আজ ১৯শে মে, ১৯৬১ সাল, গতকাল রাত থেকেই শুরু হয়েছিল ধরপাকড়। আর আজ দুপুর ২-২৫ শিলচর রেল স্টেশন। ফটফট করে আওয়াজ। কমলা তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো ভেজা কাপড়ের টুকরোটা। দাদাদিদিরা শিখিয়ে দিয়েছে কাঁদানে গ্যাসের সাথে লড়াই করার এ এক মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু না। এতো কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটার শব্দ নয়। তবে কি আসাম রাইফেল্সের জওয়ানরা গুলি চালাতে শুরু করেছে? হঠাৎ মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা। চারদিকটা অন্ধকার হয়ে গেল কমলার। হাতের থেকে খসে পড়লো কাপড়ের সেই টুকরোটা।
১৯৪৭ সালে মানচিত্রে দাগ কেটে বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ ভারতকে দিয়ে দেওয়ার ফলে বাঙালি অধ্যুষিত তিন জেলা হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ ও শিলচর নিয়ে গঠিত হলো বরাক উপত্যকা যা আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৫০ সাল পর্যন্ত আসামের বিধানসভায় বাংলাভাষার প্রচলন ছিল। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ চালিহা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসাম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ উত্থাপন করেন। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিধানসভায় এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়, উপেক্ষিত হয় রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। এ আইনের মাধ্যমে একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা, ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনে।
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের দিনটি এ সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এ আন্দোলন তখনো ছিল সত্যাগ্রহ। শিলচরের কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সংকল্প নেওয়া হয় এই দিনে। উদযাপিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালানোর হয়। আর সেই সূত্রে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। শত শত স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে দুই সপ্তাহ ধরে ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন আন্দোলনকারীরা। ২ মে তারা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
তারপর আসে ঐতিহাসিক ১৯ মে, ১৯৬১। বরাক উপত্যকায় হরতাল আহবান করা হয়। এদিকে হরতালের আগের দিন রাতে করিমগঞ্জে ব্যাপক ধরপাকড় চালায় পুলিশ, হামলা হয় গণপরিষদের কার্যালয়ে।
কাছাড়ে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ১৮ই মে পুলিশ রাত বারোটায় করিমগঞ্জ গণসংগ্রাম পরিষদের অফিসে হানা দিয়ে পরিষদের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা সংগ্রামী রথীন্দ্রনাথ সেনকে গ্রেপ্তার করে। রাত সাড়ে তিনটার সময় যুবশক্তি সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়াও সন্ধ্যে থেকে রাতের মধ্যে গ্রেপ্তার করে জেলা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নলিনী কান্ত দাস, ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাস ও আরো অনেক কর্মীকে।
করিমগঞ্জে ডাঃ নীরদভূষণ দে এর সভাপতিত্বে ভাষা আন্দোলনে কমুনিস্ট পার্টির ভূমিকা ও কর্তব্য নিয়ে জনসভায় ভাষণ দেন কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য ও কমরেড যোগ্গেশ্বর দাস। এর পরেই করিমগঞ্জের পার্টি অফিসে বিশাল পুলিশ বাহিনী হানা দিয়ে গ্রেপ্তার করে সম্পাদক মুর্শিদ আলী, কমেরড রোসেন্দ্র শর্মা, যোগ্গেশ্বর দাস, কৃষাণ সভা সম্পাদক সাধন দাস, মুসদ্দর আলী প্রভৃতি কম্যুনিস্ট নেতৃত্বকে।
পুলিশের এই মারমুখী আচরণে ফুঁসে উঠে করিমগঞ্জ। জনতা বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ১৯ মে সকাল থেকে সর্বত্র হরতাল পালিত হতে থাকে। শিলচর রেলস্টেশনে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-জনতা জমায়েত হলেন শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে৷ “মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ” ধবনিতে চতুর্দিক মুখরিত৷ সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে সত্যাগ্রহে সামিল হয়েছিলেন কমলা ভট্টাচার্য৷
কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম পূর্ববঙ্গে৷ বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির ভূমি, শ্রী চৈতন্যের জন্মভূমি শ্রীহট্টের ঢাকা দক্ষিণে পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়িতে৷ পিতা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবী৷ কমলারা ছিলেন তিন ভাই চার বোন৷ ভাই-বোনেদের মধ্যে কমলা ছিলেন পঞ্চম৷ বাল্যকালেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়৷ দেশভাগের অভিশাপ মাথায় নিয়ে স্বামীহারা কমলার মা সন্তানদের নিয়ে অবশেষে দেশ হারিয়ে উদ্ধাস্তু হলেন৷ আশ্রয়ের সন্ধানে ১৯৫০ সালে এলেন খণ্ডিত দেশের অপর পারে, শিলচরে৷
বড় অভাবের সংসার ছিল কমলাদের৷ সুপ্রবাসিনী একা লড়াই করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেন৷ থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোড সংলগ্ন বর্তমান শহিদ কমলা ভট্টাচার্য রোডের একটি ভাড়াবাড়িতে৷ ঘরে খাবার না থাকলেও কমলার পড়াশুনোর উৎসাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি৷ সহপাঠীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ বই কপি করে পড়াশুনো চালিয়ে যেতেন৷ স্কুলে যেতেন শতচিছন্ন কাপড় পড়ে৷ বড়দি বেণু ভট্টাচার্যের কাছে একটি অভিধান চাইলেও দারিদ্রের জন্য দিদি যখন তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন, কমলা বলেন, ‘‘না না থাক এমনিই বলছিলাম৷” বই ছাড়াই পড়াশুনা করে মাধ্যমিক দিয়েছিলেন৷ বলতেন, ‘গ্রাজুয়েশন আমি নেবই’৷ সব প্রতিকূলতাকে জয় করার অসম্ভব জেদ ছিল মনে৷
এই জেদ নিয়েই বাংলা ভাষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷ শহিদ হওয়ার পর মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হলে দেখা যায় কমলা দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন৷ বড় আশা ছিল মনে, স্কুল ফাইনাল পাশ করে চাকরি নিয়ে পরিবারের দুঃখ দুঃখ দূর করবেন৷ ফল বেরনোর আগেই শিখে নেবেন টাইপরাইটিং৷ কিন্তু, মায়ের দুঃখের চেয়ে ভাষা-জননীর দুঃখ আরও যে বড়৷ আসাম সরকার ভাষা বিল পাশ করে রাজ্যভাষা অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছে জোর করে৷ ফলে কমলার হৃদয় মাতৃভাষার সংকটের দিনে ভাষাজননীর ডাক উপেক্ষা করতে পারল না৷
ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবীতে একটি পিকেটিংএর ডাক দেওয়া হয়। সেদিন সকালে, অৰ্থাৎ ১৯শে মে সকালে কমলাও পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন।
কমলা পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন৷ দাদা বাড়িতে নেই, বড়দি চাকরির ট্রেনিং-এ গেছেন শিমুলগুড়ি৷ সেজদি প্রতিভা ভট্টাচার্য এলপি স্কুল শিক্ষিকা, যাঁর উপার্জনে সংসার চলছে সেই সেজদির স্কুলে যাবার জন্য রাখা শাড়ি-ব্লাউজ পরে কমলা তৈরি হন৷
মাকে অভয় দেন কিছু হবে না৷ কাঁদানে গ্যাস ছাড়লে ছেঁড়া ন্যাকড়া ভিজিয়ে নাকে দেবেন বলে মায়ের কাছ থেকে একটা ন্যাকড়া চেয়ে নেন৷ ক্ষুধার্ত কমলা যাবার আগে খাবার চাইলেও ঘরে কিছু ছিল না বলে মা হাতে তুলে দিতে পারেননি৷ খালি পেটে ছোট বোন মঙ্গলাকে সঙ্গে করে কুড়ি-বাইশ জন মেয়ের সঙ্গে রেলস্টেশনে বেরিয়ে যান কমলা৷ তখনও জানেন না মাতৃভাষার জন্য এই অভিযানে তিনি শহিদ হতে চলেছেন৷
দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশে ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা, মায়ের ধূলিধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা নিবারণ করে মাকে বাড়ী পাঠিয়ে দেন।সেই ছিল মায়ের তার শেষ সাক্ষাৎ।
সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচী ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ, যার পরে গণ অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই অসম রাইফেল্সের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে
বেলা ২-৩৫ নাগাদ বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথারি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যান, ও সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকেন।
ইতমধ্যে সকলকে অবাক করে অসম রাইফেল্সের জওয়ানরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল থেকে সম্পূর্ণ শান্ত নিরস্ত্র পলায়নরত জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে। নির্বিচারে সাত মিনিট গুলি চলল৷ একটি গুলি কমলার চোখের ভিতর ঢুকে মাথার খুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়৷ লুটিয়ে পড়েন কমলা রক্তাক্ত দেহে ছোট বোনের পাশে৷
অন্যন্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখনেই তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তাঁর জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।
ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ৯ জন, আহত হন অন্তত অর্ধশতাধিক। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। ২১শে ভেসে ওঠে একজনের লাশ। সেখানেই বাংলা ভাষার জন্য প্রথম নারী হিসেবে শহীদ হন ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। বরাক উপত্যকার সেই মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ১১ জনের তালিকা –
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরণ সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ
কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী লেখেন ছোট্ট একটা কবিতা –
“দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিলো,
এই যে ঈশান কোণ
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে
কান পেতে তা শোন ….”
আবার ১৯শে মে। অনেক আগেই হারিয়েছি প্রিয় দেশ। প্রিয় দশ ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কবেই হারিয়ে গেছে। ওদের সাথে হারিয়ে গেছে কাপড়ের সেই ছোট্ট টুকরোটা, যেটা কমলা চেয়ে নিয়েছিল মায়ের কাছ থেকে। হারিয়ে ফেলেছি আমরা। ঈশান কোণে আবার কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। আজ আমার আপনার প্রিয় বাংলা ভাষাটাও হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যেতে দেবো আমরা ?
কলজে সত্যিই ছিঁড়ে যায় বারবার এই সব নাম লিখতে। তবুও লিখে যেতে হয়। ইতিহাসকে ভুলে যেতে দেওয়া যায় না।
তথ্যসূত্র:
আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি প্রসঙ্গ, সুকুমার বিশ্বাস
ডেইলি জনকন্ঠ
ফিচার ছবি: ব্যারিস্টার নির্মল চন্দ্র চ্যাটার্জি কমিশন রিপোর্ট
অসাধারণ লিখেছেন।
ম্যাট্রিক ও মাধ্যমিক, এই দুটি পরীক্ষার নাম নিয়ে একটু গণ্ডগোল রয়ে গেছে। দেখবেন প্লিজ