দেখতে দেখতে পনেরোদিন হয়ে গেল এই শহরে| এখন শহরে আলো ফুটলে, বা আলো ফুরোলে ঘড়ি না দেখেই বলতে পারি সময় কত| রাতেরবেলা আলো নিবিয়েও পৌঁছে যেতে পারি বাথরুমে| একটু একটু ক’রে চিনে উঠছি চারপাশ| আমি যে সোসাইটিতে আছি, সেখানে নাকি বাঙালি প্রচুর| আজকাল ‘মাই গেট’ য়্যাপের সাহায্যেই সেসব পাড়া-প্রতিবেশীরা, মানে বঙ্গসন্তানেরা আপনার সোসাইটিতে কোন ব্লকে, কোন য়্যাপার্টমেন্টে থাকে, সেসব জানাশোনা হয়েই যাবে| যেমন আমি ইতিমধ্যেই জেনেছি প্রায় ৫-৬ টি পরিবার আমার এই ‘ডি’ ব্লকেই থাকে….! কিন্তু আমার একঘেঁয়ে-সেকেলে কান, আমি তাই পেতে রাখি সারাদিন, যদি শুনতে পাই দু-একটি বঙ্গবুলি…! কিন্তু নাহ্, এখানে ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ ভাবনা নিয়ে চলা বাঙালি নিজের আইডেন্টিটিটুকু অমন চট করে আপনার সামনে খুলবেন না! দূর থেকে ‘ঐ যে শাখা-পলা.. বাঙালি রে…!’ কিন্তু এগিয়ে গিয়ে ‘আরে বাঙালি যে!’ এই সরলতা দেখাতে আমরা অনাগ্রহী|
আমার ব্যাঙ্গালোরে আসা মূলত আমার কর্তার চাকরি-সূত্রে| তাও কি এতকাল তার পেছনে হেঁদিয়ে গিয়ে হিল্লি-দিল্লি করেছি? এখন জীবন এমন দ-য়ে ফেলেছে যে পরিবারের বাকিদের নিয়ে একা সামলানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছিল! তাই পাততাড়ি গুটিয়ে তথাকথিত ‘গ্রীন সিটি’র আপাতত বাসিন্দা আমি| এখানে আসার আরেকটা বড় ভরসা আমি বিভিন্ন সূত্রে পাচ্ছিলাম যে, এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা নাকি দারুণ! দেশের ‘বেস্ট’টা পাবো|
স্টেজ ফোর (যেহেতু আমার বোনম্যারো আক্রান্ত) লিম্ফোমা ডিটেক্টেড হওয়ার পর আকাশবাণীর Kausik Sen দা-র কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে আমি যখন য়্যাপলো-য় পৌঁছই ড: পি.এন মহাপাত্র-র কাছে আর তারপর থেকে ডাক্তারের সুপারভিশনে আমার যে চিকিৎসা শুরু হয়, তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্তুষ্টই ছিলাম| আমার ছ’টা কেমো য়্যাপোলোতেই হয়| তারমধ্যে একদিন আমার আগে থেকে কেমো-ডেটের বুকিং থাকলেও ওষুধ আসতে দেরি হয়, আর আরেকদিন সকাল থেকে একটু খাওয়ার জন্য গরম জল চেয়ে তা পেতে পেতে বিকেল হয়ে যায়| এছাড়া, কোনদিন তেমন হয়রানি হয়নি যা নিয়ে অভিযোগ করব| তবে, হ্যাঁ, আমি কেমো নিতে শুরু করি এপ্রিলের শেষের দিকে, তখন সেকেন্ড ওয়েভের চোটে হাসপাতালগুলো খালি, ফাঁকায় ফাঁকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা শান্তিতে কাজ করতে পেরেছেন এবং রোগীর সংখ্যা কম থাকায় রোগী-পিছু নজরদারিটাও রাখা গেছে| লাস্ট দুটো কেমো নেওয়ার সময় ক্যান্সার পেশেন্টদের মারাত্মক চাপ বেড়ে যায়, আর সঙ্গে আনুষঙ্গিক ঝঞ্ঝাট-ও|
আমি নিশ্চিত, কোলকাতার হাসপাতালগুলোয় স্টাফ প্রয়োজনের তুলনায় কম| আমার এক ডাক্তার বন্ধু বলেছিলেন নীলরতন মেডিক্যালে যা চাপ আছে সেই চাপ ঠিকমতো ডিস্ট্রিবিউট করতে অমন আরো পাঁচটা হাসপাতাল প্রয়োজন| বাবাকে বছরে তিনবার করে মেডিকায় ভর্তি করার সুবাদে মনে হয়েছে রোগীর যা চাপ, সে তুলনায় কর্মী-সংখ্যা কম| আর যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে অভিজ্ঞ যারা, তারা কি যোগ্যতা-অনুযায়ী বেতন পান? আমার এ-ও মনে হয়েছে, কোলকাতায় যেভাবে অল্প পয়সা দিয়ে এইধরণের জরুরি পরিষেবাগুলোতে কাজেরলোক পাওয়া যায় পৃথিবীর কোথাও তা পাওয়া যায় না! এবার আপনি বলুন, পয়সা না পেলে আপনি কাজ মন দিয়ে করবেন কেন? এখানে, ব্যাঙ্গালোরে, আমার মনে হয়েছে, অন্তত এইচ.সি.জি, মানে যে হাসপাতালে আমি সপ্তমকেমো নিয়েছি গতমাসের আটাশে, আর অষ্টম নেব অক্টোবরের উনিশে, সেখানে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত কর্মচারীদের এই অনুযোগ নেই| ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তার ‘দেবতা’ আর কোলকাতার ডাক্তার ‘দানব’ এমন সহজিয়া ভাগাভাগি আমি করতেই পারব না! আমি নিজে যে সব অসম্ভব বিপদের মধ্যে পাশে পেয়েছি… পুণ্যব্রত গুণের মতো পরোপকারী চিকিৎসককে, পেয়েছি প্রাণ-বাঁচানো বন্ধু ড: নির্মাল্য রায়কে, ড: কলি কুন্ডুকে, যেমন পেয়েছি ড: তন্ময় ব্যানার্জীকে, যেমন পেয়েছি ড: অর্জুন দাশগুপ্তকে… এখানে চ’লে আসতে হবে শুনে এঁনাদের প্রয়োজনে পাবোনা ভেবেই হাত-পা কাঁপছিল! ডাক্তারের মহানুভবতা কোলকাতা কম দেখেনি| আমরা যেটা কম দেখি তা হ’ল আমরা নিজেরা কী….!
আমরা সারাক্ষণ অন্যের ক্ষতি চাইব| আমরা পাশেরবাড়ির মানুষের করোনা হ’লে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকব| আমরা কাজেরলোকের ছেলে-মেয়ের ন্যূনতম দায়িত্ব নেব না| পাড়ায় বেপাড়ার ছেলেদের মস্তানি হলে লেজ গুটিয়ে থাকব| যত্র-তত্র পানেরপিক ফেলে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর মহিমা-কীর্তন করব| আসল খবরগুলো না পড়ে শোভন-বৈশাখী করব| ২০২০-তে দেশের মধ্যে পঞ্চম স্থানাধিকারী যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেব| ‘রেস্পন্সিবল’ বাবা-মায়ের মতো বলব “ওখানে তো ছেলেমেয়েরা শুধু মদ আর গাঁজা খায়….!” আর নিজেরা আফিমের নেশায় মত্ত হয়ে বিদেশে পাঠানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করব তাদের…! এটাই আমরা| আমরা রেস্তোরাঁয় প্রতি উইকএন্ডে খাবো, কিন্তু অফিসের কোন সহকর্মীর বিপদে পাশে থাকবো না| এটাই আমরা| এভাবেই ‘য়্যাটিটিউড’ গড়ে ওঠে| ব্যাঙ্গালোরে ডাক্তারের ‘য়্যাটিটিউড’ দেখে আপনার মনেই হবে না ইনি কোন মসীহা! আর কোলকাতায় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় গেটে ঢোকার সময় সিক্যুরিটিদের ‘য়্যাটিটিউড’-এই আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন| আর দেখবেন, খুব আশ্চর্যভাবে এইসব হামবড়াই হাবভাবের মধ্যে আপনি নিজেকেও ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারছেন| আত্মসম্মান আর আত্মম্ভরিতার মাঝে যে কোন ওভারল্যাপিং নেই, বরং সম্পর্কটা ব্যাস্তানুপাতিক, তাই আমরা ভুলে মেরে দিয়েছি আমাদের প্রাত্যহিক যাপনের মধ্যে…
এই অসুখ আমাদের যতদিন না যাচ্ছে, ‘পরিষেবা’ ‘পরিষেবা’ করে লাফিয়ে লাভ নেই| পরিষেবা যারা দিতে আসছেন তারা আমি বা আপনি| ভীনগ্রহ থেকে কেউ নয়| বাঙালি হিসেবে আমরা ইতিহাস-সচেতন হই| কাঠি-করা আর হিংসুটেপনা বন্ধ করে যে অযুত-নিযুত বঙ্গসন্তান বিশ্বসুদ্ধ মানুষকে কত কি শিখিয়ে দিতে পেরেছেন এবং কত সততা আর নিষ্ঠা ভ’রে, তপস্যার মত তা পালন করে গেছেন, তার সিকিভাগ-ও যদি আমরা আমাদের নিজেদের জীবনে অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো এত বিরুদ্ধালোচনার সময়টুকুও পেতাম না….
‘রাজা’কে যতদিন শিখন্ডীর মতো সামনে দাঁড় করিয়ে চলব, ততদিন আমাদের এই লালা-গড়ানো চলবে| মেরুদন্ড তো আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে, তাই না?
(আমার আকাশবাণীর সহকর্মী মনীষা-র ব্যাঙ্গালোর ডায়রি পড়ে এই লেখা লিখলাম| নয়তো, লিখতাম, পরে, এখনই নয়| ওর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে এখানে ভালো, তা জেনে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি| মনীষাকে ব্যক্তিগতভাবে যেটুকু চিনি তাতে মনে হয়েছে স্বাস্থ্যপরিষেবা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েই ওর মনোযোগ| কিন্তু, ওর পোস্ট নিয়ে যে অদ্ভুত রাজনৈতিক খেলাধুলো শুরু হয়ে গেছে, তার প্রেক্ষিতেই আমার এই পোস্ট)
❤️ দুই শহরের ছবি| নেট থেকে নেওয়া| দেখার চোখটা একটু বদলালেই হ’লো…
Sohini, I have always appreciated your strong view points and wonderfully simple yet thought provoking style of writing.
This piece penetrates deep – truly a time for introspection by each one of us. Best wishes, stay well