প্রশ্নঃ– কবে থেকে কবিতা লিখছেন? সব কবিতার প্রথম পাঠক কে? মনে হয় না ডাক্তার না হয়ে কেবল কবি হলে প্রথম জীবনেই যথেষ্ট কাব্যচর্চা করতে পারতেন?
(প্রশ্ন ক’টি ইনবক্সে করেছেন Sucharita।)
উত্তরঃ– কবিতা কবে থেকে লিখছি, এই প্রশ্নটা আমাকে খুবই ভাবালো। পেনের নিব আর কি-বোর্ডের বোতাম ক্ষইয়ে ফেলে, আজ অবধি একটাও সত্যিকারের কবিতা কি লিখতে পেরেছি?
বরং আদৌ কিছু লিখতে শিখেছি কবে থেকে সেটা বলি। আমাদের গরিব পরিবারে তখন প্রথম শিশু আমি। একটু আগে আগেই কথা বলা শিখেছিলাম। যদিও গুংগা বলিনি, তবু ওই আগে কথা বলার দৌলতে সেই ছোটোবেলাতেই আমাকে শিশুপাঠ্য বই তো বটেই দুই বিঘা জমি পুরাতন ভৃত্যের মতন বড় বড় কবিতাও মুখস্ত করিয়েছিলেন আমার কাকা পিসিরা।
ভাড়াবাড়ির একটা দেওয়ালও মুক্ত ছিল না আমার দেওয়াললিখন থেকে। কাজেই যখন হাতে খড়ি অনুষ্ঠানে পুরুত মশাই আমাকে একখানি শ্লেটে শ্রী রামকৃষ্ণ লিখে বললেন, – দাদুভাই, আমার এই লেখাটার ওপর খড়ি দিয়ে হাত বোলাও তো!
সুপক্ব আমি সে কথায় কর্ণপাত না করে তাঁর লেখার নীচে আমার সাক্ষরতার প্রমান রাখলাম আর এক বার স্ব-হস্তাক্ষরে শ্রী রামকৃষ্ণ লিখে। গর্বিত হেসে জিজ্ঞেস করলাম, – ভালো হয়েছে, না? ছদ্মবেশী নকল প্রডিজি সেই যে অবাধ্যতা শুরু করল তার দায় বয়ে গেল সারা জীবন।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, যতদূর মনে পড়ে, মায়ের প্রথম কর্মস্থল চন্দ্রকোনার কোয়ার্টারে রাখা হত যুগান্তর কাগজ। আমি তার একটা ফাঁকা সাদা জায়গায় অন্ত্যমিল যুক্ত দু’ চার লাইন লিখেছিলাম, অন্তর্গত প্রতিভার চাপে। সেই লেখাটা চোখে পড়ল আমার পিসিমণির। ব্যাস, আমি কবি হিসেবে স্ট্যাম্পড হয়ে গেলাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
না কোনও অনুশীলন, না সেই চারা গাছে জল দিল বাড়ির কেউ। কিছুটা আগে আগে অক্ষর জ্ঞান হবার জন্যই, আমাকে সন ১৯৬১তে ক্লাস ফোরএ সরাসরি ভর্তি করা হল(জন্ম সন ১৯৫৪)। তাতে যে আমার লাভ হয়নি কিছু, সে কথা পরে বুঝেছি।
চন্দ্রকোনা থেকে মা বদলি হলেন মুর্শিদাবাদের হিলোরায়। আমি ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম জাজিগ্রাম জুনিয়ার হাই স্কুলে। নাঃ, তখন কবিতা লেখার কথা খেয়াল হয় না। শুধু খুব আবছা মনে পড়ে, একসঙ্গে স্কুলে যেতাম আমি আর বাচ্চু যার ভালোনাম অন্নদাকিঙ্কর। সেই স্কুলে যাবার পথে(আন্দাজ দেড় কিলোমিটার, যদ্দুর মনে পড়ে) আমি ওকে নানা রকম অদ্ভুত গল্প বলতাম, যার নায়ক অনেক সময়েই মানুষ নয়। হয় তো পথের পাশে একপায়ে খাড়া তালগাছেরা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে মেঘের দেশে, এই রকম। তো আমার সেই সব পোস্ট মডার্ন ভাবনা লিখে রাখার দায় ছিল না। কাজেই আমসত্ত্ব দুধে ফেলি জাতীয় কোনও সাক্ষ্য নেই সেই সব কবি(?) কল্পনার।
প্রসঙ্গত বলি, আমরা, সেই গ্রামীণ অনুজ্জ্বল স্কুলের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম সিউড়ি বা আরও বড় শহরের স্কুল নিয়ে। যেখানে রোজ একই রকমের পোষাক পড়ে স্কুলে আসতে হয়। শুধু তাই নয়, বছরে একবার স্কুলেরই ছাত্রদের লেখা নিয়ে একটা বই বার হয়। আমাদের স্কুলে ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। স্কুল ম্যাগাজিনের প্রশ্নই নেই।
মাঝে নয়নসুখএ ক্লাস এইট আর বারাসত গান্ধী স্কুলে নাইন কাটিয়ে ক্লাস টেনে সোপর্দ হলাম রঘুনাথগঞ্জ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে।
এই স্কুলের ইউনিফর্ম নেই কিন্তু ম্যাগাজিন আছে। সেই প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার উল্লাস। উদ্যোক্তা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার রবি বাবু। সেই প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখলাম। প্লেজিয়ারিজম এর হাত ধরে। যে ধারা এখনও বহমান। সগর্বে বলি, আমি টুকে লিখি।
পাঠ্যবইয়ের কবিতা ছিল কবি যতীন্দ্রনাথের লেখা হাট। সেই কবিতা মনে আছে তো আপনাদের? সেই যে,
– দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি , মাঝে একখানি হাট
সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট।…
অপূর্ব কাব্যসুষমা মাখা ছয় লাইনের স্তবক দিয়ে গাঁথা এক কবিতা।
তার অক্ষম অনুকরণে লিখেছিলাম জাদুঘর নামের আমার সেই প্রথম ছাপা হওয়া কবিতাটি। প্রথম দু লাইন আজও মনে আছে,
– জাদুঘরে আমি ঘুরে যে বেড়াই সে নহে দেখিতে শুধু।
কত না যুগের নীরবতা হেথা কেবলই করিছে ধু ধু।
সেই ছ’ লাইনের স্তবক।
পুরো কবিতাটি গুছিয়ে রাখব সেই গৃহিণীপনা আমার কোনও দিনই ছিল না। সেই কবিতাটার আর একটা জায়গা খেয়াল পড়ে। এক জায়গায় মাত্রা ঠিক রাখতে গিয়ে লিখেছিলাম, ধরায় ঘুরিত হেথায় হোথায় ডাইনোসোরাসগুলি। ডাইনোসরএর বদলে ডাইনোসোরাস!
ভেবেছিলাম নিপাতনে সিদ্ধ ডাইনোসোরাস শব্দটি আমার সৃষ্টি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ডাইনোসরের অনুষঙ্গে ওই শব্দটিও খোদ ইংরেজিতেও ব্যবহার করা হয়েছে। রাইনোসোরাসের মত ডাইনোসোরাসও শব্দ হিসেবে ঠিক।
এর পরের বছর ম্যাগাজিনে আর একটা লেখা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হই। একটা ভৌতিক কবিতা। তার শেষ দু লাইন শুধু মনে আছে,
এ কাহিনি পুরোটাই সত্যি
মিথ্যা নাহিকো এক রত্তি…
স্বীকার করতে লজ্জা নেই হতোদ্যম হয়েছিলাম যারপরনাই। অনেক পরে বুঝেছি এই হতোদ্যম হওয়াটাই বোধহয় আমার কবিতার প্রথম পংক্তি।
এরপরে, দু’বছর বেলুড় বিদ্যামন্দিরে। রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ নিয়ে কলেজ ম্যাগাজিনে ফরমায়েসী লেখা। তারপর মেডিক্যাল কলেজে।
মফস্বলি সেই ছেলেটি। কলিকাতায় এলো নবকুমার। তার সাধ আছে, সাধ্য নাই, সাধনা তাহার চাইতেও কম। গদ্য পদ্য যাই হোক লিখতে গেলে পড়তে হবে… প্রচুর পড়তে হবে। তো সেই ছেলেটির পড়বার ধৈর্য নেই, রুচি নেই। রবীন্দ্রনাথ পড়েনি তেমন করে।শক্তি সুনীল দূরের কথা, সে প্রেমেন্দ্র অচিন্ত্য বুদ্ধদেব বিষ্ণু সুধীন এমনকি জীবনানন্দও পড়েনি। আধুনিক কাব্য ভাষার কিছুমাত্র জানে না।
তার সম্বল বলতে কানে শোনা ছন্দবোধ আর পল্লবগ্রাহিতা। না জানে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, রুদ্ধদল, মুক্তদল। বানানজ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবু সে ভান করে। কবি হিসেবে নিজেকে প্রচার করে। তার পকেটে থাকে বিচ্ছিরি অন্ত্যমিল দেওয়া চিরকুট। তার একমাত্র লক্ষ্য হল সেই অখাদ্য লেখাগুলো তার নিজের শ্রেণীর কোনও অভাগাকে পাকড়াও করে শোনানো।
শ্রেণী কথাটা খেয়াল করতে হবে। স্পষ্ট শ্রেণী বৈষম্য ছিল সহপাঠীদের মধ্যে। ইংরেজি মাধ্যম কিম্বা কলকাতার নামী বাংলা মাধ্যম থেকে যারা এসেছে তাদের সঙ্গে বাকি মফস্বলিদের। যদিও কলেজ ইলেকশনে দাঁড়াতে হবে বলে যথেষ্ট তাচ্ছিল্য সহ্য করেও আলাদা গ্রহের সেই তাদের সঙ্গেও ভাব করতে হয়েছিল মফস্বলের সেই সদ্য যুবককে।
ইতিমধ্যে বছরগুলো যেন মেল ট্রেনের মত বেরিয়ে গেল। দেরি করে যদিও, পরীক্ষা পাশ হল। চাকরি হল। দূর সীমান্ত গ্রামের হেলথ সেন্টারে কাজ করা হল। অবসরে তাস খেলা হল।
তার মধ্যে লেখা লেখা খেলা আর লোককে ধরে ধরে তা পড়ানোর চেষ্টাও জারি রইল। কিন্তু হায়, সেই কাটাকুটি খেলা গুছিয়ে রাখা হল না। সংসার যাপন হল। অফিসে অ্যাসেট স্টেটমেন্ট জমা দেওয়া হল। কিন্তু সেই লেখাগুলো গুছিয়ে রাখা হল না।
না একটাও নেই। ১৯৬৯ থেকে ২০০৪ অবধি একটা লেখাও নেই। কিছু লেখা জমা ছিল তিন বছরের জুনিয়র শম্ভু মৈত্রর স্মৃতিতে। হায়! সেও তো কবেই মারা গেছে! খুব চেষ্টা করলে কয়েকটা লাইন ছেঁড়া ছেঁড়া মনে পড়ে।
★
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
আজ যমুনার শরীর দখল খিদের সুযোগ নিয়ে।
যমুনা মেয়ে… না,
তোকে মরতে দেব না
নতুন করে বেঁচে উঠুক আগুন-কন্যা।
ধান রাখতে বাপ মরেছে
ভাইটা আটক থানায়,
অশ্রু নিবিড় দুই চোখে তোর
কান্না কি আর মানায়?
এই লেখাটা অনেক বড় ছিল। শম্ভু জানত পুরোটা।
★
আর একটা,
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, কদম তলায় কে?
সৈন্য এলো, সেপাই এলো। রাজা এসেছে।
রাজা এসেছে সাজা এসেছে। আমার তাতে কী?
মো সাহেবির তাজা ইনাম পান্তা ভাতে ঘি!
ঘর পুড়িয়ে কর দিয়েছি। জ্বলেছে জাঁক জমক।
অবাধ্যতার পরেই আসে কড়া গলার ধমক।
রাজামশাই দেয় না কিছুই এমন কে বলে!
আমার খোকা আগুন খেলো ভাতের বদলে।
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে?
আমার ছেলের মরা শরীর ঘুমিয়ে রয়েছে।
এরপরের কয়েকটা লাইন ভুলে গেছি। শেষ দু লাইনে ছিল…
আবার যখন জাগবে ছেলে, সঙ্গে যাবে কে?
পাড়াপড়শি হাড় হাতিয়ার শানিয়ে রেখেছে।
আমার নিজের হাতে লেখা একটা দেওয়াল পত্রিকা সাঁটতাম লাইব্রেরি ঢোকার মুখটায়। তার ট্যাগ লাইনের জন্য তিরস্কৃত হয়েছিলাম আমার সিনিয়র হিরো অমিত পানের কাছে। সেই ট্যাগ লাইন ছিল, কবিতায় রাজনীতি নয়, রাজনীতিতে কবিতা আনুন।
নিজেই নানান কল্পিত নামে লিখতাম পুরোটা। দু একটা নমুনা মনে পড়ছে
যাবি বুঝি ডাইনে?
বকশিস তাই নে।
রাস্তার বামদিক
চিরকাল দাম দিক।
আর একটা,
কোন কারণে মরেছে এ
অপুষ্টি না ভাত না খেয়ে
মন্ত্রী বলেন অল্প হেসে
বার করে তাঁর শ্বদন্ত
দিল্লি থেকে করব এসে
সরেজমিন তদন্ত!
আমার সেই একক প্রয়াসের নাম রেখেছিলাম ইস্তেহার।
এরই আগে পরে মহিম হালদার স্ট্রিটে থাকা আমার প্রাণের বন্ধু অমিতাভ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় বার করেছিলাম আট ভাঁজের এক ম্যাগাজিন। নাম মাস্তুল।
বলতে ভুলেছি, এরও বহু আগে আর একটা ব্যর্থ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। হিন্দু হোস্টেলে সহপাঠী যে মেডিকেল ছাত্ররা থাকত, আশিস ঘোষ ইত্যাদি তাদের সঙ্গে কিছু নন মেডিকেল বন্ধু মিলে সেই চেষ্টা। আক্ষরিক অর্থেই আট আনা একটাকা চাঁদা তুলেছিলাম। সেই তহবিল নিয়ে নন মেডিক্যাল দেবদাস কানপুর আইআইটি চলে গেল। ম্যাগাজিন বেরোলো না। কিন্তু বেশ কষ্ট করে সেই চাঁদা ফেরত দেওয়া হয়েছিল। সেই না বেরোনো ম্যাগাজিনের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে ঢাকুরিয়ায় কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। দেবদাস, হ্যাঁ দেবদাসই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, – ডাক্তারি ছাত্রদের কী ধরণের বিপ্লবী কবিতা লেখা উচিত।
তিনি খুব আগ্রহী ভাবে বলেছিলেন, – ডাক্তারি ছাত্র কুষ্ঠ রোগের একটা ভালো ওষুধ বার করুক। সেটাই হবে তার লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতা।
সেই থেকে অনবরত না হোক টুকরো টাকরা লিখেই গেছি। কিচ্ছুটি নেই। এই রকম গেল কিছুই সঞ্চয়ে না রেখে, ২০০৪ সাল অবধি।তার পরের কিছু লেখা হয় তো আছে। সব নেই। কেন নেই? গৃহিণীপনার অভাব। সঞ্চয়ে অনীহা।
আর আমার লেখার প্রথম পাঠক? কে আবার, আমি নিজেই। তার পরে দ্বিতীয় তৃতীয়কে ঘায়েল করার অভিযান, তারা ভয়ে সটকে পড়ার আগেই। এ সব সেই বহু আগের কথা।
এখন ফেসবুক হয়েছে। তার আগে অর্কুট। এখন লিখে ফেসবুকের দেওয়ালে সাঁটাই। কেউ পড়ুক না পড়ুক, আত্মাটি শান্ত হয়!
না, আমার সহপাঠিনী সুনন্দা… যিনি পরে আমার গৃহিণী হয়েছেন, আমাদের যৌথ লড়াইয়ের কম্যান্ডারও বটেন, তিনি কখনওই আমার লেখার প্রথম পাঠিকা হবার আগ্রহ দেখাননি। তিনি কবিতা বলতে বোঝেন আমাদের এই অসফল লড়াইয়ের ময়দানটিকে। যাকে আমরা সংসার বলে ডাকি।
উত্তরের পরবর্তী অংশ এর পরে দেবো।