??????
???✂️? ?✒️⌚
?️???????
ভিখারিদাস আর ডাক্তার মৃত্যুচরণ দুই বন্ধু । বহুদিনের বন্ধু । সন্ধ্যে হলেই দুজনে মিলে বোতল খুলে বসেন । মৃত্যুচরণ বোতল কেনেন । ভিখারিদাসের সঙ্গেই বসে পান করেন । যদিও ব্যাপারটা ডাক্তার হিসেবে ঠিক উচিত নয় তবু আমরা এই দুই মাতাল বন্ধুকে ক্ষমা করে দিলাম । আর বেশী উপক্রমণিকা নয় । সরাসরি আলোচনায় আসা যাক ।
মৃত্যুচরণ || হ্যাঁরে ভিখারি তোর যেমনটি নাম ঠিক তেমনটিই তোর ব্যবহার । কোনদিন তো একটা বোতলও নিজে থেকে কিনে আনলি না ?
[ ভিখারিদাস একটা মোলায়েম হাসি হেসে গেলাসে মদের সঙ্গে পরিমানমতো সোডা মেশানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যেন কিছুই শোনেন নি। ]
মৃত্যুচরণ || শোন ভাই আজ কিন্তু খিস্তিখাস্তা করিস না । লেডিস লোক আমাদের কথা শুনবেন ।
ভিখারিদাস || ( মন্ত্রোচ্চারণের মতো বিড়বিড় করে মিনিটখানেক ধরে কী যেন বলে নিয়ে ) নেঃ মনে মনেই খিস্তিগুলো দিয়ে নিলাম । চল এবার উল্লাস করি …
মৃত্যুচরণ || (গেলাস মুখে তুলে ) মনটা ভালো লাগছে না রে .. মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি ..
ভিখারিদাস || তাহলে প্লিজ বাইরে গিয়ে চেঁচিয়ে আয় এখানে চেঁচামেচি অ্যালাওড নয় .. আমার আবার হার্ট দুর্বল কিনা তাই । কিন্তু তুই খামাখা কাঁদবিই বা কেন ?
মৃত্যুচরণ || আর বলিস না … ভয়ঙ্কর দুর্যোগ ..করোনা আর ঐ যে পরিযায়ী শ্রমিকরা..
ভিখারিদাস || ( মাঝ পথে বাধা দিয়ে ) শাটাপ …একদম শাটাপ … পরিযায়ী ? কে পরিযায়ী ? পরিযায়ী মানে জানিস শালা ? যারা বছরে একবার বা দুবার বেড়াতে যায় যেমন ধর সাইবেরিয়া থেকে আসা কিছু পাখি বা অ্যাফ্রিকার সেরেঙ্গেটিতে বুনো জন্তুদের জলের খোঁজে অন্য দেশে যাওয়া – দ্য গ্রেট মাইগ্রেশন। পরিযায়ীর ইংরেজি শব্দটা হলো মাইগ্রেটরি । আর যারা পেটের দায়ে অন্য দেশে এসে অনেক দিন ধরে সেখানে থেকে কাজ করে তারা অভিবাসী .. । যেমন বেঙ্গালুরুতে তোর মেয়ে চাকরি করে ও হলো অভিবাসী । বুঝলি ?যেমন দিনমজুরি করা মানুষগুলো যারা দূর দূরান্তে গিয়ে টাকা উপার্জন করতো এখন করোনার ঠেলায় লক ডাউনে পায়ে হেঁটে হেঁটে হাজার হাজার মাইল পার হচ্ছে … শুধু নিজের বাড়ি ফেরার জন্য….
মৃত্যুচরণ || (একটা বড় চুমুক দিয়ে ) আরে ওসব ব্যাকরম ট্যাকরম মানি না । হাঁসজারু ভাষাই এখন ভালো চলে । তারপর ধর এই আম্পুনের জন্যে ছিন্নমূল মানুষগুলো – …আর তুই বোতল নিয়ে বসে আছিস ? এদের কথা ভেবেছিস কখনও ?
ভিখারিদাস || ( সমনোযোগে একটা মশা মারার ব্যর্থ প্রয়াস করে ) এই যে তোদের ভাষায় পরিযায়ী আর ছিন্নমূল সব লোক ? এদের জন্যে তোরা কী ভেবেছিস রে ? একটু বল না শুনি….
মৃত্যুচরণ || আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওদের কাছে চাল ডাল টাকা পৌঁছে দেবো … একদম সিস্টেম মেনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে … বুঝলি ? খালি খিস্তি মারলেই হয় না …. দিল লাগে .. একটা বড়ো দিল ( মৃত্যু নিজের বুকে থাবড়া মারেন)
ভিখারিদাস || ( গেলাসটা হাতে শক্ত করে ধরে ) হুম মহত্বগিরি আনলিমিটেড । ভাই আমি তো ভিখারি .. জন্মভিখারি – আর ঐ অভিবাসী মানুষগুলো যারা তোদের ভাষায় পরিযায়ী ? আর কী যেন বলে ? হ্যাঁ হ্যাঁ ছিন্নমূল .. এরাও বুঝি সব ভিখারি ? ওদের তোরা ভিক্ষে দিবি ? লাইনে দাঁড় করিয়ে .. শাল্লা ( এক চুমুকে গেলাসটা খালি করে উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃত্যুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন )
মৃত্যুচরণ ||( দৃশ্যতঃই অপ্রস্তুত হয়ে ) না না ভিখারি তো তুই ..ওরা ভিখারি নয় ওরা আমার দেশের নাগরিকবৃন্দ – নাগরিকবৃন্দ বুঝলি ?
ভিখারিদাস || ( মাপ মতোর থেকেও বেশী করে মদ ঢেলে সোডা মেশাতে মেশাতে ) তোর এখানে এসে বেশ ঠান্ডা মেশিন চালিয়ে দামী বিলাইতি , সঙ্গে বরফকুচি মুরগির কেবাব স্যালাড ….হেব্বি তাই না ?
মৃত্যুচরণ || ( গর্ব ঈষৎ গোপন করে ) তুইই তো আমার একমাত্র পুরোনো বন্ধু (একটা ছোট্ট সাহেবি নিঃশব্দ সিপ দেন মদে )সেই জন্যেই তোর জন্য এসবের একটু ইয়ে করি আর কি ….
ভিখারিদাস|| হ্যাঁ ব্বে নাগরিকের ছা ? তোর ঘরে এসি চলে , স্কচ চলে আর ও শালাদের ঘর ভাঙে ফী বছর .. কেন রে ? ওরাও তো তোর আমার মতই এই ভারতের ম্যাপের ভেতরে থাকা নাগরিক .. ওদের ঘর নেই কেন ?
মৃত্যুচরণ||( একটু ভেবে ) দ্যাখ ওরা তো লেখাপড়া শেখে নি – যদি শিখতো তাহলে ওরাও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জজ ব্যারিস্টার হতে পারতো – বড়ো বড়ো চাকরি বাকরি করতো – বড়ো বড়ো মাইনে পেতো …. শিক্ষারও তো একটা মূল্য থাকা উচিত , ঠিক কি না ?
ভিখারিদাস || ঠিক । এটা তুই ঠিকই বলেছিস ( কাঁটাচামচ দিয়ে একটা কেবাব মুখে তোলেন ) তা ওরা সবাই চাকরি করলে তখন তোর এই কেবাব স্যালাডের শসা পেঁয়াজ মুরগি এসব কে সাপ্লাই করতো ? তোর ভাত খাওয়ার বাসমতি চালটা কি তুই নিজেই মাঠে গিয়ে চাষ করতিস ?
মৃত্যুচরণ || ( একটু অপ্রস্তুত হয়ে ) তাহলে তুইই বল ওরা গরীব কেন ?
ভিখারিদাস||( মদের গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দ্যান। একটু কান চুলকোন ) সেটা অনেক বড়ো গল্প রে । শুনবি ? ধৈর্য ধরে শুনতে হবে …
মৃত্যুচরণ || প্রশ্ন করা চলবে তো ?
ভিখারিদাস || ( একটা বক্র হাসি হেসে ) চলবে । প্রশ্ন ছাড়া কোনও বক্তব্য মানা উচিত নয় । নে তুই আর গিলিস না – শেষে বৌঠান আমাকে ঝাড় দেবে
মৃত্যুচরণ ||( মৃত্যুর মতো করুণ একটা হাসি হেসে ) ওটা তো আমার দৈনন্দিন পাওনা রে । সেদিন ডিমের ঝোলটা খেয়ে বললাম “ আহা চন্দ্রমুখী – আহা, বেড়ে হয়েছে – তোফা হয়েছে – বড্ড ভালো রেঁধেছো গো তুমি আজকে ” তো তোর বৌঠান আমার মুখের কাছে মুখ এনে … না রে চুমু টুমু খায়নি – শুঁকে শুঁকে দেখে বললো “ তুমি নিশ্চয়ই নেশা করেছো নৈলে আমার এ্যাতো প্রশংসা ?” জাস্ট আমার রেপুটেশনটা একবার ভেবে দ্যাখ …..
দুই বন্ধু দেওয়াল ফাটিয়ে ঠা ঠা করে অট্টহাসি হাসেন ।
মৃত্যুচরণ || নে এবার স্টার্ট কর তোর বক্তিমে …
ভিখারিদাস || হ্যাঁরে মড়া তুই লেখাপড়া শিখেছিস ? অর্থনীতি বুঝিস ?
মৃত্যুচরণ || যাহ্ বাবা ! এরমধ্যে আবার অর্থনীতি কোত্থেকে এলো ? ডাক্তার আবার অর্থনীতি নিয়ে কী করবে ?
ভিখারিদাস || তাহলে ডাক্তারি জানেন না বলে একজন অর্থনীতিবিদ কী অশিক্ষিত ? নাকি অর্থনীতি জানিস না বলে তুই অশিক্ষিত ? উনি ওনার মতো করে ওনার ক্ষেত্রে শিক্ষিত – তুই তোর মতো করে তোর ক্ষেত্রে । কিন্তু চাষী কামার কুমোর এরা এদের মতো করে – ওদের বিষয়ে লেখাপড়া শেখার কোনও সুযোগ পায় নি
মৃত্যুচরণ ( হাঁ করে ) || কেন পায়নি ?
ভিখারিদাস ( আনমনে মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ) || দুটো কারণ আছে … বুঝলি মড়া ?
( নেশা চড়লে তিনি মৃত্যুচরণকে মড়া বলে ডাকেন )
মৃত্যুচরণ ||(গেলাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে) কোন দুটো কারণ ? বলে যা ভাই .. তুই এসব না করে রাজনীতি করতে পারতিস রে …. ভিখারিদাস || দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমতঃ ওদের কিছু শেখার আগেই …. মানে অনেক সময় অ আ ক খ শেখার আগেই কাজে যোগ দিতে হয় … সির্ফ পোড়া পেটের জন্যে আর দ্বিতীয়তঃ ওদের প্রয়োজন অনুযায়ী কোনও পাঠ্যক্রম মানে সিলেবাসই তৈরি হয়নি । ওদের ঐ কী যেন বলে এক কথায় .. দূর হোক গে …. কোনও হিসেবেই ধরা হয়নি । সিলেবাস তৈরি হয়েছে কেবলমাত্র কেরানী আর চাকর তৈরির জন্য … সাধারণ মানুষের স্বাধীন বৃত্তির কথা ভাবাই হয়নি । সুতরাং ওদের কেবলমাত্র ভোটের বক্তৃতায় রাখা হয় । অথচ ভারত একটা কৃষি নির্ভর দেশ । প্রায় শতকরা আশি ভাগ লোক চাষ করে বাঁচে এবং মনে রাখিস তারা দারিদ্র্যসীমার নিচেই থাকে । সব সময় । রাজনৈতিক নেতারা সেটাই চায় । কিছু বুঝছিস রে মড়া ?
মৃত্যুচরণ || ( ইট্টুস স্খলিত কন্ঠে) বলে যা । চালিয়ে যা ভাই ভিখিরি । তোর এই হাতেগেলাস বলাটা আমার খুব পছন্দের । কিন্তু আর কী ভাবে এদের পড়ানোর ব্যবস্থা করবি ? পড়া ফ্রি দেওয়া হচ্ছে সঙ্গে মিড ডে মীল , শিডিউল কাস্ট আর ট্রাইবদের জন্য কোটাও তো চালু আছে । তাহলে নতুন করে – আর কী করা যায় ?
ভিখারিদাস || ( কনুইয়ের ভাঁজ দিয়ে নাকের সর্দি মুছে – নেশায় নিষ্পলক রক্তচোখে ) তোর ছেলে সাহেবি ইস্কুলে পড়ে আর ওদের জন্যে দয়ার দান ?
মৃত্যুচরণ || ( বেশ ঘাবড়ে ) তাহলে কি ওদের বাড়িতে ফ্রিতে টিচার পাঠাতে হবে ? ( ওঁনার চোখ বিষ্ময়ে গোল গোল হয়ে যায় । আসলে ভিখিরি সহজ জিনিসটাকে মদের ঘোরে ? না সজ্ঞানে জটিল করছে বুঝতে পারেন না)
ভিখারিদাস || যদি প্রতিটা গ্রামে হিমঘর থাকতো – যদি ওরা ফলানো ফসল সেখানে রাখতে পারতো – যদি সরকার সরাসরি শহরে বাজারে সেই শস্য বিক্রির ব্যবস্থা করতো – তাহলে ওদের আর অভাব থাকতো না – সরকার ওদের নির্ধারিত টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতো – কৃষি থেকেই আয়কর আসতো …. । ওরা স্বপ্ন দেখতে পারতো । সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর – হাসপাতালে চিকিৎসা পেতো শিশুমৃত্যু কমতো । তাই সন্তান সংখ্যাও কমতো । দুটো জেনারেশনের মধ্যেই পৃথিবীটা ইয়ে ভারতটা বদলে যেতো
মৃত্যুচরণ || ( মদের গেলাস হাতে ধরে চোখ বন্ধ করে ) তাহলে কেউ বড়লোক আর কেউ গরীব কেন ?
ভিখারিদাস || ( পাত্র শূণ্য করে আবার ঢালাঢালি করতে ব্যস্ত ) দাঁড়া দাঁড়া । ধৈর্যং রহু । এটা ঐতিহাসিক তথ্য । এবারে দু চুমুক পান করে …তারপর বাকিটা
মৃত্যুচরণ || ভিখিরি আজ তুই এখানে থেকে যা … ( গলা চড়িয়ে ) ও চন্দ্রমুখী – আমার চাঁদবদনী – শুনছো ? ভিখু আজ আমাদের কাছে থাকবে
চন্দ্রমুখী || ( দরজা দিয়ে গোলাকার মুখটা বাড়িয়ে ) আহা এ বুঝি আর নতুন কিছু ? সবাইকার খাবারই তৈরি হচ্ছে…. আপনারা সময়ে খেয়ে আমায় ধন্য করবেন ।( মুন্ডুটা আবার দরজার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় )
ভিখারিদাস || বৌঠানের জয় হোক ।
মৃত্যুচরণ || তাহলে পেয়ালায় শেষ বারের মতো ঢেলে নে সুরা শুরু হোক সুরাতুর ঐতিহাসিক গল্প ।
ভিখারিদাস || ঢালছি তবে পরে আবার ঢলে পড়িস না । নে তুই ধর পাত্তর আর আমি ধরি গল্পের সূত্র।
অতি আদি কালটা ছিলো ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় । তখনকার জীবন যাপন কিছুই বিশেষ জানা যায় না। তবে হরপ্পা মহেঞ্জদড়ো অর্থাৎ ইন্দাস ভ্যালি সভ্যতা হয়ে ওঠে নগরকেন্দ্রিক … তারপর আসে দীর্ঘ ন’শো বছরব্যাপী জলকষ্ট । তখন ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় আমাদের আদিবাসীদের সম্ভবতঃ শান্তিপূর্ণ জীবন । বহু মানুষ ইরান পারস্য আর মধ্য ইউরোপ থেকে একে একে এসে গাঙ্গেয় উপত্যকা দখল করে ।* তৈরি হয় বড়লোক গরীবলোকে বিভাজন । ঐ আগন্তুকরা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিতো । শুরু হয় দারিদ্র্য অসমবন্টন আর অসাম্যেরও কাহিনী । বহু আদিবাসী মধ্যপ্রদেশ , অধুনা ছত্রিশগড় , দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় । একিরে ? তুই তো টলমল করছিস – চল ভাই খেয়ে দেয়ে শুই গিয়ে
[ দুজনেই পরষ্পরকে ধরে খেতে রওয়ানা দ্যান । ]
তথ্যসূত্র :- Gupta et al, Works on Inter Tropical Convergence Zone . IIT, Kharagpore.
আধুনিক ঐতিহাসিক সিরিয়াস নাটিকা। অসাধারণ!
ধন্যবাদ পবনদেব