সিঙ্গাপুরে তো লকডাউন-টকডাউন সব উঠে গেল। এখনও কিছু রেস্ট্রিকশন আছে, তবে সে নগণ্য। যেমন সেদিন ছেলে রেস্টুরেন্ট থেকে ছবি পাঠাল। টেবিল ভর্তি খাবার। প্রায় কুড়ি বাইশ প্লেট। আমরা আঁতকে উঠে বললাম, “এত খাবার কে খেল?”
উত্তর এল, “আমাদের সবাইকে আমাদের ‘বস্’ খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। বুফে সিস্টেম। কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখতে অতিথিদের বুফে টেবিলে যাওয়া বারণ। কী খাবে বললে ওয়েটার এনে দেবে। আমরা বাইশজন ছিলাম, তাই সবাই একটা একটা করে ডিশ অর্ডার দিতে সবসুদ্ধ এত খাবার এল যে খেয়ে শেষ করা দায় হয়েছিল।”
মনে পড়ল, সে বহু বহু বছর আগে – এই ছেলেই তখন ছোটো, ব্যাংকক থেকে ফেরার সময়ে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে আমার অভিজ্ঞতার কথা।
আমাদের পুরো দলটা বোধহয় ছিল জনা চল্লিশেকের। সবাই সবার বন্ধু নয় – আমাদের বন্ধুদের দলটা জনা আষ্টেকের। চেক ইন-এর সময়ে জানা গেল ফ্লাইট চার ঘণ্টা লেট। বোর্ডিং পাসের সঙ্গে একটা কুপন দেওয়া হলো, বলা হলো এয়ারপোর্টের কে.এফ.সি-তে আমরা কিছু আহার করতে পারি। সবাই খুব খুশি। “দেখলি, দাড়ি, থাই এয়ারওয়েজ কী ভালো। কে.এফ.সি-র কুপন দিয়েছে…”
ভালো কাজে দেরি করতে নেই, তাই আমরা সদলবলে প্রথমে গেলাম কে.এফ.সি-তেই। গিয়ে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা। কাউন্টারে খুব ভীড়, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না – কারণ একটা ইন্টার্ন্যাশনাল ফ্লাইটের সব যাত্রীই এসে জুটেছে কুপন হাতে, কিন্তু সেটা ভ্যাবাচ্যাকার কারণ না। খোলা কাউন্টারের পেছনের দেওয়ালে মেনু দেওয়া আছে – যেমন থাকে কে.এফ.সি-র সব দোকানেই। ডানদিকের সংখ্যাগুলো যেগুলো খাবারের দাম, সেগুলো সবকটাই দেখি আমাদের হাতে ধরা কুপনের চেয়ে বেশি। সহজ করে বলতে গেলে কুপন ব্যবহার করে খেতে গেলে যা-ই খাও, ট্যাঁকের টাকা দিয়ে ভর্তুকি দিতে হবে। একমাত্র কফি (বা চা) খেলে সামান্য কিছু উদবৃত্ত থাকবে, তা দিয়ে হয়ত মৌরি বা অন্য মুখশুদ্ধি কিনে খাওয়া গেলেও যেতে পারে – তবে সে তো কে.এফ.সি বিক্রি করে না।
সে এক সসেমিরা অবস্থা! আমাদের কারওর কাছেই আর বাহ্ট্ (থাইল্যান্ডের মুদ্রা) বাকি নেই। বড়োজোর বাড়িতে দেখানোর জন্য দু-একটা নোট কেউ কেউ নিয়ে যাচ্ছেন। তাতে কিছুই হবে না। ভারতীয় টিমটা হামলে পড়ল কাউন্টারে – দুটো প্রশ্ন – একটা আপনারা আন্দাজ করতে পারছেন – বাহ্ট্ শেষ। আপনারা কি ইন্ডিয়ান রুপিজ, বা অ্যামেরিকান ডলার নেবেন?
বলা বাহুল্য, নেবেন না। এটা ডিউটি ফ্রি শপ নয়। ফলে যান, ওই-ই-ই-খানে কারেনসি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার – ওখান থেকে এক্সচেঞ্জ করে আনুন।
এদিকে ন্যূনতম কারেনসি আমাদের কাছে $ ১০০। অত উদ্বৃত্ত বাহ্ট্ নিয়ে কী করব? যত বাহ্ট্ পাব, সবাই মিলে খরচা করলেও অনেক শো বাহ্ট্ পড়ে থাকবে – সেগুলো নিয়ে দেশে ফিরব নাকি? না আবার এক্সচেঞ্জ করে আবার এক্সচেঞ্জ-এর খেসারত দেব?
মনে হলো এই পরিস্থিতিটা কে.এফ.সি-র কর্মচারীদের পরিচিত, ওরা বেশ মজা-ই পাচ্ছে বিদেশী যাত্রীদের এই নিগ্রহে।
যে দ্বিতীয় প্রশ্নটা কে.এফ.সি-র কর্মচারীদের করা হচ্ছিল – তা খুব ভারতীয় এবং দোকানিরা, আমরা এর মধ্যে (জেনে গিয়েছি) এর উত্তরটা জানেন না। “ভেজেটেরিয়ান কেয়া হ্যায়?” এই প্রশ্নের উত্তর বিদেশে আজকাল তবু কেউ কেউ বোঝেন, তখন ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতেই বিদেশে লোকে ভেবলে যেত – বিশেষত দূর প্রাচ্যে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ধ্যেত্তেরি বলে খাওয়ার আশা ত্যাগ করে কাউন্টার ছেড়ে সরে যাচ্ছেন। আমিও প্রায় ঘুরতে যাব, এমন সময় বাপ্পাদা হঠাৎ, “দেখি, তোমার কুপনটা…” বলে প্রায় ছিনিয়ে আমার কুপনটা নিয়ে নিল। তারপরে এদিকে ওদিকে বাকি বন্ধুদের কাছ থেকে কুপন নিয়ে একসঙ্গে আটটা কুপন কাউন্টারে ফেলে একজন কর্মচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, “অ্যাই ব্যাটা, প্লিজ কাম হিয়ার…” বলে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি এই সবকটা কুপন একসঙ্গে দিই, তাহলে আমি একটা বিগ বাকেট চিকেন পেতে পারি?”
যে ‘ব্যাটা’ ডাক শুনে এগিয়ে এসেছিল, সে বলল, “অ্যাঁ, অ্যাঁ, হ্যাঁ…”
বাপ্পাদা বলল, “একটা বিগ বাকেটে কটা পিস থাকে?”
উত্তর শুনে বলল, “তাহলে আমাদের একটা বিগ বাকেট চিকেন, আর তারপরে কত পড়ে থাকে?”
ছেলেটা হিসেব করে একটা সংখ্যা বলল, বাপ্পাদা আবার মেনু দেখে বলল, “তাহলে একটা ওমুক দিন, আর একটা তমুক…”
ছেলেটা হঠাৎ উৎসাহ পেয়ে গেল। বলল, “আপনারা চা-কফি কিছু খাবেন না?”
বাপ্পাদা বলল, “হলে তো ভালো হত, কিন্তু আমাদের কাছে বাহ্ট্ নেই, আর এখন যাবার মুখে ডলার এক্সচেঞ্জ করব না।”
ছেলেটা বলল, “দরকার নেই। আপনি বরং এটা না নিয়ে ওটা নিন, আর সেটার বদলে… দাঁড়ান… ওমুকটা। তাহলে আপনার বেঁচে যাবে এত বাহ্ট্ তাহলে আপনি চারটে কফি পেয়ে যাবেন। ও, চারটেতে আপনাদের হবে না। তাহলে আপনারা এটা-এটা আর এটা নিন, তাহলে পাবেন পাঁচটা। না, তা-ও কম পড়বে…”
ছেলেটা উৎসাহভরে এটার সঙ্গে ওটা, সেটার সঙ্গে আর একটা কম্বিনেশন করে করে চেষ্টা করতে থাকল, কিন্তু পাঁচটা কফির বেশি আর বাড়াতেই পারছে না… এমন সময় আমাদেরই টিমের একজন গুজরাতি ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “এক্সকিউজ মি, আমার তো এখানে কিছুই খাওয়া হবে না, কিন্তু আমার দুটো কুপন রয়েছে, এই দুটো জুড়ে দিলে আপনাদের অনায়াসে সবার কফি হয়ে যাবে। আমি শুধু আমাদের নিজেদের জন্য দু-কাপ কফি নেব।”
আমরা ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে ওই দুটো কুপনও জুড়ে দিলাম, ছেলেটা তাতে বলল, “দাঁড়ান দাঁড়ান। তাহলে তো আরও বাহ্ট্ উদবৃত্ত হলো। আপনারা এক কাজ করেন…”
উৎসাহী ছেলেটার কল্যাণে বেশ অনেকটা খাবার, আর সবার জন্য চা/কফি নিয়ে আমরা কাউন্টারের সামনে রাখা টেবিল-চেয়ারে বসে ভুরিভোজ করলাম। কণিকাদি ছিলেন খাবার ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে, সবাই আর না, আর না করতে শুরু করায় বললেন, “এখানে এখনও বেশ কয়েকটা চিকেন পিস বাকি আছে। এগুলো দাড়ি নিয়ে যাবে। আমাদের মধ্যে একমাত্র ওরই ছোটো বাচ্চা আছে…”
ফলে বাড়ি এসেও কুপনের খাবার খাওয়া গেল।
শুধু বাপ্পাদা খেয়েদেয়ে প্লেনের দিকে যাবার সময় বলেছিল, “বুঝলে, পরে দেখছিলাম যে ছেলেটা আমাদের খাবার সার্ভ করল, তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কেউ একজন খুব কী বলল – বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে মনে হচ্ছিল বকুনি দিচ্ছে। কে জানে, হয়ত এর পর থেকে নিয়ম হয়ে যাবে যে কুপন একত্রিত করে খাবার কেনা যাবে না…