সত্যমূর্তিকে আমি চিনি না। সেও আমাকে চেনে না। আমাকে না চিনলে তার ক্ষতি নেই। তাকে চিনলেও আমার লাভ হবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তবু আমি তাকে চিনে ফেললাম।
চিনলাম অরণ্যর সুবাদে। অরণ্য আমার বন্ধুপুত্র। সে দিল্লিতে IRIS-এর ইন্টারভিউয়ে গেল বলেই না তার বাবার সাথে দেখা হল সত্যমূর্তির। আজ সন্ধ্যেয় আমার সেই বন্ধু শোনালো সত্যমূর্তির কথা।
ব্যাপার হল, আমার বন্ধুপুত্র ক্লাস টেনএ পড়া শ্রীমান অরণ্য দিল্লি গেছিল এক সারাভারত প্রতিযোগিতায়। আগেই নিজের প্রোজেক্ট পাঠিয়েছিল ইন্টারনেটে। সারা ভারত থেকে হাজার দুয়েক প্রতিযোগী। তার মাঝে আশি জনকে ডেকেছিল ফাইনালে। সেখানে প্রেজেন্টেশন আর জিজ্ঞাসাবাদের পরে জনা পঁচিশেক বালক বালিকা সিলেক্টেড হল আমেরিকায় বিশ্ব প্রতিযোগিতার জন্য। দিল্লি থেকে ফিরে আজই সময় পেয়ে আমাকে বাড়িতে এসে বিস্তারিত জানাল অরণ্যের বাবা।
সেই ছেলে নাম করা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বেজায় চৌখস। বিজ্ঞানে প্রবল অনুরাগ। ওর প্রোজেক্ট ছিল ‘ ইউজ অফ ন্যানো সিলিকন অ্যাজ ইনসেকটিসাইড অ্যান্ড ইটস মোড অফ অ্যাকশন।’
ব্যাপার শুনেই আমার মাথা ঝিমঝিম করবে এ আর আশ্চর্য কী। আমিই তো সেই, ‘ঊনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে…’!
প্রোজেক্ট পাঠানোর পর প্রাথমিক ভাবে সিলেক্টেড হবার পর স্কাইপে আলাপ করলেন পরীক্ষার সেই তাঁরা।
শুরুই হল, ‘তুই ব্যাটা চোর’ জাতীয় প্রশ্ন দিয়ে।
– খোকা, তুমি তো দেখছি গুগল আর উইকি আর নেটের অন্যান্য ছাইপাঁশ ঘেটে মালটা নামিয়েছ।
আমাদের ছেলে তাঁদের কনভিন্স করিয়ে ছাড়ল যে এমত সন্দেহ অমূলক। প্রোজেক্ট মৌলিক এবং অভূতপূর্ব।
অতঃপর দিল্লি গমন।
প্রেজেন্টেশন আর প্রশ্নোত্তর শেষে জানা গেল, কুড়িটা প্রোজেক্টের জন্য মোট ছাব্বিশ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আমাদের অরণ্য তাদের মধ্যে রয়েছে।
সন্দেহ করা অমূলক নয় যে, ইংরেজি লেখায় তো বটেই বলা কওয়াতেও ঝাঁ দুরস্ত না হলে এই বিদেশগামী এরোপ্লেনে চাপা অসম্ভব। জিজ্ঞেস করলাম বন্ধুকে। তা’তেই জানতে পারলাম সত্যমূর্তির কথা।
সমবেত প্রতিযোগীদের দেখেই বোঝা যায় প্রেক্ষাপট স্পষ্টতই তিনটে ভাগ। একদল উচ্চবিত্ত। সংখ্যায় কম। পারিবারিক শপিং মল, ইস্পাত ফ্যাক্টরি, টেলিকম ব্যবসা বা কর্পোরেট হাসপাতাল ইত্যাদি।
বেশির ভাগটাই মধ্যবিত্ত। বাবা মায়েরা মাস্টার ছোট ব্যবসায়ী ডাক্তার উকিল ইঞ্জিনিয়ার বা ওইরকম অন্য কিছু।
কিন্তু কিছু নিম্নবর্গের ছাত্র ছাত্রীও এসেছে। তারা কেউই ইংরেজি স্কুলের না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইংরেজি। কেউ তা’ও বলতে পারে না। সত্যমূর্তি এই রকমেরই এক ছাত্রের গর্বিত মাস্টারমশাই।
সে নিজেও যে খুব ইংরেজিতে বলিয়ে কইয়ে তা’ নয়। তবে ওই আর কী, কানার মধ্যে ঝাপসা গোছের।
প্রতিযোগিতায় আসা সিংহ ভাগ ছাত্রছাত্রী দক্ষিণ ভারতের। আর মজার কথা তাদের অনেকের সঙ্গেই বাৎসল্য প্রপীড়িত বাবা মা আসেনি। বড়জোর এসেছেন স্কুলের কেউ।
সত্যমূর্তি সেই রকমেরই ছাত্রকে নিয়ে আসা এক গরিব স্কুলের মাস্টারমশাই। চেহারা দক্ষিণদেশীয়। গায়ে মলিন জামা। পায়ে ছেঁড়া চটি। প্রথম দর্শনেই চিনে নেওয়া যায় শ্রেণী। এই নিয়ে তার পঞ্চমবারের আসা। নিজে হাতে তৈরি ছাত্র নিয়ে। এর আগে দু’দুবার তার ছাত্ররা প্রতিযোগিতায় বিদেশ যাবার ছাড়পত্র পেয়েছে। তার মধ্যে একবারের প্রোজেক্ট ছিল স্রেফ একটা সাইকেলে বিভিন্ন উপাঙ্গ ফিট করে তাই দিয়ে চাষাবাদ। মানে জমিতে সেচ দেওয়া, বীজ ছেটানো, কীটনাশক দেওয়া, মায় ফসল কাটা অবধি, একটা মোটর চালিত যন্ত্র যা যা করে, তার পুরোটাই।
ইংরেজি আমার খুব ভয়ের জায়গা। আমি নিজে তেমন ইংরেজি জানি না, সড়গড় নই। যে ভাবে ইংরেজি মাধ্যমের দাপট বেড়ে চলেছে, রাষ্ট্রীয় মদতে আর একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর প্রশ্রয়ে, আমার ভয় হয় বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলো উঠে যাবে! সেই ভয় থেকেই জিজ্ঞাসা উঠে এল।
বাধা দিয়ে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, – হ্যাঁ রে, জাজ্দের প্রশ্নের উত্তর ওই বাচ্চাদের তো ইংরেজিতেই দিতে হচ্ছিল। না কী?
বন্ধু বলল, – হ্যাঁ, সে তো বটেই। কিন্তু যারা তা’ পারবে না তা’দের জন্য দোভাষীর ব্যবস্থাও ছিল।
এই অবধি বলে যোগ করল, – কিন্তু সত্যমূর্তির ছাত্র যে অঞ্চলের দক্ষিণী ভাষা জানে তার কোনও দোভাষী জোগাড় করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
আঁতকে উঠে বললাম, – তবে কি বাদ গেল ছেলেটা?
বন্ধু আশ্বস্ত করল, – আহা, তা’ কেন। ওরা ওর মাস্টার ওই সত্যমূর্তিকেই দোভাষী হবার পারমিশন দিল।
সত্যমূর্তি অবিশ্যি কড়ার করে নিয়েছিল, যে সে দোভাষীর অতিরিক্ত কিছু করছে নিজের ছাত্রের ব্যাপারে, এ’রকম আপত্তি তোলা চলবে না।
না, প্রশ্ন কেউ তোলেওনি। নইলে তার ছাত্র এ’বারও বাইরে যাবার ছাড়পত্র পেল কী করে?
– হ্যাঁ রে, এই আমেরিকায় যারা প্রতিযোগিতায় জিতলে মানে যদি জেতে, কী পাবে? শুধোলাম আমি।
– সে অনেক কিছু। টাকা পয়সা, স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার বিভিন্ন সুযোগ। কিন্তু সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য যা পাবে তা এককথায় দারুণ।
– মানে?
– মহাকাশে যে ছোটো ছোটো গ্রহাণু আবিষ্কার হচ্ছে প্রতিদিনই, তা’দের এক একটার নামকরণ হবে এই খুদেদের নামে।
সত্যমূর্তির কথায় ফিরি।
পুত্রকে নিয়ে দিল্লি গিয়ে হাতে গোণা যে ক’জনের সাথে ভাব হয়েছিল বন্ধুটির, সত্যমূর্তি তাদের মধ্যে একজন। দিনের অনেকটা সময় কাটত তার সাহচর্যে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আলাপ চলত। সে শোনাত ইঁদুরদৌড়ের ক্লান্ত দৌড়বীর আমার বন্ধুকে তার ছাত্রদের আর তার স্বপ্নদের কথা।
সেই স্বপ্নের কোথাওই ফিটজি আকাশ কিম্বা ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং আর মকটেস্টের নামগন্ধ থাকত না। আরও একজনের সঙ্গে সে আলাপ করিয়ে দিল, যে কিনা বিদেশে বায়োটেকনোলজি গবেষণার হাজার ওয়াটের স্পট লাইট ছেড়ে ফিরেছে সেকেন্ডারির ছাত্র পড়াবে বলে।
এর মধ্যে একদিন সকালে ইন্ডিয়া গেটের দিকে গিয়েছিল গার্জিয়ানরা সবাই মিলে। নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে হকারেরা। পর্যটক দেখলেই পাকড়াও করছে। জিনিসের দর না করলেও জোর করে গছাতে চাইছে। দু’হাজার টাকা দাম বলে শুরু করে শেষমেশ হয়তো দেড়শ টাকাতেই দিতে রাজি। অন্যদের কাছে পাত্তাই পাচ্ছিল না। কিন্তু সত্যমূর্তি ছিল ও’দের সফট টার্গেট। ও’কে যেন সহজেই মুর্গি করা যাবে!
সত্যমূর্তি তা’তে রাগ করছিল না। বরং হাসছিল। ও’কে জিজ্ঞেস করল বন্ধু, – আমাদের ছেড়ে তোমাকেই কেন?
লাজুক পবিত্র হাসিতে মুখ ভাসিয়ে সে বলেছিল, – আসলে আমাকে দেখলেই তো চেনা যায় আমি এসেছি দূর দক্ষিণের এক অন্ধকার ভারতবর্ষ থেকে। ও’দের দোষ নেই। ভাবছে চকচকে আলো দেখলেই পোকার মত আটকে যাব। এই ব্যাপারটা নিয়েও একটা প্রোজেক্ট করব। আগুনহীন আলো দিয়ে ইনসেক্টিসাইডের বিকল্প একটা পোকা ধরার ব্যবস্থা!
সত্যমূর্তির সাথে আমার আলাপ হোক আমি চাইছি না। এ’রা হচ্ছে সাধক। আমার সঙ্গে হেজিয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় যেন না পায় এরা। দূর থেকে দেখব, যেমন দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।
★