অবন্তিকা, এখন গণ হিস্টেরিয়া থেমে গেছে।
অবন্তিকা, এখন গণ হিস্টেরিয়া প্রশমিত। এসো আমরা তোমার সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানিয়ে একটু গল্প করি।তোমার চলে যাওয়ায় সবাইকার বিদ্রূপ এখন স্তব্ধ।অবন্তিকা, তুমি হেরে গেছো। ব্রাজিল যেমন হেরেছিল সাত গোলে সেই রকম।
অবন্তিকা তুমি প্রথম নও, অবন্তিকা, তুমি শেষও নও। আপাততঃ তুমি আমাদের জ্ঞানতঃ মৃত্যু লাইনের শেষতম ব্যক্তি।
এসো আমরা আমাদের সময়ে ফিরে যাই। আমার কলেজবেলায়। একটা ছাত্র ছিলো। দারুণ খেলতো, রাজনীতি করতো, কলেজ স্যোসালে সামনে দাঁড়িয়ে পরিচালনা করতো। জানি না, পড়াশোনায় কেমন ছিলো। সম্ভবতঃ ভালো। পরে আই সার্জন হয়। নিশ্চয়ই সূক্ষ্মতম অপারেশনে তার হাত কাঁপতো না। সরকারি চাকরি করতো। শুধুমাত্র সরকারি চাকরি। ক্রমশঃ সেই এককালের দুর্দান্ত ছেলেটা পারকিনসনিজমে পঙ্গু হয়ে পড়ে। পদত্যাগ করলে পেনশন, টাকা কিচ্ছু পাবে না। কেননা পদত্যাগপত্র গৃহীত হবে না। সুতরাং ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট চাইলো সেই পঙ্গু ডাক্তার। পায়নি। অপারেশন দূর অস্ত হাঁটতে পারে না। আবেদনের পরে আবেদন এবং প্রত্যাখানের পর প্রত্যাখান। এই রোগে নিজে নিজে খাওয়ার ক্ষমতাও চলে যায়। সেই উজ্জ্বল ছেলেটাকে ধরে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। হাঁটতে পারে না তাই একদিন পড়ে গিয়ে সেরিব্রাল হেমারেজ।কোমা, আইসিইউ। খবরের কাগজে শিরোনাম।
এবার স্বাস্থ্য ভবন জাগলো। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট পেলো। দুঃখ কোথায় জানো অবন্তিকা? ছেলেটা জানতেও পারলো না ওর ছুটি মিলেছে। আইসিইউ থেকে মৃতদেহটা বেরিয়ে এলো। মৃত্যুতেই অবসর পেলো আমাদের কলেজের সেই ছেলেটা।
আর ঐ প্যাঙ্কৃয়াস ক্যানসার রোগীটার খবর জানো? কর্কট দংশনে যার লিভার, ফুসফুস, কিডনি সব ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলো? লোকটা ডাক্তার ছিলো। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট প্রত্যাখ্যাত। কেন মনে নেই তোমার? সে নিজে হেঁটে হেঁটে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে গেছিলো।
“আরেঃ আপনি তো হেঁটে হেঁটে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে এসেছেন, যান যান কাজে যান”
ইনি মুখ্য সচিবের হস্তক্ষেপে রিটায়ারমেন্ট পেয়েছিলেন। অন্ততঃ শেষ কটা কেমো থেরাপি আরামে বাড়িতে বসে নিয়েছেন।
হার্টের রোগী যদি হেঁটে হেঁটে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে যায়, তাহলে রিটায়ারমেন্ট পাবে না। আমি একটা ফুটো কড়িও পাইনি। তবু পালিয়ে এসেছি।
অবন্তিকা তুমি কী প্রমাণ করতে? হতাশা? রাতের পর রাত জেগে কাটানো? বুকে, শরীরে তীব্র দহন? এটা কি প্রমাণ করা যায়? প্রতিনিয়ত কতোজন ডাক্তার আত্মহনন করছে তা কি মানুষ জানে? তোমার অটিস্টিক বাচ্চা? তাকে মেডিক্যাল বোর্ডে নিয়ে যেতে? কেউ মানতো? পশ্চিমবঙ্গ শব্দটার বাংলা অর্থ কলকাতা? অটিস্টিক বাচ্চাদের যা লাগে সেগুলো কেবলমাত্র, কেবল কেবলমাত্র, কলকাতাতেই আছে?
ঘুমিয়ে থাকো অবন্তিকা। আমাদের সব কটা ইউনিয়ন রাজনীতির ধ্বজাধারী। হয় তোমাকে বাম হতে হবে, নাহলে ডান। লেফ্ট রাইট, লেফ্ট রাইট, লেফ্ট রাইট, শুনছো অবন্তিকা, কুইক মার্চ করে আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে?
বোকা মেয়েটা, তোমার প্রেক্ষাপট কি? ইতিহাসে আছো তুমি? বামপন্থী (গণতান্ত্রিক, ভোটভিখারি, চাকরমনস্ক, ধান্ধাবাজী), না ডানপন্থী? কোনও তকমা নেই? তোমার নামে আন্দলনে দলগত অবস্থান ভালো হবে? না। সুতরাং কেরোসিন আর দেশলাই ফ্রি।
বাকিরা বলবে ছি ছি ছি মহিলা সন্তানের কথা ভাবলো না? সন্তানের ভাবনায় তোমার যে শরীরের সেরেটোনিন কমে হতাশায় ডুবে গেলে, মায়ের মৃত্যু…. পিতৃহারা মেয়েটা যে হেরে গেছে, গোপন কান্নায় যখন কেউ, কোনও ইউনিয়ন, কোনও সংস্থা, কোনও সরকারি ন্যাতা আমলা বলে নি-আচ্ছা এটা বিবেচনা যোগ্য, আমরা দেখছি; যখন প্রতিটি আবেদন পত্র ফেলা হয়েছে ছেঁড়া কাগজের পাত্রে; তখন এসো অবন্তিকা, কন্যা আমার অগ্নিশুদ্ধ হও।এতে অন্ততঃ একটা লোকের বিবেক যদি জাগে….
অসামান্য লেখা!
অসাধারণ মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।
সকলকে ধন্যবাদ