স্বপন দুহাতে দুটো ভারী ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নামল। শেয়ালদা ষ্টেশনের ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ষ্টেশনের চুড়ার ঘড়িতে দেখল এগারোটা কুড়ি। তাহেরপুর যাওয়ার লাষ্ট ট্রেন সাড়ে এগারোটায়।
আজ বড্ড দেরী হয়ে গেল। কাল থেকে দোকান বন্ধ। কলেজ ষ্ট্রীটের বইয়ের দোকানের ষ্টক মিলিয়ে দোকান বন্ধ করে যেতে হল পোস্তা। বাড়ির মুদিখানার জন্য সেখান থেকে জিনিসপত্র কিনে বেরোতেই সওয়া দশটা। চারদিকে পুজোর প্যান্ডেল। রাস্তা জ্যাম। সারা রাস্তা ঠোক্কর খেতে খেতে বাসটা শেয়ালদা পৌঁছলো প্রায় মাঝ রাতে।
প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার এরকমই দেরী হয় স্বপনের। বাড়ির লাগোয়া মুদিখানাটা চালায় তার বৌদি ডলি। ছোট মেয়েকে রেখে সে তো আর একশো কিলোমিটার উজিয়ে বড়বাজারে আসতে পারবে না। অথচ পোস্তাবাজার থেকে মশলা কিনলে অনেক সস্তা পড়ে। জিনিসও ভালো। গ্রামে ভালো বিক্রি হয়। স্বপন নিজে অন্যের বইয়ের দোকানের কাজ করে। রোজ রোজ তো মালিকের আগে বেরিয়ে যাওয়া যায় না। অগত্যা দেরী।
টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। মান্থলি আছে। তবু বাসষ্টপ থেকে ষ্টেশনের মেইন গেট পর্যন্ত অনেকটা পথ। ভারী ব্যাগ নিয়ে বেশী জোরে দৌড়নোও যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের মুখে যখন পৌঁছলো তখন কৃষ্ণনগর লোকালের সিগন্যাল হয়ে গেছে। ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। আরো জোরে দৌড়লো স্বপন। এই ট্রেন মিস করলে আজ রাতে ষ্টেশনেই থেকে যেতে হবে। অথচ আগামীকাল ষষ্ঠী। মা আর বৌদির শাড়ি আর ভাইঝিটার জন্যে কেনা নতুন জামা রয়েছে ব্যাগে। রাতের প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। ট্রেনেও ভীড় নেই। দুটো ব্যাগ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে চলন্ত ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পিছলে পড়ল সে। পকেট থেকে সস্তার ফোনটা ছিটকে পড়ে ট্রেনের তলায় চলে গেল।
সে নিজেও ট্রেনের নীচে চলে যাচ্ছিল। শেষ মুহুর্তে কে যেন হাত ধরে টেনে প্ল্যাটফর্মের উপরে ফেলে দিল। ‘এত রিস্ক নিস না। তুইও এমন করে চলে গেলে তিনটে অসহায় মানুষকে কে দেখবে?’ দূর থেকে ভেসে আসে দাদা তপনের গলা। স্বপনের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটতে থাকে।
তপনকে সামনে থেকে দেখা গেল না। শুধু একটা ধূসর অবয়ব দৌড়তে দৌড়তে দ্রুত অপসৃয়মান ট্রেনের ছায়ার সাথে যেন মিলিয়ে গেল।
লম্বা, শক্তপোক্ত তপন প্রথম জীবনে রানাঘাট-কৃষ্ণনগর লাইনে হকারি করত। তারপর ড্রাইভিং শিখে চাকরি পেয়ে যায় বিএসএফে। ভালো মাইনে।
দুবছর আগে এমনই এক পঞ্চমীর রাতে উগ্রপন্থীদের গুলিতে প্রাণ হারায় সে, কনভয়ের আরো তিন জনের সাথে। সূদূর কাশ্মীর থেকে তাহেরপুরে দুঃসংবাদ আসে পরদিন সকালে।
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। হাত, পা, থুতনি কেটে ছড়ে গেছে। ফোনটাও আর পাওয়া যায় নি। সারারাত শেয়ালদা ষ্টেশনে কাটিয়ে আর এক ষষ্ঠীর সকালে বাড়ী ফিরল স্বপন। নতুন জীবন পেয়ে।