা দেওয়ালের বাড়ি-ঘর।
বাবা বলত, গাজনতলার স্কুলে একটা মাষ্টার নেবে, ব্লকে ধরাধরি করলে হয়ে যাবে।
এম এ পাশ করে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা?
সমরবাবু ধরাধরি মধ্যে যান নি। আর চাকরিটাও তার হয় নি। অল্প চাষ বাসে সংসার চলে যায়। আর বিজ্ঞাপন দেখে প্রথম প্রথম বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দেন। কিছু কিছু জায়গায় ইন্টারভিউতেও ডাক পান। তবে বাবা চান ছেলে গাঁয়ের আশে পাশে থাকুক। সব দেখাশুনা করুক।
মা আর শারীরিক ভাবে তেমন সুস্থ হয়ে ওঠেন নি।
একদিন এই চাকরিটার চিঠি আসে। ছোট পদের চাকরি তবে সরকারি আর পাশের গাঁয়ে পোস্টিং।
ঐ এল, ননীগোপাল ঘর্মাক্ত হয়ে ঘরে ঢুকল । গুটি কয়েক চিঠি মাত্র এসেছে। শিক্ষিত লোকই বা এই অঞ্চলে কয়জন আছে যে তারা হামেশা চিঠি চাপাটি চালা চালি করবে? এখানে খাম ইনল্যান্ড চিঠি বিক্রি বিশেষ হয় না, শুধু পোষ্টকার্ড। তাও মাসের বিক্রি বাটা নিতান্তই নগণ্য।
ননীগোপাল বললে, – কাল ওখানে ঝড় হয়েছিল। দু ‘ এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েছিল। আজ এদিকে হতে পারে।
বুড়ি পুঁটিমাসি, সৃষ্টিধর কয়ালের মা এসে একবার করে পোষ্ট অফিসের ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়। জল পাল্টে দেয় কুঁজোতে। দুটো পুরোনো আদ্যিকালের কাঠের টেবিল, দুটো নড়বড়ে চেয়ার একটা রঙ চটা স্টিলের আলমারি। সেগুলোও রোজ একবার করে ধূলো ঝেড়ে দেয়। গ্রামীণ পোস্ট অফিস, সব জায়গাতে এরই রকম ফের ।
সমরবাবুর বাবা প্রায়শঃই আক্ষেপ করেন। ছেলেটা কলেজে পড়াতে চাইত, আর দু এক বছর লেগে থাকলে হয়ত হয়ে যেত। হয়ত কেন ঠিকই হয়ে যেত। ওর এক বন্ধু শৈবাল, শৈবাল দত্ত ওর সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, সে এখন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক। সমরই তাকে বলেছে। প্রফেসারি না হলেও অন্য সরকারি চাকরি তো হতই।
সংসারের দেখ ভাল করতে হবে বলে এই অজ গাঁয়ের প্রান্তিক পোষ্ট অফিসের মাস্টার মশাই হিসেবে এত বছর কাটিয়ে দিল ছেলেটা ।
তবে হ্যাঁ, বৌমা বেশ বুদ্ধিমতী, ছেলেকে সদর শহরে মিশনের আবাসিক বিদ্যালয়ে রেখে পড়িয়ে এসেছে। এবার সে স্কুল স্তরের পরীক্ষা শেষ করবে।
এই বৈকুন্ঠপুর পোস্ট অফিস থেকে সমরবাবুর বাড়ি সাইকেলে মাত্র বিশ মিনিটের দূরত্বে। দুপুরে তিনি বাড়িতে গিয়েই মধ্যাহ্নভোজন সেরে আসেন। সেই সময়টুকু অফিস সামলায় ননীগোপাল।
পোস্ট অফিস তাঁর জীবনের ছন্দ অনেকটাই বদলে দিয়েছে। এখন সমরবাবু অনেকটা কুঁড়ে হয়ে গেছেন। এক সময়ে ফুটবল মাঠে রক্ষণাত্বক খেলায় তাঁর নাম ডাক ছিল। গ্রামের বাজারের কাছে একটা গ্রামীণ পাঠাগার আছে। এখন তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের বইপত্র সেখান থেকে নিয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রী মোহিনীও বই পড়তে ভাল বাসে । তাঁদের বাড়ির একটা ঘরে কাঠের আলমারিতে বেশ কয়েকটি গল্পের বইও আছে।
ননীগোপাল চিঠির ব্যাগটা টেবিলে রেখে একগ্লাস জল গড়িয়ে নিল কুঁজো থেকে। – দাদা আপনি খেয়ে আসুন, আমিও একটু জিরিয়ে নিই। এসে ছাপ মারবেন ।
– না রে ননী, কাজটা সেরেই যাই। এসে গল্পের বইটা শেষ করব। আজ সন্ধ্যা বেলা জমা দিতে হবে।
– দাদা আপনার নাটকের রিহার্সালের কি খবর?
– ও তো সেই পুজোর সময় নামবে। দেরি আছে।
লম্বা কাঠের হাতলের নীচে পিতলে অক্ষর খোদাই করা স্ট্যাম্পগুলোর একটা নিয়ে ভুসোকালির স্ট্যাম্প প্যাডে একটা জোর ঠোকা দিয়ে তিনি কালি মাখিয়ে কাজ শুরু করেন। আজও তাই করলেন।
তৃতীয় খামটাতে এসে তার চোখ আটকে গেল। – সমর ব্যানার্জি, কেয়ার অফ মধুসূদন ব্যানার্জি। গ্রাম – রেবতীপুর ও পোস্ট অফিস- বৈকুন্ঠপুর। একটু বাঁকাচোরা লেখা। লাইন বেঁকে গেছে। চিঠিটা অবশ্যই তাঁকে লেখা। খামের বামদিকে প্রেরকের ঠিকানা, তবে সংক্ষিপ্ত। অমিত মল্লিক। বউবাজার, কলকাতা।
বউবাজারের অমিত মল্লিককে সহজে মনে করতে পারলেন সমর বাবু। হ্যাঁ, অমিত মল্লিক তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করত তার বাড়িতে একবার দল বেঁধে সবাই গেছিলেন। তার বোধহয় জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল ।আরপুলি লেনের ভিতরে। সেটার ঠিকানা কি বউ বাজার? মনে পড়ছে পুরোন আমলের দোতলা বনেদি বাড়ি। অনেক ঘর বারান্দা নিয়ে এবং লোকজন নিয়ে বড় সংসার। শুনেছিলেন তাদের সোনার দোকান আছে বিনোদ বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের কোথাও।
‘প্রিয় সমর,
তোর একটা বই ছিল আমার কাছে। একটা কবিতার বই। হয়ত তোর মনে নেই । আমারও মনে ছিল না। অনেকদিন পর ঘর গোছাতে গিয়ে তোর বইটা পেলাম। আর তোর ঠিকানাটা ও। মনে হল তুই আর তোরা সবাই একদিন জন্মদিনে আমাদের বাড়িতে এসেছিলি। অবশ্য বইটা সেই সূত্রে পাওয়া নয়। তুই একদিন সপরিবারে আমার বাড়িতে আয়।
আমি লিখে দিচ্ছি কিভাবে আসতে হবে। তখন বইটার ব্যাপারে কথা হবে।
-ইতি,
অমিত।’
তিনি পুরোটা পড়ে ফেললেন এবং রহস্য কিছু উদ্ধার করতে পারলেন না। চিঠিটা শার্টের বুক পকেটে নিয়ে সাইকেল চড়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বারান্দায় বসে খেতে খেতে কথা বলছিলেন মোহিনীর সাথে। সংসারের ছোট ছোট কথা। ছেলের পড়ার খবর, মায়ের শরীর কেমন আছে তার খবর। আজ হাটবার তাই সেখান থেকে কি কি কিনতে হবে তার আলোচনাও হচ্ছিল ।
– জানো মোহিনী আজ একটা মজার চিঠি এসেছে, আমার নামে?
– কোন সরকারি চিঠি ?
– না গো আমার এক বন্ধু , ইউনিভারসিটিতে এক সাথে পড়ত । অমিত মল্লিক। সে চিঠি লিখেছে। তোমাকে পরে দেখাচ্ছি।
– হঠাৎ, তিনি চিঠি দিলেন?
– ও, আমাদেরকে নেমন্তন্ন করেছে। ওর বাড়িতে। কলকাতার বউবাজারে।
– সে তো অনেক দূর।
– কি যে বল ! সে কি আর এমন দূর! একটা সময় তো মাসে এক দুবার যাতায়াত করতাম।
– সে তো কলেজ জীবনে।
– কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়।
– ঠিক। আমার মুখে তো ওটাই চলে আসে।
– আঃ সে কি সব দিন! ট্রামে করে ঘুরে বেড়ান , মাঝে মাঝে কলেজ স্ট্রিট অবরোধ করে মিছিল স্লোগান।
– কতদিন কলকাতা যাওয়া হয় না। সেই বিয়ের পর একবার আমার মাসতুতো দাদার বাড়ি বেহালায় গেছিলাম। আর তো যাওয়া হয়নি।
– যাবে একদিন? অমিত তো সপরিবারে যেতে বলেছে।
– বাবা মাকে বলে নিও তুমি।
– আমি ননীকে বলব একটা দিন সামলে নিতে। ছুটি নিয়েই যাব ।
সমরবাবু বেশ উত্তেজনা বোধ করলেন। একটা তারিখ ও ঠিক করে ফেললেন। ভোরে ভোরে বেরিয়ে যাবেন দুজনে। আবার রাতের মধ্যে ফিরে আসবেন।
প্রথম বিয়ের পরে পরে তারা একেবারেই যে বেরোতে পারেননি দুজনে তেমন নয়। তবে অসুস্থ মা এবং এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তাঁর চাকরি এবং কর্মস্থলের কর্মী বিন্যাস এমনই যে অফিস ফাঁকা রেখে যাওয়া মানে প্রকারান্তরে সেটাকে বন্ধ করেই রাখা। এখন পোস্ট অফিসে সাহায্যকারি ননীগোপাল এসেছে যে একটু সামলে নিতে পারে।
তারা কলকাতায় যাবেন এই মর্মে একটা একটা চিঠি ডাকে দেয়া হলো অমিতের বউবাজারের ঠিকানায়। সম্ভাব্য তারিখ ও দেয়া হলো।
বাড়ির নিকটতম ট্রেন স্টেশন খুব বেশি দূরে নয়। চার পাঁচ মাইল মাত্র। স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠতে পারলে সোজা পৌঁছে দেবে শিয়ালদহ। চার ঘন্টার ট্রেন জার্নি। একটা তিন চাকার ভ্যানওয়ালাকে বলে রেখেছিলেন সমরবাবু। বিশ্বাসযোগ্য তরুন ছেলে। সে সময়ে স্টেশনে নামিয়ে দিল।
ডাউন লালগোলা ফাস্ট পয়াসেঞ্জারে জানালার ধারে মোহিনীকে বসিয়ে নিজেও পাশে একটা সিট পেয়ে গেলেন সমরবাবু। তার কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো। কলেজ নয় ইউনিভার্সিটির জীবন।
মা কৌটো ভর্তি করে নাড়ু মুড়কি দিয়ে দিতেন। ছেলে খাবে বলে। বারণ করলেও শুনতেন না। মেসের পাশের ঘরে থাকতো অপরেশ জানা বলে গোয়েঙ্কা কলেজের একটা ছেলে। তার বাড়ি থেকে হরেক রকম ভাজা নিমকি আসতো, মোয়া আসত আবার কখনও সখনও মিষ্টিও আসতো। সবাই ভাগ করে খেতেন আর কম্পিটিশন করে রাত জেগে পড়াশুনা হত ।
কবিরুল ভালো কবিতা লিখত আর বিনয় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করত কলেজের গেটে। সে ছিল ছাত্র সংসদের নেতা। একবার পুলিশের লাঠিতে তার মাথা ফেটেছিল, হাজতেও গেছিল। তবে বিনয় ভয়ে পিছিয়ে যায় নি। বীরবিক্রমে সে পুলিশ হেফাজত থেকে ফিরে আবার তুখোড় বক্তব্য রেখেছিল ।
তারা সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা বার করত তাদের ব্যাচ থেকে। আর খুব হৈচৈ করে সরস্বতী পুজো করত । সমরবাবুর লেখা ছাপা হত মাঝে মাঝে। এর সাথে তিনি একটু আধটু গাইতে পারতেন বলে সবাই তাকে একটু বেশি খাতির যত্ন করত ।
– কি গো টিকিটটা দেখাও।
অপ্রস্তুত হয়ে সম্বিত ফিরে সমরবাবু দেখলেন কালো কোট পরা টিকিট কালেক্টর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুকপকেট থেকে টিকিট দুটো বার করে দেখালেন ও পাঞ্চ করিয়ে নিলেন।
– ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল, তখন তো এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ অন্তর যাতায়াত করতাম।
– সেটা কি খুব ছোটবেলা ছিল ?
– তা ঠিক নয়। তবে এখনকার তুলনায় অনেকটা ছোট।
– তাই বল, তুমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ের কথা বলছ?
– সে তো কতকাল আগেকার কথা, তবু মনে হয় এই তো সেদিন। দেখতে দেখতে বাবুরও তো কলকাতায় যাওয়ার সময় হয়ে এল ।
– সব কিছু ঠিকঠাক মতো হলে তো তা-ই হওয়ার কথা।
ট্রেন ছুটতে থাকল একের পর এক স্টেশন ছুঁয়ে। এক একটা স্টেশন আসে আর চলে যায়। লোকজন নামে কম ওঠে বেশি। মাঝে মাঝে হকাররা হেঁকে যায়। বাদাম ভাজা, ঝালমুড়ি। আয়ুর্বেদিক ওষুধ, চুলের ফিতে মাথার কাঁটা। কত জনপদ পেরিয়ে লোকজন নামা ওঠা করিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্য স্টেশন শিয়ালদহ এসে পৌঁছল ।
নেমে একটু অবাকই হলেন সমরবাবু। কেমন মনে হল অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে শহরটার। লোকজন আরো বেড়ে গেছে। হৈ হট্টগোল অনেক বেশি মনে হচ্ছে।
মোহিনীর খুব মজা লাগল। এমন নয় যে তারা এই প্রথম একসাথে কলকাতায় এল। বিয়ের পরের বছরই একবার মাসতুতো দাদর বিয়েতে দু’জনে এসেছিল। তবে তারপর আর বিশেষ আসা হয় নি। শাশুড়ির শরীর খারাপ, খোকার জন্ম, স্বামীর পোস্ট অফিসের কাজ বেড়ে যাওয়া এবং কর্মী কমে যাওয়া। নানা কারণে পনের ষোল বছর আর এদিকে আসা হয়নি।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে মোহিনীর একটা হাত ধরে নিলেন সমরবাবু। জেলা শহরাঞ্চলের মেয়ে হলেও মোহিনী একা বিশেষ বড় শহরে হাঁটাচলা করেননি।
অমিতের চিঠিতে একটা ফোন নম্বর দেয়া ছিল । তাঁরা যে শিয়ালদহে পৌঁছে গেছেন সেটা জানান উচিৎ অমিতকে । তাঁরা আসবেন কলকাতায়, সেটা আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন সমরবাবু । টেলিফোন করার জন্য একটা দোকানদারকে অনুরোধ করলেন। দোকানদার ফোন নম্বরটা এক দুবার ডায়াল ঘুরিয়ে মোটা ভারি কালো রঙের রিসিভারটা সমরবাবুকে ধরিয়ে দিলেন, – কথা বলুন।
– হ্যালো আমি সমর ব্যানার্জি বলছি। মানে সমর..।
ওপার থেকে কিছু বোধ হয় উত্তর এলো। সমরবাবু বললেন, – আচ্ছা আচ্ছা, দাঁড়া লিখে নিই। ঠিক আছে বউবাজার স্ট্রিট ধরে গেলে সুবিধা হবে, তাই তো। ঠিক ঠিক। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তো। আচ্ছা আচ্ছা।
মোহিনীর অস্বস্তি হচ্ছে একটু। স্বামীর বন্ধুর বাড়ি, সেভাবে আত্মীয়তা তো কিছু নেই। তাদের পরিবারে কে কে আছে তাই বা কে জানে?
এক পা এক পা করে কিছুটা পথ যাওয়ার পরে সমরবাবুর জায়গাটা আর অচেনা মনে হচ্ছে না। কম বেশি পাল্টে গেছে ঠিকই তবে আমূল বদলে যায়নি।
– খালি হাতে যাবে?
– ঠিক বলেছো মোহিনী, আমার মাথায় ছিল না। আমরাও একটু কিছু খেয়েনি সেই সকালে না খেয়ে বেরোন। পথে প্রায় কিছু খাওয়াই হয়নি।
ঠিকানা ধরে ধরে এগোতে এগোতে গলির পরে গলি পেরিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে একটা দরজার সামনে এসে পৌঁছলেন তারা। উঁচু পাঁচিল দেয়া এবং সবুজ রং করা আদ্যি কালের কাঠের দরজা। এই দরজাটা তাঁর চেনা ঠেকল । একবার দল বেঁধে এসেছিলেন। কড়া নাড়লেন সমরবাবু।
খুব বেশি সময় লাগল না একজন লোক এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন।
– সমরবাবু?
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা শিয়ালদহ হয়ে আসছি।
– চলুন চলুন বাবু ওপরে অপেক্ষা করছেন।
দোতলা উঠে দরজা দিয়ে একটা ঘরে ঢুকে তাঁরা একটু অবাক চোখে দেখলেন বিশাল বড় একটা ঘর জানালাগুলোয় ভারি পর্দা। উজ্জ্বল টিউব লাইটের আলো। ঘরের মাঝে একটা সোফা এবং তার নিকটে একটা নিচু কাঁচের টেবিল । একজন মধ্য বয়স্ক লোক বসে আছেন।
এই সেই অমিত, যে ফুটবল মাঠে অনায়াসে বিপক্ষের গোলকিপারকে তছনছ করে দিয়ে টিম কে চ্যাম্পিয়ন করত। তাঁরা পেছনে থেকে মাঠের ডিফেন্স করতেন। অমিত একটা হুইল চেয়ারে বসে আছে। ডান হাতে একটা কারুকাজ করা কাঠের শৌখিন লাঠি। তবে বাম হাতটা একটু যেন ঝুলে আছে। শৌখিন পাঞ্জাবি গায়ে, গলায় মোটা সোনার চেন এবং লাঠি ধরা হাতটার সবকটা আঙুলে রঙবেরঙের পাথর লাগান আংটি। গোল্ড ফ্রেমের চশমা পরিহিত।
মোহিনী ঘোমটা টেনে স্বামীর পিছন পিছন ঢুকলেন। তিনি সচরাচর ঘোমটা টানেন না। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েন নি তাই কি করা উচিৎ না বুঝেই সেটা করেছেন।
– আয় সমর। এ বোধহয় মোহিনী তুই চিঠিতে লিখেছিলি?
– ঠিক ধরেছিস। ওকে বললাম চল , দুজনে মিলেই ঘুরে আসি।
– বসো মোহিনী। সারা পথ বোধহয় কষ্ট হলো, অনেকটা দূর। তোমাদের জন্য চা বলেছি। পাখাটা কি জোরে চালাতে বলব ?
– না দাদা ঠিক আছে। মোহিনী বলল ।
বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা এবং অভিজাত বেশভূষায় সজ্জিত একজন মানুষ। বনেদিয়ানার আরো প্রকাশ তার বসতবাটি এবং আতিথেয়তা। বাড়ির একজন কাজের লোক ছাড়া আর কারো সাথে এখনও অবধি পরিচয় হয়নি। তাই পরিবার সম্বন্ধে কোন মন্তব্য এখনই করা যায় না।
চায়ের ট্রে এবং সঙ্গে শুকনো কিছু খাবার নিয়ে একজন মহিলা ঘরে এল। সবগুলো প্লেট নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ।
– অমিত?
– বল সমর? জানতে চাইছিস কবে হল ?
– যদি বলতে কোন বাধা না থাকে।
– তুই আমার খুব কাছাকাছি ছিলি এমন বন্ধুদের একজন। আবার খেলার মাঠের সহ খেলোয়াড় ছিলি । লোকে বলতো মানিকজোড়।
তারপর মোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, – জানো মোহিনী ওর বাড়ান বলে আমি ইউনিভার্সিটির হয়ে অনেক গোল করেছি এবং টিমকে চ্যাম্পিয়ন করেছি।
ও বরাবরই একটু চুপচাপ। তুমিও হয়ত ওকে পুরোটা এক্সপ্লোর করতে পারোনি এতোদিনে।
– দাদা, সেভাবে জানার সুযোগই থাকে কোথায়, সংসার করতে করতে। যেখানে আমাদের একটা যৌথ পরিবার। মা বাবার বয়স হয়েছে এবং তাদের একজন অসুস্থ। তার সাথে বাচ্চা মানুষ করা।
– ঠিকই তো। আবার সমর সরকারি চাকরি করে। সেখানে অনেক সময় দিতে হয়। ও যে ওখানে পোস্ট অফিসে আছে জানতাম না। ওর চিঠিতে জেনেছি। ভেবেছিলাম কোন কলেজে পড়ায়। ও তাই করবে, বলত ।
– ও সব ছাড়, তোর কথা বল। সমরবাবু প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।
– আমার একটা ছোটখাটো স্ট্রোক হয় দু’বছর আগে। বলতে পারিস এটা আমাদের পরিবারের ট্রাডিশন। বংশে অনেকের হয়েছে। বাবারও হয়েছিল তবে অঙ্গহানি হয়নি। ঠাকুরদাদা শেষ কয়েক বছর ছিলেন শয্যাশায়ী। বাবার একমাত্র ছেলে আমি। অবশ্য এক দিদি আছে। সে এখনও বহাল তবিয়তে। আমার ছেলের বয়স উনিশ বছর, ও এখন আমাদের জুয়েলার্সের ব্যবসা সামলায়। তিনটে দোকান আছে বউবাজারের আশেপাশে। আর আমি জড়িয়ে পড়েছি কোর্ট কাছারির জটিল জালে।
– তুই তো একা ছেলে, বললি ?
– তা ঠিক, তবে আমার দিদি এই বাড়ি এবং সম্পত্তির ভাগ চায়। পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারের হক যে শুধু পুত্র সন্তানের এই ধারনাকে নস্যাৎ করে সে হাইকোর্টে লড়ছে।
– তাঁর তো সংসার আছে ?
– কেন থাকবে না। বারাসাতে সিংহ জুয়েলার্স তো তাদের। বাবা বিয়ের সময় মেয়েকে বানিয়ে দিয়েছিলেন।
সিংহ জুয়েলার্সের কথাটা মোহিনীর কানে লাগল। বারাসাতে তার এক মাসতুতো দিদির বাড়ি। এক দুবার গেছেন সেখানে। একি কাকতালীয় ?
একবার অমিতের দিকে তাকাল মোহিনী ।
চশমা পরা তবু মনে হলো বাম চোখের পাতা একটু একটু ঝুলে আছে এবং মুখের কোণটা ডানদিকে টানা। স্ট্রোকের অভিঘাতে হয়ত । তিনি কি মোহিনীকে দেখছিলেন। একটু অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার।
সেটা কাটানোর জন্য বললেন, – বৌদি বাড়িতে আছে ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বললেন। – আমার স্ত্রী দয়িতা তার নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে বাপের বাড়িতে নয়। একেবারে তার নিজস্ব বাড়ি। সব মায়া কাটিয়ে গত দুর্গা পূজার দশমীতে সে চির বিদায় নিয়েছে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে।
ঘরের আবহাওয়া কেমন যেন থম থমে হয়ে গেল ।
সমীরবাবু নড়েচড়ে বসলেন।
– তুই একা?
– বলতে পারিস একা, তবে একেবারে একা নই। রাজ্যের জটিল অসুখ বিসুখ আর আইনি টানাপোড়েনে আমি পরিবেষ্টিত। আমাদের বাড়িতে এক মাসি থাকেন, নিজের নন, তবে আমাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিলেন। তাঁর সাথে আলাপ করিয়ে দেব।
অপেক্ষা না করে কাছাকাছি একটা সুইচবোর্ড অবধি হুইল চেয়ারটাকে ঠেলে নিয়ে তিনি দরজার বাইরের বেলটা বাজালেন।
– কমলা দেখত মাসি কি করছে? এই বৌদিকে একটু ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাসির সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। বল, দাদার বন্ধুর স্ত্রী, উনি বুঝে যাবেন।
উঠে দাঁড়িয়ে আর একবার অমিতবাবুর দিকে তাকাল মোহিনী। এবারও কি তার ভুল। কেন তার মনে হচ্ছে অমিতবাবু তাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন।
কমলার সাথে পা বাড়ালেন অন্দরে যাওয়ার জন্য।
এতক্ষণে দুই বন্ধু কথা বলার মতো একা হয়ে নিজেদের মধ্যে পুরোন দিনের গল্প শুরু করলেন। কিছুটা কথা-বার্তা এগোনর পর, অমিত বললেন, – তোকে একটা জিনিস দেখাব। যদি চিনতে পারিস?
একটা টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার মধ্যে থেকে একটা বই বার করলেন অমিত। একটু পাতলা গঠনের মলাট দেয়া বই। বাদামি রংয়ের মলাটটা প্রায় রং বদলে গেছে।
ভিতরের মলাটের পরের পাতায় ছাপা
‘ ফিরে এসো চাকা’, বিনয় মজুমদার
তার নীচে ফাঁকা অংশে হাতে লেখা।
‘ মম হৃদয়ে রবে
চিরদিনের তরে
তব আসন ‘
কোন সাক্ষর নেই। অবশ্য তা থাকার কোন দরকার নেই।
বই এবং হাতের লেখার মালিককে সমরবাবু অবশ্যই চেনেন।
– দয়িতা। দয়িতা সেন। মনে পড়ছে? অমিত জিজ্ঞেস করল।
এই মনে পড়াটা আনন্দের না বিষাদের তা বুঝতে পারছেন না সমর বাবু। ভাগ্যিস মোহিনী এখানে উপস্থিত নেই। হয়ত সে কারণেই অমিত তাকে এ ঘর থেকে কৌশলে অন্য দিকে পাঠিয়েছে।
– আমার ঘরে চল। তোকে আর একটা জিনিস দেখাব। সমরবাবু বুঝতে পারছেন না আর কি অমিত দেখাতে চাইছে।
তারুণ্যের চঞ্চলতায় এক শহরবাসিনী ভক্ত ক্লাসমেটকে উপহার দেয়া এই সাহিত্য প্রেমীর পছন্দের কাব্য গ্রন্থ। কিন্তু এখানে এলো কি করে? অমিতের কাছে? দয়িতা তো ভবানীপুরের বাসিন্দা ছিল, নিখুঁত মনে পড়ে।
চৌকাঠ পেরোনোর দরকার হল না। হুইল চেয়ার ঠেলে অন্য একটা ঘরের মধ্যে নিজেই গড়িয়ে নিয়ে এল অমিত। সমরের দিকে তাকিয়ে বলল, – আর একটু অবাক করি। ঐ দেওয়ালের দিকে তাকা।
সমরবাবু তাকালেন। তার হৃদস্পন্দন ত্বরান্বিত হল ।
– দয়িতার ছবি, এখানে? মানে?
– চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে নিজের দেশে চলে গেছে। খুবই অসুস্থ ছিল। সবার কথা বলত। আর বার বার করে বলত, সমর কোথায় খুঁজে দেখ, ওকে একটা জিনিস দেব। চেষ্টা করিনি তা নয়। কাছাকাছি যারা থাকে ফোনে যোগাযোগ আছে তেমন কেউ তোর হদিস দিতে পারে নি। ও খুব চাইত একবার তোর সাথে দেখা করতে।
আমাকে আর ছেলেকে খুব আগলে রাখত। পাগলের মতো ভালোবাসত। তবুও তোর খোঁজ করত মাঝে মাঝে। যখন বেলভিউ নার্সিং হোমে শেষবারের মতো ভর্তি হল ডাক্তার বাবু বললেন শুধু সময়ের অপেক্ষা আমিও তো তখন সম্পূর্ণ সুস্থ নই।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত আমি হুইল চেয়ারে করেই রোজ দেখা করতে যেতাম। একদিন শেষের দিকে এক বিকেলে নার্সিং হোমের জানালা দিয়ে মিন্টো পার্কের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল।
– আমার লকারে একটা প্যাকেট পাবে ওটা সমরকে ফিরিয়ে দিও। যদি খুঁজে পাও।
সেটাই তার সাথে আমার শেষ বাক্যালাপ । সেই দিন গভীর রাতে নার্সিং হোম থেকে ফোন আসে। সে আর নেই। মানসিক ভাবে প্রস্তুতি ছিল। আমি খুব ভেঙে পড়িনি। কিন্তু ছেলে মা অন্ত প্রাণ। তাকে সামলাতে আমাকে হিম সিম খেতে হয়েছে।
– তারপর?
– শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেলে খুব অস্থির সময়ে আবার তোর কথা মনে পড়ল এবং মনে এল দয়িতার শেষ দিনের কথাবার্তা। ওর নিজস্ব আলমারি ছিল জানতাম কিন্তু এত বছরের দাম্পত্যে সেটা কখনও খোলার প্রয়োজন হয়নি।
রহস্য উন্মোচনের জন্য ওর আলমারির লকারটা খুললাম।
কিছু গয়নার বাক্সের নীচে একটা প্যাকেট পেলাম। একটা পাতলা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে কাগজে মোড়া একটা বই। সেই বইটাই তোকে দেখালাম। কলেজ স্ট্রীট থেকে তুই কিনেছিলি মনে আছে। কোন কারণে ম্যাচ প্র্যাকটিসের শেষে আমি তোর সঙ্গে ছিলাম সেদিন।
– তোর কিছু মনে হয়নি, বইটা ওখানে পেয়ে?
– মনে মনে হেসেছিলাম। সেই মাঠের খেলার মত। অনেকবারের মতো বলটা তুই তৈরি করে দিতিস আর গোলটা আমি দিতাম, এটা ভেবে।
– আর ঠিকানা?
অমিতের ডান হাতটা হুইল চেয়ারে ঠেকানো। তার অর্ধক্ষম হাতটা একটু চেষ্টা করল তার পরে থাকা পাঞ্জাবির পকেটের দিকে প্রবেশ করতে কিন্তু পারল না। নিজেই বললো, – এদিকে আয় এই পকেটে হাত দে।
– তুমি মোহিনী। এস মা এস। ছেলে আমাকে বলে রেখেছে। ‘মা তুমি ওর খেয়াল রেখ’।
– আপনি কি করে জানলেন আমি মোহিনী?
– ছেলে সব কথা আমাকে বলে। ও যখন দুই বছরের ওর মা টাইফয়েডে মারা যায়। ও আমার কোলে পিঠেই মানুষ।
বৌমা এলেও সে আমাকে ঘিরেই থাকত। তবে হ্যাঁ আমার বৌমা এতো বড়লোকের শহুরে মেয়ে হয়েও বড্ড সংসার অন্ত মেয়ে ছিল।
– উনি খুব একা হয়ে গেছেন।
– সেটাই স্বাভাবিক। সে অনেক কথা মা। তোমার শুনতে আপত্তি না থাকলে বলি। আমার জামাইবাবু মানে সমরের বাবা যখন প্রথম কথা বলে পাত্রী সম্বন্ধে আমি আপত্তি করেছিলাম। সমবয়স্ক বিবাহে আমার মতো প্রাচীনপন্থী মানুষের একটু বাধো বাধো ছিল। মা তুমি এই চেয়ারটায় বস। আমি রান্নাটা করতে করতে তোমার সাথে কথা বলি। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওর রান্নাটা আমিই করি।
– আমরা এসে কাজ বাড়িয়ে দিলাম।
– এ বাড়িতে কি কাজের লোকের অভাব? শুধু ওর টুকুই আমি করি। আজ বৌমা থাকলে কি আর আমাকে এটা সামলাতে হত? ওরা তো এক সঙ্গে পড়ত । হঠাৎ একদিন ওর বাবা আমাকে বলে মেয়েটার কথা। ভবানীপুরের এক উকিলের মেয়ে।
– শেষ অবধি ওখানেই বিয়েটা হয়?
-হ্যাঁ মা ওখানেই হয়। তার আগে অবশ্য আমরা পাত্রী দেখেছি এখানে ওখানে। শহরের বাইরেও গেছি।
– উনি কি চাইছিলেন যে.. ।
– হয়ত তাই। না হলে আমরা মধ্যমগ্রাম না হৃদয়পুর কোথাও একটা মেয়ে দেখে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলাম। তারা চাকরিজীবি পরিবার।
মোহিনী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোন সংগত কারণ ছাড়াই।
– ব’সো মা উঠলে কেন? ওর দিদির তো তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সূত্র ধরেই সেই পাত্রীর যোগাযোগ।
মোহিনীর কানে কথাগুলো যাচ্ছে আর তিনি ভাবছেন এক বিকালবেলার কথা। তিনি তখন সবে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছেন। মাসির বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কলকাতার কোন এক বনেদি বাড়ির লোকজন তাকে দেখতে আসে। তারা নাকি সিংহ জুয়েলার্সের আত্মীয়স্বজন। কেউ বিশেষ আপত্তি করেনি। তিনি আশাও করেন নি বা তেমন কিছু তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তাও ভাবেন নি।
কিন্তু আর এক সবে সন্ধ্যা পেরোন রাতের বেলায় মধ্যমগ্রামের বাড়িতে বিমর্ষ হয়ে বাবাকে অফিস থেকে ফিরতে দেখে তার সন্দেহ হয়। পরে মায়ের কাছে শোনে পাত্রপক্ষ নাকি বলে গেছে মেয়ের বাবা যা মাইনে পায় তাদের দোকানের কর্মচারীরাও এর থেকে বেশি পায়। বাবা কিছুটা অপমানিত বোধ করেন। কিন্তু পাত্রী তাদের পছন্দ হয়েছিল ।
– বুঝলে মোহিনী মা। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। আমরা কিছু করতে পারি না। বারাসাতের সেই মেয়েটিকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছিল কিন্তু অমিতের কিছু আপত্তি ছিল । কোন ভাবে জামাইবাবু জানেন ছেলের আপত্তি আছে। রাসভারী মানুষ। বললেন, – তবে কেন গিয়েছিলি দেখতে? একটি মেয়েকে অপছন্দ হয়েছে সেটার যদি সঠিক কোন কারণ না থাকে তবে তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়?
ছেলে দুর্বল একটা কারণ দেখিওছিল বটে তবে তার পিতৃদেব সেটা পছন্দ করেননি। এরপর ব্যাপারটা যে ঘটকের মারফত যোগাযোগ হয়েছিল সে ই নিজের মত করে মিটিয়ে দেয়। আমরা আর খোঁজ খবর করিনি।
– আপনাদের তরফে আর খোঁজ খবর নেয়া হয়নি বোধ হয়,একদমই ?
– ব্যাপারটা ওখানেই সমাপ্ত হয়। সে মেয়ে পরে কলেজে ভর্তি হয়েছিল শুনেছি। তারপর বারাসাতের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। তারা বাপের সম্পত্তি ও দোকানের ভাগ চায়। নানা জটিলতা। আমিও খুব বেশি ঢুকিনি ওর মধ্যে।
– মেয়েদের পক্ষে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। হয়ত সব মেয়ের জীবনে ঘটে।
– এটা এক ধরনের অপমান মা।
– আপনি মানছেন।
– আমি লেডি ব্রেবোর্নের ছাত্রী ছিলাম। সম্মান বোধ আমার খুব কম ছিল না। আর তাই বিয়ের পরে নিজের সংসার করাও হয়নি। স্কুলের মাষ্টারি করে কাটিয়েছি।
মোহিনীর মনে দ্বিধা ছিল । সত্যিই কি তার জীবনে প্রথম কণে দেখাটার পর্বটা অপমানজনক অধ্যায় ছিল? কিন্তু অপরপক্ষের যুক্তি যদি ধর্তব্য হয় তবে ব্যাপারটার মধ্যে তেমন অপমানের তীব্রতা কি আছে?
এরপর কথা বলতে বলতে তারা বাড়ির সবটা ঘুরে বেড়ান। মৃতা কর্ত্রীর ছবিতে এখনও প্রাত্যহিক সাম্মানিক মাল্যদানের পর্ব বজায় আছে।
সমর নিজে হাতে অমিতের পাঞ্জাবির বাম পকেট থেকে একটা চাবি বার করতে পারলেন।
– লকারটা খোল।একটা চকচকে প্যাকেট আছে দেখ।
সমরবাবু প্যাকেটটা অমিতকে দিলেন।
অমিত যত্নে রাখা একটা খাম বার করলেন। একটা জুয়েলারি দোকানের খাম। হয়তো এদেরই দোকানের। একটা পাতলা কাগজ আছে খামের ভিতরে। তারপর বললেন, – চিঠিটা আমাকে পড়তে হয়েছিল । নিতান্তই ব্যক্তিগত চিঠি। পড়া উচিৎ হয় নি। তবে সেটা আমার স্ত্রীর পরোক্ষ অনুরোধেই পড়তে হয়েছিল । কিছু মনে করিস না।
একটা সাদা কাগজে সমর ব্যানার্জির লেখা চিঠি, স্বাক্ষর এবং ইতি টানার পরে সবিস্তারে ঠিকানা।
– কিছু মনে করলি সমর? কোন প্রেমিকের একান্ত গোপন চিঠি আমি পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। শুধু সেই প্রেমিকার কথা রাখতে।
সমর বাবু নিশ্চুপ। অমিত মাথা নীচু করে আছে।
– তোর জানতে ইচ্ছে হয় না অমিত, সবটা? ঠিক কি হয়েছিল ?
– আমরা বন্ধু তো ছিলাম। না জানলেও আমরা বন্ধুই থাকব । আমি তো বলা যেতে পারে ওপারে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছি। যদি সবটা বললে তুই ভারমুক্ত হোস আমার শুনতে কোন আপত্তি নেই।
– তোর চিকিৎসা চলছে। তোর ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে। বাকি কোর্ট কাছারি কোন রকমে মিটিয়ে তুই নিশ্চিন্তে আরো দীর্ঘদিন সুস্থ থাক। সেটা চাই।
– আমার বাবা বেঁচেছিলেন ষাট বছর,ঠাকুর্দা ঐ রকমই। ধরে নিতে হবে আমিও ওর আশপাশে যাব । মোহিনী এখন মাসিকে পেয়েছে এখন ওর এদিকে আসার সম্ভাবনা কম। তুই মন খুলে বল।
সমরবাবু শুরু করলেন।- আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেসটা মোটামুটি সবাই চিনত। তুই তো চিনতিস। দয়িতাও কি করে জায়গাটা জেনে গিয়েছিল। একদিন ক্লাসের পর ও সেখানে এসে হাজির।
সে আমলে বোধ হয় এটা খুব চল ছিল না যে মেয়েরা বা কোন মেয়ে হঠাৎ করে ছেলেদের মেসে গিয়ে হাজির হবে। দয়িতা সেন হয়তো অন্য রকম ছিল ।
– কাল তোমার নেমন্তন্ন আমাদের বাড়িতে। বাবা থাকবে।
সেটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারিনি তখন। তবে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। অনেকটা সময় বেশ হৈ-হুল্লোড় আনন্দে কাটিয়েছিলাম সেখানে।
যখন তাদের বাড়ি থেকে ফিরব বলে পা বাড়িয়েছি। তার বাবা প্রতিথযশা ব্যারিষ্টার তমাল কান্তি সেন ডেকে বললেন,
– তুমি ভাল ছেলে শুনেছি, কিন্তু তুমি শুনে রাখ আমি এক এক দিনে যা ইনকাম করি সেটা যে কোন সরকারি কর্মচারির কয়েক মাসের মাইনের থেকেও বেশি । দয়িতা আমার একমাত্র সন্তান । তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, আমি চাইব আমার মেয়ের বিয়ে হোক সমান উচ্চ পরিবারেই । মনোযোগ দিয়ে পড়া শেষ কর। সেটা অন্ততঃ তোমার নিজের ভবিষ্যতেে পক্ষে মঙ্গল হবে।
আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। কিম্বা দ্বিধা দ্বন্দে ভুগতে হয়নি।
তারপর মেসে ফিরে এই চিঠিটা দয়িতাকে লিখি। তারিখ দেয়া আছে।
– চিঠিটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়ে আমারও মনে হয়ছিল কোথাও সুর কেটে গেছে।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে তারা একসাথে বসেছেন। কাজের মেয়েটি পরিবেশন করছে। তবে মাসিও সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাসি বললেন, – কতদিন পর একসঙ্গে এই খাওয়ার টেবিলে সবাই বসল ।
– তোমার ফেভারিট সব রান্নাগুলো করেছ মাসি?
– নিজে করতে পারিনি কিন্তু করিয়ে নিয়েছি।
– তোমার বৌমা যেগুলো পছন্দ করত চিংড়ি ইলিশ পটলের দোরমা,নারকেল কোরা দিয়ে মোচার ঘন্ট….. ।
– তোর পছন্দেরও অনেকগুলো আইটেম আছে আলু পোস্ত রুই মাছের কালিয়া খাসির মাংস আমের চাটনি পায়েস। তবে তোর জন্য শুধু রুটি আর সুপ।
– সে কি শুধু আমার জন্য রুগীর পথ্য ?
প্রথম দিকে সমর মাথা নিচু করে খেতে শুরু করে। মোহিনীর অবস্থাও একই। অমিত অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য বলল, – আমার বিয়েতে তোদের মিস করেছি, ধরে নে সেই অনুষ্ঠানটা আজ হচ্ছে। দেয়ালে তাকিয়ে দেখ দয়িতা তোদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
– খোকা তুই শুরু কর। সুপ ঠান্ডা হলে খেতে পারবি না।
ন সুর ছন্দে অত্যন্ত গরমিল পরিস্থিতি। তবুও মোহিনী নিজের মতো চেষ্টা করল পরিবেশের গাম্ভীর্য কাটাতে। বিয়ের প্রসঙ্গ যখন উঠলন তিনি চেষ্টা করলেন পরিস্থিতি লঘু করতে।
– মাসিমা, যাদের বিয়ে বর্ষা কালে হয়। তাদের নামে জুড়ে থাকে খুনের অপবাদ। আমি জীবনে ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন জীব হত্যা করিনি। আপনার এই ছেলেটি নিশ্চয় করেছিল ।বলে মাথা নীচু করে বসা স্বামীকে ইঙ্গিত করলেন।
মাসি তাকালেন সমরের দিকে।- আমি গ্রাজুয়েট হয়ে বাড়িতে বসে বুড়িয়ে যাচ্ছি । একদিন বাবা এসে এক সরকারি চাকুরিজীবী প্রার্থীর খবর আনল । যারা আমাকে দেখতে আসবে। খুবই গ্রামের মানুষ। পাত্রের চাকরির তুলায় শিক্ষার মান উন্নত। আমার রাজি হওয়া, কিম্বা গর রাজি এসবের মতামতের কোন প্রশ্নই ছিল না।
তাঁরা একদিন এলেন, আমাকে দেখলেন এবং উত্তর দেবেন বলে চলে গেলেন। উত্তর এল এবং একটা খামে ভরা চিঠিতে। সবাই খুশি হল। আমাকেও হতে হল ।
মোহিনী একবার তাকালেন অমিতের দিকে। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, অমিত তাকে দেখছেন। তাঁর সন্দেহ নিরসনের জন্য মোহিনী বলল,
– জীবনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ করতে পারিনি তাই এই পাশ করাকে স্বাগত জানালাম। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হল এবং তারিখ পড়ল এমনই সময়ে যখন লোকে ছাতা হাতে ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে সাহস পায় না। সাত পাকের সময় হুড় মুড়িয়ে বৃষ্টি এল। যারা একটু গণনা টননা করে তারা বলল –এ শুভ লক্ষ্মণ। জোড়ে খেতে বসার সময় আমার গেঁয়ো স্বামী আমার শাড়ির আঁচল সামলে বলল, – মোহিনী জান বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভাল লাগে। তুমি ভিজবে আমার সাথে?
অমিত মল্লিক খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন মোহিনীর কথা। চমকে উঠলেন। হেয়ার স্কুলের মাঠের ধারে তারা খেলার পরেও বসেছিল সমর আর অমিত। হঠাৎ ঝম ঝম এসে বৃষ্টি শুরু।
– ছোট ছোট, শেডের নীচে চল ।
– জানিস বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভাল লাগে। তুই ভিজবি আমার সাথে?
দুপুরের পরে আর বেশি দেরি করেননি তাঁরা। অমিতের ছেলে বিক্রম দোকান থেকে ফিরলে সে নিজে ওদেরকে গাড়ি করে স্টেশনে পৌঁছে দিল ।
দোতলা থেকে নিচে নামার পর মোহিনী উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মাসিমা ও তাঁর ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর হাত নাড়ছিলেন।
– একটু দাঁড়াও মাসিমাকে প্রণাম করতে ভুলে গেছি।
দোতলায় এসে মাসিমার পায়ে হাত দিতে গিয়ে কানে এল, – মোহিনী আই অ্যাম সরি।
মোহিনী কোন উত্তর দিতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল। জীবনের কোন হিসেব কিম্বা সম্পর্কের কোন পরিণতি কি আর মানুষ সব আঁচ করতে পারে? তবে যেটা ঘটে সেটা মানতেই হয়।
– আপনি ভালো থাকুন, দাদা। মোহিনী মাথা নীচু করে বললেন।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর মনে হল, এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।
(শেষ)