৩০ বছর আগে যাঁর হত্যায় আলোড়িত হয়েছিল সারা দেশ, তাঁর ৩০ তম শহীদ দিবস পেরিয়ে যাবে প্রায় নিঃশব্দে।
আইএসসি পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েও সে সুযোগকে প্রত্যাখান করে শ্রমিকের জীবন বেছে নেওয়া, কেননা সে সুযোগের পেছনে সুপারিশ ছিল!
শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে করতে উচ্চশিক্ষার প্রয়াস, একই সঙ্গে ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা!
মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরেও আজীবন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে গণ-আন্দোলনে প্রয়োগ করে চলা! কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিন ধারার মধ্যে দিয়ে চলে নিজে এক নতুন ধারা হয়ে ওঠা!
শ্রমিক আন্দোলনকে বেতন-বৃদ্ধি আর বোনাসের গন্ডি থেকে বার করে এনে শ্রমিকের সামগ্রিক বিকাশের আন্দোলনে পরিণত করা! অথচ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গরীব শ্রমিক-কৃষকের অনেকগুলো আর্থিক দাবীর আন্দোলনকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া!
লক্ষাধিক শ্রমিক তাঁর কথায় প্রাণ দিতে পারত, তাঁর আচার-আচরণ, হাব-ভাবে তাঁকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করা যেত না! ইউনিয়নগুলোর সম্পত্তি যখন বেশ কয়েক লক্ষ টাকার তখনও তিনি সপরিবারে থাকতেন একটা মাটির দোচালা ঘরে, পরতেন খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবী, কখনও তা ফাটা আধময়লা, পায়ে রবারের চপ্পল বা কমদামী কেডস! তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন করে দল্লী-রাজহরার লোহাখনির ঠিকাদারী শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরী ২-৩টাকা থেকে বেড়ে ৯০টাকারও বেশী হয়েছিল, অথচ মৃত্যুর আগে প্রতি মাসে সংগঠন থেকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে তিনি নিতেন মাত্র ৮০০টাকা!
সংগঠনের কাজ সেরে বাড়ী ফিরতেন মাঝ রাতে, অথচ সকালে উঠে ঠিক একটু সময় বার করে নিতেন ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য বা বাড়ীর পেছনের তরি-তরকারির বাগিচার পরিচর্যার জন্য!
আন্দোলনের ময়দানে অজেয় সেনাপতি, আবার কাজের ফাঁকে খাতা-কলম খুলে কবিও!
শেখার কোনও শেষ ছিল না তাঁর, তাই প্রায় তিরিশ বছর শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েও মৃত্যুর দিনে তাঁর মাথার পাশে খোলা ছিল লেনিনের ‘অন ট্রেড ইউনিয়ন্স’!
এমনটা বোধহয় হওয়া সম্ভব ছিল একজনের পক্ষেই, যাঁর নাম শংকর গুহ নিয়োগী। ৪৯ বছর বয়সেই তিনি ছত্তিশগড়ের প্রবাদ-পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। অডিওভিস্যুয়াল মিডিয়ার রমরমার সেই আগের যুগে ছত্তিশগড়ের বাইরে কম লোকই তাঁকে জানতেন। ১৯৯১-এর ২৮শে সেপ্টেম্বর ভিলাইয়ের মিল-মালিকেরা তাঁকে গুলি করে মারার পর তিনি হয়ে ওঠেন এক অপ্রতিরোধ্য ধারার নাম, সারা দেশের মানুষ যাঁকে এক ডাকে চিনতেন।
তাঁর আসল নাম ধীরেশ গুহ নিয়োগী। আত্মগোপনের সময় নাম নেন শংকরলাল ঠাকুর। শ্রমিক-কৃষকেরা তাঁকে ডাকতেন ‘নিয়োগী ভাইয়া’ বলে। আদিবাসীরা বলতেন ‘বাইগা’, বাইগা আদিবাসী সমাজের অপরিহার্য পুরুষ, সমস্ত সামাজিক কাজে যাঁর অগ্রণী ভূমিকা। একটু পরিশীলিতদের মুখে তিনি ‘নিয়োগীজী’।
১৯৪২-এর ১৮ই সেপ্টেম্বর এক বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ধীরেশের, বাবা—হেরম্ব কুমার, মা—কল্যাণী। অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলায় মামার বাড়ীতে তাঁর জন্ম। আসামের নওগাঁও জেলায় বাবা ছোটখাট ঠিকাদারী করতেন। সেখানেই ধীরেশের প্রাথমিক শিক্ষা। আসামের সুন্দর প্রকৃতি তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমী করেছিল। আর আসানসোলের সাঁকতোড়িয়া কয়লাখনি অঞ্চলে জ্যেঠামশাইয়ের কাছে থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার সময় তিনি খনিশ্রমিকদের জীবনকে কাছ থেকে দেখেন—বুঝতে শেখেন আজকের সমাজ কেমন করে বড়লোককে আরও বড়লোক, গরীবকে আরও গরীব করে তোলে।
ছাত্রজীবনে ইতিহাসে পড়া স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের বীরগাথা তাঁকে দেশপ্রেমিক করে তোলে। ইতিমধ্যে আসামের জাতিদাঙ্গায় বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁর পরিবার জলপাইগুড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জলপাইগুড়িতে ধীরেশ আই এস সি পড়েন। ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ ধীরেশকে ভাসিয়ে নেয়, তিনি ছাত্র ফেডারেশনের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। কুশল ছাত্র-সংগঠক হিসেবে তিনি সিপিআই-এর ছাত্র-সদস্যপদ লাভ করেন।
আন্দোলনে মেতে থাকায় ধীরেশের আইএসসি-র ফল ভালো হয় নি। এর বছর কয়েক আগে জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়েছে। ধীরেশের এক জ্যাঠামশাই ছিলেন জেলা কংগ্রেসের উচ্চ পদাধিকারী। তাঁর সুপারিশে, বাড়ীর চাপে ধীরেশ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি তো হলেন, কিন্তু এই অন্যায় মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। তাই সবার অলক্ষ্যে বাড়ী ছেড়ে ভিলাই-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা, ভিলাই ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন তাঁর এক আত্মীয়।
১৯৬১-র কথা—তখনও ভিলাই ইস্পাত কারখানায় চাকরী পাওয়া দুষ্কর ছিল না। কিন্তু ধীরেশের বয়স ছিল সে সময় সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর থেকে কয়েকমাস কম, তাই কিছুদিন অপেক্ষা করতে তারপর প্রশিক্ষণের শেষে কোক ওভেন বিভাগে দক্ষ শ্রমিকের চাকরী পেলেন তিনি। উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষাও ছিল, তিনি দুর্গের বিজ্ঞান কলেজে প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে বিএসসি এবং এএমআইই পড়তে লাগলেন। কলেজে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ধীরেশ। সেই কুশল নেতৃত্বের খবর পেয়ে এলেন দুর্গ পুরসভার সাফাইকর্মীরা। তাঁর নেতৃত্বে ধর্মঘট করে তাঁরা দাবীদাওয়া আদায় করেন। ইস্পাত কারখানার স্বীকৃত ইউনিয়ন ছিল আইএনটিইউসি-র। তারপর বড় ইউনিয়ন এআইটিইউসি। নিয়োগী এআইটিইউসি-র সঙ্গে থেকেও স্বাধীনভাবে শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা-সমাধানে সংগঠিত করতে থাকেন।
১৯৬৪ সালে সিপিআই-এর ভাঙ্গনের পর সিপিআইএম-এর সাথে আসেন ধীরেশ। সে সময় প্রবীণ কমিউনিস্ট চিকিৎসক ডা বি এস যদুর কাছে তাঁর প্রথাগত মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের পড়াশুনা। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ির গণঅভ্যুত্থান মধ্যপ্রদেশকেও আলোড়িত করেছিল, রাজ্যের প্রায় সমস্ত সিপিআইএম কর্মী নকশালবাড়ীর রাজনীতিতে প্রভাবিত হন। ধীরেশ অল ইন্ডিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি অফ কমিউনিস্ট রেভোলিউশনারিস-এর সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৯-এ সিপিআইএমএল গঠিত হওয়ার পর কিছুদিন তিনি তার সঙ্গেও ছিলেন। কিন্তু পার্টির গণসংগঠন-গণআন্দোলন বর্জনের লাইনের সঙ্গে নিজের কাজকর্মকে মেলাতে না পারায় তিনি পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন।
ইতিমধ্যে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে—১৯৬৮-তে ভিলাই ইস্পাত কারখানার প্রথম সফল ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়ে চাকরী খুইয়েছেন ধীরেশ। অন্যদিকে ‘নকশালপন্থী’ তকমা লাগিয়ে খুঁজছে পুলিশ। এই সময় তিনি আত্মগোপন করে একটা হিন্দী সাপ্তাহিকের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে বক্তব্য নিয়ে যেতে থাকেন, লেনিনের ‘ইস্ক্রা’র অনুপ্রেরণায় পত্রিকার নাম রেখেছিলেন ‘স্ফুলিঙ্গ’। অন্যদিকে চলে গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি। এই সময় তিনি বুঝতে পারছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে শোষিত ছত্তিশগড়ী জাতিসত্ত্বার মেলবন্ধন ঘটাতে না পারলে শ্রমিক আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পারে না। ছত্তিশগড়ী জাতি-সমস্যা নিয়ে রচিত তাঁর সে সময়কার একটা পুস্তিকা মহারাষ্ট্র থেকে ছেপে আসার পথে পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে।
ছত্তিশগড়কে ও ছত্তিশগড়ী জনতাকে জানার জন্য, তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য ১৯৬৮ থেকে তিনি গ্রামে-গ্রামে আত্মগোপন করে দিন কাটাতে থাকেন। কখনও গ্রাম থেকে ছাগল কিনে বিক্রি করতে যান দুর্গ-ভিলাইয়ে, সেখানে সাথীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায় সেভাবে। কখনও ফেরিওয়ালা, কখনও জেলে, কখনও বা পিডব্লুডি-র শ্রমিক। সাথে সাথে চলে মানুষকে সংগঠিত করার কাজ—দৈহান বাঁধ তৈরীর আন্দোলন, সেচের জলের দাবীতে বালোদের কৃষকদের আন্দোলন, মোঙ্গরা বাঁধ তৈরীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন…।
১৯৭১-এ কাজ পেলেন ভিলাই ইস্পাত প্রকল্পের দানীটোলা কোয়ার্জাইট খনিতে, কোক ওভেনের দক্ষ শ্রমিক হাফপ্যান্ট পরে পাথর ভাঙ্গেন। ‘শংকর’ এই সময়কারই ছদ্মনাম। এখানেই পরিচয় ও পরিণয় সহশ্রমিক সিয়ারামের কন্যা আশার সঙ্গে। তাঁর তৈরী প্রথম খনিশ্রমিকদের ইউনিয়নও দানীটোলায়, যদিও তা এআইটিইউসি-র ব্যানারে। ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার সময় মিসা-এ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে অবধি দানীটোলাতেই শ্রমিক সংগঠন করতেন নিয়োগী।
ভিলাই ইস্পাত প্রকল্পের সবচেয়ে বড় লোহাপাথর খনি দল্লী-রাজহরায়। নিয়োগী যখন রায়পুর জেলে বন্দী, তখন দল্লী-রাজহরার ঠিকাদারী খনিশ্রমিকরা উত্তাল স্বতঃস্ফূর্ত এক আন্দোলনে। আইএনটিইউসি ও এআইটিইউসি নেতৃত্ব ভিলাই ইস্পাতের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে এক বোনাস সমঝোতা করে—স্থায়ী শ্রমিকরা পাবেন ৩০৮ টাকা আর ঠিকাদারী শ্রমিকরা ৭০ টাকা, যদিও দুই ধরনের শ্রমিকরা একই ধরনের কাজ করেন। অন্যায় চুক্তির প্রতিবাদে শ্রমিকরা এই দুই ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলেন। জরুরী অবস্থার শেষ সময় সেটা—১৯৭৭-এর ৩রা মার্চ শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে লাল ময়দানে শুরু করেছেন অনির্দিষ্টকালীন ধর্না। তাঁরা খুঁজছেন কে হবেন তাঁদের সেনাপতি, কে নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের। শ্রমিকদের উগ্রমূর্তি দেখে সিআইটিইউ, এইচএমএস, বিএমএস—কোনও ইউনিয়নের নেতাই ধারে ঘেঁষার সাহস পাননি। জরুরী অবস্থার শেষে জেল থেকে ছাড়া পেলেন শংকর। দল্লী-রাজহরা থেকে দানীটোলার দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। এআইটিইউসি থেকে বেরোনো কিছু শ্রমিক সৎ লড়াকু শ্রমিক নেতা হিসেবে নিয়োগীকে জানতেন। তাই শ্রমিকদের এক প্রতিনিধিদল নিয়োগীকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ করতে দানীটোলা গেল। তাঁদের অনুরোধে নিয়োগী এলেন, গঠিত হল ঠিকাদারী খনিশ্রমিকদের স্বাধীন সংগঠন—ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ (সিএমএসএস)। নতুন ইউনিয়নের পতাকা লাল-সবুজ—লাল শ্রমিকশ্রেণীর আত্মবলিদানের রং, সবুজ কৃষকের।
শংকর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে খনিশ্রমিকদের প্রথম লড়াই ছিল মর্যাদার লড়াই—তাঁরা দালাল নেতাদের সই করা চুক্তি মানবেন না। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে তাঁরা ৭০ টাকার জায়গায় ৫০ টাকা বোনাস বাবদ নিলেন।
১৯৭৭-এর মে মাসে শুরু হলে আইডল ওয়েজ (মালিক শ্রমিককে কাজ দিতে না পারলে যে বেতন দেওয়া উচিত) এবং বর্ষার আগে ঘর-মেরামতের বাঁশবল্লী বাবদ ১০০ টাকার দাবীতে আন্দোলন। আন্দোলনের চাপে ৩১শে মে শ্রমবিভাগের আধিকারিকদের উপস্থিতিতে ভিলাই ইস্পাত প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদাররা সিএমএসএস-এর সঙ্গে চুক্তিতে এই দুই দাবী মেনে নেয়। কিন্তু ১লা জুন শ্রমিকরা যখন ঘরমেরামতের টাকা আনতে যান তখন ঠিকাদাররা তা দিতে অস্বীকার করে। আবার শুরু হয় শ্রমিক-ধর্মঘট।
২রা জুন রাতে দু’ জীপ ভর্তি পুলিশ আসে নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করতে। ইউনিয়নের ঝুপড়ি থেকে নিয়োগীকে তুলে নিয়ে একটা জীপ বেরিয়ে যায়। অন্য জীপটা বেরোনোর আগে শ্রমিকদের ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাঁরা বাকী পুলিশদের ঘিরে ফেলে নেতার মুক্তির দাবী করতে থাকেন। পুলিশ গুলি চালিয়ে নারী-শ্রমিক অনুসূইয়া বাই ও বালক সুদামা সহ মোট ৭ জনকে হত্যা করে সে রাতে, কিন্তু নিজেরা মুক্ত হতে পারে না। ৩রা জুন দুর্গ থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে আরও ৪ শ্রমিককে হত্যা করে আটক পুলিশদের মুক্ত করে। এই ১১ জনই হলেন লাল-সবুজ সংগঠনের প্রথম শহীদ।
পুলিশী অত্যাচার কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। ১৮দিন লম্বা ধর্মঘট চলার পর খনি-ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদাররা আবার শ্রমিকদের দাবী মেনে নেয়। জেল থেকে ছাড়া পান নিয়োগী।
এই বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে ভিলাই ইস্পাত প্রকল্পের অন্যান্য খনি দানীটোলা, নন্দিনী, হিররীতে গড়ে ওঠে সিএমএসএস-এর শাখা। সব শাখা মিলে আবার আন্দোলনের ঢেউ, আবারও বিজয়…।
পাশের জেলা বস্তারের বাইলাডিলা লোহাখনিকে পুরোপুরি মেশিনীকৃত করার উদ্যোগ নেয় ম্যানেজমেন্ট, যার ফলে শ্রমিকরা ছাঁটাই হবেন। মেশিনীকরণকে ঢেকাতে এআইটিইউসি-র নেতৃত্বে বাইলাডিলার শ্রমিকরা লড়াই করছিলেন, তাঁদের ওপর গুলি চালায় জনতা সরকারের পুলিশ, ১৯৭৮-এর ৫ই এপ্রিল। তাঁদের পাশে দাঁড়ান দল্লী-রাজহরার শ্রমিক, পাশাপাশি নিয়োগী তাঁদের বোঝান করান দল্লী-রাজহরার আসন্ন মেশিনীকরণের বিপদ সম্পর্কে। শ্রমিকরা মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে ম্যানেজমেন্টকে বাধ্য করে ইউনিয়নের ‘অর্ধ-মেশিনীকরণের প্রস্তাব’ মেনে নিতে—যাতে শ্রমিক ছাঁটাই হবে না, অথচ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগত মান উন্নত হবে।
একের পর এক অর্থনৈতিক আন্দোলনে বিজয়ের ফলে দল্লী-রাজহরার শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী একলাফে অনেকটা বাড়ে, কিন্তু জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় না। বরং শ্রমিকরা মদের পেছনে পয়সা খরচ করা বাড়িয়ে দেন। নিয়োগী প্রশ্ন তোলেন—তাহলে কি শহীদদের রক্ত মদের ভাটিখানার নালায় বইবে? এক অভিনব শরাববন্দী আন্দোলনে প্রায় এক লক্ষ মানুষ মদের নেশা থেকে মুক্ত হন। অবশ্য এ আন্দোলন চালাতে গিয়ে ১৯৮১-তে নিয়োগী এন এস এ-তে বন্দী হতে হয় শংকর গুহ নিয়োগীকে।
নিয়োগী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেন। এত দিন অবধি কোন ইউনিয়নই বেতন-বৃদ্ধি, বোনাস দাবী করা বা চার্জশিটের জবাব দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ করত না, অর্থাৎ শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত বিষয়গুলোই ছিল কেবল ট্রেড ইউনিয়নের আওতায়। নিয়োগী বললেন ট্রেড ইউনিয়ন কেবল শ্রমিকের দিনের আট ঘন্টা (কর্মসময়)-এর জন্য নয়, ইউনিয়নকে হতে হবে ২৪ ঘন্টার জন্য। এই ভাবনা নিয়ে দল্লী-রাজহরায় অনেকগুলো নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় নতুন ইউনিয়ন।
শ্রমিকদের বাসস্থানের উন্নতির জন্য গঠিত হয় মোহল্লা কমিটি। ইস্পাত প্রকল্পের চালানো স্কুলে ঠিকাদারী শ্রমিকদের শিশুদের পড়ার ব্যবস্থা ছিল না, তাদের শিক্ষার জন্য ইউনিয়ন গড়ে তোলে ৬টা প্রাইমারী স্কুল, নিরক্ষর শ্রমিকদের জন্য বয়স্ক শিক্ষার কর্মসূচী নেওয়া হয়। এই কর্মসূচীর চাপে সরকার ও খনি-ম্যানেজমেন্ট বাধ্য হয় শহরে অনেকগুলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল খুলতে। স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু হয় সাফাই আন্দোলনের রূপ নিয়ে, ১৯৮২-র ২৬শে জানুয়ারী শুরু হয় শহীদ ডিস্পেন্সারীর কাজ, ১৯৮৩-র শহীদ দিবসে ’৭৭-এর শহীদদের স্মরণে শহীদ হাসপাতাল। শ্রমিকদের অবসর-বিনোদন এবং সুস্থ সংস্কৃতির প্রসারের জন্য গড়ে ওঠে নয়া আঞ্জোর (নতুন সূর্যকিরণ) সাংস্কৃতিক সংস্থা। শরীর-চর্চার জন্য গড়ে ওঠে শহীদ সুদামা ফুটবল ক্লাব, রেড-গ্রীন এথলেটিক ক্লাব । নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্য গড়ে ওঠে মহিলা মুক্তি মোর্চা। ছত্তিশগড়ের শোষণ-মুক্তি ও শ্রমিক-কৃষকের রাজ স্থাপনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। সরকারের জনবিরোধী বননীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইউনিয়ন দপ্তরের পিছনে এক মডেল বন-সৃজন করা হয়।
নিয়োগীর অভিনব নেতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে ছত্তিশগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ লাল-সবুজ পতাকা তুলে হাতে নিতে থাকেন। সে সময় ছত্তিশগড় ছিল মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সাতটা জেলা নিয়ে, তার মধ্যে পাঁচটায়—দুর্গ, বস্তার, রাজনাদগাঁও, রায়পুর, বিলাসপুরে সংগঠন ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে ছিলেন ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে পুরোনো কারখানা রাজনাদগাঁও-এর বেঙ্গল নাগপুর কটন মিলস-এর শ্রমিকরাও, তাঁদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায় ১৯৮৪-র ১২ই সেপ্টেম্বর, শহীদ হন চার জন, কিন্তু আন্দোলন জয়যুক্ত হয়।
শংকর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে লড়া শেষ সংগ্রাম ছিল ভিলাই শ্রমিক সংগ্রাম। এ লড়াই কারখানা মালিকদের আতঙ্কিত করে তোলে। অথচ খুবই সাধারণ ছিল শ্রমিকদের দাবীগুলো—বেঁচে থাকার মতো বেতন, স্থায়ী শিল্পে স্থায়ী চাকরী, ইউনিয়নে সংগঠিত হওয়ার অধিকার। খনিজ, বনজ ও জল সম্পদে ভরপুর ছত্তিশগড় আবার সস্তা শ্রমেরও জোগানদার। সেখানে শ্রমিকদের এ ধরনের দাবী মেনে নেওয়ার ফল সুদূরপ্রসারী ও মালিকপক্ষের পক্ষে ভয়ংকর। তাই আন্দোলনকে ভাঙ্গতে হাত মেলায় পুলিশ-প্রশাসন-প্রায় সব রাজনৈতিক দল।
শ্রমিক নেতাদের ওপর গুন্ডা ও পুলিশের হামলা, ১৯৯১-এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী থেকে ৩রা এপ্রিল পুরোনো মামলার ওয়ারেন্ট বার করে নিয়োগীকে বন্দী করে রাখা, নিয়োগীকে পাঁচ জেলা থেকে বহিষ্কারের প্রয়াস—কোনও কিছুই আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। আন্দোলনের পক্ষে দেশের জনমত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেপ্টেম্বরের প্রথমে নিয়োগীর নেতৃত্বে এক বিশাল শ্রমিক দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে ডেপুটেশন দিয়ে এল। তার পক্ষকাল পরে ২৮শে সেপ্টেম্বর নিয়োগীকে হত্যা করে কারখানা মালিকের গুপ্ত-ঘাতক।
তাঁর হত্যার অনেক আগেই নিয়োগী জানতে পেরেছিলেন হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা, তবু আসন্ন অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি ছিলেন অবিচল, কেন না—‘মৃত্যু তো সবারই হয়, আমারও হবে। আজ, নয় তো কাল।…আমি এ পৃথিবীতে এমন এক ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাই যেখানে শোষণ থাকবে না…। আমি এ সুন্দর পৃথিবীকে ভালোবাসি, তার চেয়েও ভালোবাসি আমার কর্তব্যকে। যে দায়িত্ব আমি কাঁধে নিয়েছি, তাকে সম্পন্ন করতেই হবে। …আমাকে মেরে আমাদের আন্দোলনকে শেষ করা যাবে না।’
না শেষ করা যায় নি, নিয়োগীর পায়ে পা মিলিয়ে ১৯৯২-এর ১লা জুলাই শহীদ হয়েছেন ভিলাইয়ের ১৬জন শ্রমিক, তার পরও নয়। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা দুর্বল হয়েছে, ভেঙ্গেছে। কিন্তু সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে কাজ করে চলেছেন অনেক মানুষ, তাঁদের মধ্যেই অমর হয়ে রয়েছেন শংকর গুহ নিয়োগী।
অসামান্য।
শোষিত শ্রমজীবি শ্রমিককৃষকের মুক্তির দাবিদার শঙ্কর গুহনিয়োগী অমর রহে।