আমরা যখন কলকাতা শহরে পাকাপাকি ভাবে ফিরে আসি, সেটা ১৯৭৭ সাল। বাবা জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে কলকাতার হাসপাতালের যোগদান করার পর।
সেই সময়ে কসবার চেহারাটা লাইনের ওপারের বালিগঞ্জ অথবা একডালিয়ার তুলনায় ছিল একদমই গঞ্জের মতো।ছড়ানো ছেটানো সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, ছোট ছোট পরিকল্পনা-বিহীন রাস্তাঘাট আর সারি সারি জলাজমি, এই সবকিছু মিলিয়েই ছিল কসবা। যেখানে রাত তো দূরে থাক, দিনের বেলাতেই ট্যাক্সি ঢুকতে চাইতো না। রাস্তাগুলির অবস্থাও ছিল তথৈবচ।
বসবাসকারী মানুষের মধ্যে তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন ওপার বাংলার লোক। একটা, দুটো সম্পন্ন মানুষের অট্টালিকা যে ছিল না এমন নয়, কিন্তু তা ছিল সংখ্যায় নগণ্য।
আমাদের বাড়ি থেকে দু তিনটি বাড়ি পরেই শুরু হয়ে যেত পুকুরের সারি, যার অর্ধেকটাই ভরে থাকতো কচুরি পানায়। বর্ষাকালে একটু বৃষ্টি বাড়লেই পুকুরের জল উপচে পড়তো রাস্তায়। কাঁচা নর্দমা আর হাঁটাপথের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো পায়ে পায়ে ।রাস্তায় ভেসে আসতো ছোট মাছের ঝাঁক আর মাঝে মাঝে সর্পিল গতিতে সবাইকে চমকে দিয়ে নিশ্চিন্তে জলকেলি করতো জলঢোঁড়া।
গ্রীষ্মের অলস দুপুরে পাশের পাড়ার খাটালগুলি থেকে ছাড়া পেতো মোষের দল। সারা দুপুর পুকুরের জলে ডুবে, বিকেলে তাদের জাবর কাটতে কাটতে ঘরে ফিরে যাওয়া দেখতাম জানালায় বসে। কাকেরা পিঠে চরে সঙ্গ দিত সে যাত্রার।
সেই সময় এলাকায় পড়ে থাকা ফাঁকা জমিগুলিতে বাড়িঘর তৈরি করা শুরু হলে বেশ ভালো লাগতো আমাদের। মনে হতো লোক বাড়লে নিশ্চয়ই এলাকা আরও জমজমাট হবে। নতুন কোন বন্ধুও হয়তো জুটতে পারে সেই সুবাদে। ধীরে ধীরে জলাজমিগুলি ভরাট হতে শুরু করলে বাড়িঘরের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো।
আমাদের বাড়ির পাশে এইরকমই একটা খালি জমি পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। ছোট্ট দেওয়াল ঘেরা সে জায়গাটি আগাছা জমে ক্রমশ জঙ্গলের মতো হয়ে উঠেছিল। আমাদের ক্রিকেট খেলার বল সেখানে একবার গিয়ে পড়লে খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর। তার সঙ্গে প্রতি বর্ষায় জমে থাকা জলে সারারাত ব্যাঙের ডাকে হতো ঘুমের দফারফা।
পরবর্তীতে এই হেন জমিও আর ফাঁকা পড়ে রইলো না।আগাছা পরিষ্কার করে বাড়ি তৈরি শুরু হল। নীচের ভিত, মাথার উপরের ছাদ আর চারপাশের ইঁটের দেওয়াল গেঁথে দেওয়ার পর দেখা দিল সামনে ছোট মন্দির সমেত একটি একতলা বাড়ি। গৃহস্থ যে ধর্মানুরাগী সে বিষয়ে কারো সন্দেহ রইলো না। এক রিটায়ার্ড ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী, কন্যা এবং বয়স্ক বড় দাদা সমেত সেখানে বসবাস করতে শুরু করলেন। ভদ্রলোক আগে কোথায় কাজ করতেন তা আমাদের জানা ছিল না, কিন্তু দেখলাম পাড়ার মুরুব্বি গোছের লোকেরা উনাকে ‘ম্যানেজারবাবু’ বলেই সম্বোধন করছে। তবে কোথাকার ম্যানেজার সে খবর অবশ্য আর নেওয়া হয়নি।
আমরা নিকট প্রতিবেশী হিসাবে লক্ষ্য করলাম ছোট বাড়িটির সামনের একফালি জমিতে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গাছ। এর মধ্যে বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্ব কোণে লাগানো কলম করা দুটি শিশু আমগাছ বিশেষভাবে নজর কাড়লো। এ ছাড়াও তুলসী সমেত পূজার উপচারে লাগে অন্যান্য ফুলগাছ তো ছিল ই। প্রায় রোজ নিষ্ঠাভরে পূজা অর্চনা চলতে লাগলো মন্দিরে।
পরিবারের দৈনিক জীবন ছিল খুবই সাধাসিধে। সেই অর্থে সেইরকম বন্ধুবান্ধব বা সামাজিক মেলামেশা কোনটাই তেমন ছিল না। এর মধ্যেই তাঁদের একমাত্র কন্যার বিবাহ হয়ে গেল।
লক্ষ্য করলাম দুই বয়স্ক মানুষ তাঁদের অবসর সময় কাটান এলাকার দুস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে।
দল বেঁধে বাচ্চারা আসে, জমিতে আসন পেতে বসে দুলে দুলে এটা সেটা পড়ে। তাতে যে অর্থোপার্জন হয় এমনটাও তো নয়। তাই পেনশনের উপরেই সম্ভবত সংসার চলে তাঁদের।
এরপর সকলের জীবন হাসি কান্নায় যে ভাবে কেটে যেতে থাকে,তেমনই কাটতে লাগলো আমাদের। আমরা বড় হতে থাকলাম, আর পাশের বাড়ির শীর্ণকায় প্রৌঢ় মানুষেরা বয়স্ক হতে থাকলেন। কালক্রমে সামান্য সময়ের ব্যবধানে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন সেই বয়স্ক দাদা এবং ভদ্রলোকের স্ত্রী। লোকবল না থাকায় আমাদের মতো এলাকার ছেলেদের মারফত হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সবকিছুই সম্পন্ন হলো।
ধীরে ধীরে বৃদ্ধ মানুষটি আরও একা হয়ে পড়লেন। সঙ্গী রইলো একটি কাজের লোক। কন্যাটিও কিছুটা শ্বশুরালয় আর কিছুটা তার নিজের শারীরিক অসুবিধার কারণে বাপের বাড়ি আসতে পারতো না। দেখাশোনার ভার পুরোপুরি বর্তে ছিল কাজের লোকটির উপর।
ততদিনে আমি ডাক্তারি পাশ করে গেছি।
বাড়ির সামনের সেই একফালি জমিতে লাগানো আম গাছ দুটিও ঝাঁকড়া হয়ে বেড়ে চলেছে আকাশপানে।
মরশুমে উপচে পড়ে আমের ফলন। আমাদের বাড়ির ছাদে ফলের ভারে নুয়ে থাকে তাদের শাখাপ্রশাখা ।
ম্যানেজার বাবুর চিকিৎসার দায়িত্ব তখন অনেকটাই আমার। দরকার মতো কাজের লোকটি চলে আসে আমার বাড়িতে, ল্যাব রিপোর্ট বা রোগীর অন্যান্য অসুবিধা জানাতে।
প্রয়োজন হলে আমিও চলে যাই মেসোমশাইকে দেখতে।ওষুধপথ্যের সঙ্গে একটু বকাঝকাও করে আসি কথা না শুনে চলার জন্য।
তারপরেও বেশ কিছুদিন চলে গেল। দু তিন বার নার্সিংহোমেও ঘুরে আসতে হলো তাকে, বিভিন্ন অসুখের কারণে। মাঝে কয়েক বার আমার চেম্বারে ঘুরে গেলেন, স্ট্রোক হওয়ার পরেও।
একদিন এমনটাই চেম্বারে ঢুকেছেন ভদ্রলোক। আমি প্রেসক্রিপসন করতে গিয়ে বয়েস জিজ্ঞাসা করেছিলাম।তার উত্তরে বলেছিলেন, উনার বয়স নাকি একশো। আমি চমকে উঠে বলেছিলাম, আমি একশো বছর বয়সী কোন রোগীর চিকিৎসা এই চেম্বারে বসে এখনো করিনি। উনি বলেছিলেন, তোমাকে আমি সার্টিফিকেট দেখাবো পার্থ।পরে অবশ্য ফোন করে হেসে জানিয়েছিলেন, হিসেবে একটু ভুল ছিল,ওটা পঁচানব্বই হবে।
যবে থেকে করোনা শুরু হয়েছে, আমার নজর ছিল বৃদ্ধের প্রতি। মাঝে কয়েকবার কাজের লোকটির ডাকে যেতে হয়েছে উনাকে দেখতে। চেষ্টা করেছি আমার ছোঁয়াচ থেকে উনার যাতে সংক্রমণ না ঘটে, সেই চেষ্টা করতে। আমরা তখন হাসপাতালে কোভিডে ডুবে রয়েছি।
আচমকাই কিছুদিন আগে কোমরে ফ্র্যাকচার হয়ে শয্যাশায়ী হলেন বয়স্ক মানুষটি। আর এই বয়সে যা হয়, অপারেশনে অনুমতি না দেওয়ার ফলে বিছানা থেকে আর ওঠানো গেল না সেই ‘ম্যানেজার’বাবুকে। মৃত্যু হলো বৃদ্ধের।
একটি বয়স্ক মানুষ, একফালি জমি সমেত একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন। তাঁর মৃত্যু অঞ্চলের প্রমোটারদের লেলিয়ে দিল এলাকায় এই মুহূর্তে প্রায় বিরল, জমিটির টানে। সেই সাতাত্তর সালের কসবা যে এখন আর নেই। ঝাঁ চকচকে শপিং মল আর কর্পোরেট হাসপাতালের দৌলতে সে এখন সম্ভ্রান্ত কুলীন। শ্রাদ্ধশান্তি মিটবার আগেই হাতবদল হয়ে গেল, একফালি বাগানওয়ালা বাড়িটির সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়।
এক টুকরো সবুজ তাই খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাচ্ছে অঞ্চলের বুক থেকে। কালবৈশাখীতে আমার বাড়ির ছাদ আমে ভরিয়ে দেওয়া প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের গাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে খুব দ্রুত। শীগগিরই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়বে এখানে আরেকটা কংক্রিটের বহুতল। প্রচুর মুনাফা করে কেটে পড়বে সুযোগসন্ধানীরা।
শূন্যে দু হাত বাড়ানো আমগাছটির কান্না শুনবার জন্য কেউ আর অপেক্ষায় বসে থাকবে না।