“পেঁয়াজ দাও, এক কিলো।”
প্রতীপ, আমার সবজিওয়ালা, আড় চোখে তাকিয়ে বলল, “পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দিয়েছি।”
খুশি হলাম। “বাঃ, বেশ কথা। আমার একটা পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল।”
প্রতীপ বুঝল, আমি গল্প বলার মুডে আছি। বলল, “কী কথা?”
গল্পটা বললাম ওকে।
রাঁচি শহর, উনিশশো একানব্বইয়ের কথা। জীবনের প্রথম ফ্রিজ কিনব, তার আগে মার্কেট সার্ভে চলছে। বন্ধুদের কাছ থেকে নানা খবর নিয়েছি। কে কোথা থেকে কিনেছে, দাম কতো পড়েছে, কেমন চলছে, ইত্যাদি।
ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছি রাঁচির সবচেয়ে বড়ো শপিং এরিয়া-তে। তখন সে বাড়ির দোতলায় একটা মস্ত ডিপার্টমেন্ট স্টোর ছিল, তার নাম এক্সপ্রেস শপ। আজকাল আর নেই বোধহয়। তার একতলায়, মাড়োয়ারী, বা গুজরাতি নামের শো-রুম — ফ্রিজ, টিভি, এ-সি, ওয়াশিং মেশিন — এসবের বড়ো দোকান। দোকান ফাঁকা। আমরা ছাড়া আর এক জন খদ্দের, দোকানের কর্মচারী তার সঙ্গে কথা বলছেন। ভিতরে গিয়ে একটা মোটামুটি নামকরা কোম্পানির ফ্রিজ দেখছি, উঠে এলেন দোকানের মালিক। কাছে এসে নিজের নাম বলে বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিলেন। বললেন , “কী করতে পারি?”
আমাদের চাহিদা জেনে বললেন, “এটা দেখছেন? এটা কি পছন্দ হয়েছে?”
আমি বললাম, “কিছুই পছন্দ হয়নি। আগে দেখি। এটার বিশেষত্ব কী? দাম কত?”
উনি বললেন, “এটার বিশেষত্ব হল এই, যে এটা ভারতীয় ফ্রিজ মার্কেটে সবচেয়ে ওঁচা ফ্রিজ। যেমন কোম্পানি, তেমনই তাদের প্রোডাক্ট।”
মনে পড়ল, আমার শালা এদেরই তৈরি কী একটা ব্যবহার করে, আমাকে একবার বলেছিল, “এদের বিশেষত্ব কী জান? এরা একটা বাজে মাল সস্তায় দেয়, তার পরে এক্সেলেন্ট আফটার সেলস সার্ভিস দেয়। খারাপ হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সারিয়ে দেয়। আজ-না-কাল, কাল-না-পরশু — করে না।”
বললাম, “দাম কত? এখানে সার্ভিস কেমন?”
ভদ্রলোক বললেন, “আচ্ছা, মনে ধরেছে দেখছি। তাহলে দেখুন।” বলে ভদ্রলোক আমাকে — দরজা ভাল করে বন্ধ হয় না, হ্যান্ডেলের স্ক্রু-তে মরচে পড়ে গিয়েছে, পেছনের ওমুকটা ঢিলে, ভেতরের তসুকটা ইনফিরিয়র কোয়ালিটি… এ সব প্রায় তেরো রকম সমস্যা দেখিয়ে বললেন, “আর যদি সার্ভিসের কথা বলেন, রাঁচিতে সার্ভিস নেই। এখানে বিক্কিরিই নেই। কেউ কেনে না। আর রাঁচির মতো ছোটো শহরে কটা আর কাস্টমার, বলুন?”
বটেই তো।
“এ দিকে আসুন, এইটা দেখাই,”বলে নিয়ে গেলেন আর একটা ফ্রিজের দিকে। আরও নামকরা কোম্পানির তৈরি ফ্রিজ। বললেন, “ডবল ডোর, ডবল কম্প্রেসর। আজকাল আর কেউ বানায় না। দাম একটু বেশি পড়বে, কিন্তু আহা, কী জিনিস… জাস্ট ভাবুন…” বলে এটারও প্রায় পাঁচ-সাতটা গুণকীর্তণ করলেন, ভিজিটিং কার্ডটা আবার নিয়ে ফ্রিজের নাম আর মডেল নাম্বার লিখে দিলেন, আর আমরা সে দিনের মতো মার্কেট সার্ভে করে ফিরে গেলাম।
নানা বিচার বিবেচনা করে, ন’-দশদিন বাদে আবার ফিরে গিয়েছি। সাব্যস্ত করেছি, ওই দারুণ ফ্রিজটাই কিনব। দুটো কম্প্রেসর বলে কথা!
দোকানে ঢুকে দেখি সেই কর্মচারী, সেই মালিক। আজ আর কোনও খদ্দের নেই। আমাদের দেখে কর্মচারী এগিয়ে এলেন। আমি বললাম, “আগের দিন একটা ফ্রিজ দেখে গিয়েছিলাম, ওইখানে ছিল, কালো রঙের — ওমুক কোম্পানীর তৈরি — ডবল ডোর, ডবল কম্প্রেসর…”
কর্মচারী কিছু বলার আগে মালিক উঠে এলেন। কাছে এসে নিজের নাম বলে বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিলেন। বললেন, “আপনাদের একটা কথা বলি, এ সব ছেলে-ভুলানো কথায় আপনারা কেন পড়েন? ডবল কম্প্রেসর ফ্রিজ হয়? লোকে বলে, আপনারা বিশ্বাস করেন, আর কিছু ঠগবাজ আপনাদের কাছ থেকে রোজগার করে।”
আমি হতভম্ব। বললাম, “এই যে এখানে ডবল ডোর ফ্রিজটা ছিল, আমি এই ক’দিন আগে দেখে গেলাম, ওটা ডবল কম্প্রেসর… না?”
স্মিত হেসে উনি বললেন, “স্যার, আমাদের দেশে ডবল কমপ্রেসর ফ্রিজ তৈরিই হয় না।”
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে থেমে আছি, সেই সুযোগে উনি আমাকে বললেন, “আসুন, স্যার আপনাকে একটা দারুণ ফ্রিজ দেখাই। দিস ইজ দ্য বেস্ট ফ্রিজ অ্যাভেলেব্ল ইন ইন্ডিয়া টুডে।”
নিয়ে গেলেন আর একটা ফ্রিজের কাছে। এটাও আমার চেনা ফ্রিজ। এর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ হয়েছিল। বললেন, “এটা তমুক কম্পানির ফ্রিজ। বেস্ট সেলার। এর মতো ফ্রিজ আমাদের দেশে আর তৈরি হয়নি কোনও দিন।”
আমি বললাম, “কিন্তু আগের দিন আপনি বললেন, এটা অত্যন্ত ওঁচা ফ্রিজ, এটাতে তেরো রকমের বাজে ব্যাপার আছে, দরজা বন্ধ হয় না, হ্যান্ডেলের স্কু-তে মরচে… এই তো, এটাই তো আমাকে দেখিয়েছিলেন, পেছনের ওমুকটা ঢিলে, ভেতরের তসুকটা ইনফিরিয়র কোয়ালিটি… সার্ভিস নেই…”
ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল। “সার্ভিস নেই? কী বলছেন! কে বলেছে এ সব আজে বাজে কথা? একটা দুটো মরচে পড়া স্ক্রু কোন ফ্রিজে নেই দেখাতে পারবেন?”
আমি বললাম, “আরে মশাই আপনিই বলেছেন। এই সে দিন।”
খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “হতেই পারে না। জানেন, আমরা এই ফ্রিজ কটা বেচেছি? গত এক মাসে নয় নয় করে পঁচিশটা।” বলে সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পঁচিশটা? না আরও বেশি?”
মিন মিন করে সেলসম্যান বলল, “ওই ওরকমই হবে। গোটা পঁচিশেক।”
আমার মনে পড়ল। বললাম, “আপনি বলেছিলেন, প্রথম চার পাঁচ জন ক্রেতা ফ্রিজ ফেরত দিয়ে গেছে, তাই আপনি এটা আর বিক্রি করছেন না।”
আবার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বললেন, “আপনি অন্য কোনও দোকানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন।”
হাতের কার্ডটার দিকে নজর পড়ল, ওটা ভদ্রলোকের হাতে ফেরত দিয়ে বললাম, “দাঁড়ান।” পকেট থেকে আগের দিনের কার্ডটা বের করলাম। বললাম, “দেখুন, এই মডেলটা কেনা উচিত, আপনি নিজে লিখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এটা ডবল ডোর, ডবল কম্প্রেসর। বলেছিলেন, এই ফ্রিজটা বাজে, এখন ওই ফ্রিজ আর নেই, এটা সবচেয়ে ভালো হয়ে গেল?”
এক সেকেন্ড লাগল। বললেন, “আরে সে তো সে দিনের কথা। আজ এই ফ্রিজ আলাদা।”
হতভম্ব হয়ে তো ছিলামই, এখন আমি হতভোম্বল!
বললেন, “আগের দিন বললাম না, চার পাঁচ জন ফেরত দিয়ে গেছে? সেই ফেরত দেওয়ার রিপোর্ট আমরা কোম্পানিতে পাঠিয়েছি। কোম্পানি গোটা ডিজাইন পালটে ফেলেছে। খোল নলচে। এখন এটা ইন্ডিয়ার বেস্ট ফ্রিজ।”
দশ দিন আগে রাঁচির মতো নগণ্য শহর থেকে রিপোর্ট গেল, আর ফ্রিজের ডিজাইন বদলে ফিরেও এল?
“তবে! রাঁচিকে আপনারা বাইরের লোকেরা তাচ্ছিল্য করেন, আসলে দিস ইজ আ ভেরি ইম্পরট্যান্ট টাউন।”
সে আর বলতে, আমরা পালিয়ে বাঁচলাম।
প্রতীপ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। বললাম, “ও ফ্রিজের ডিজাইন বদলে দিল, আর তুমি পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দিলে।”
প্রতীপ বলল, “কমে গিয়েছে বলা উচিত ছিল, তাই না?” বলে পেঁয়াজ ওজন করায় মন দিল। মনে হল, আমার কথাটা পছন্দ হয়নি। আমি চেপে গেলাম।
এটা সেটা কিনে বেগুনে পৌঁছেছি — প্রথম বেগুনটা তুললাম, একটা ফুটো। পরেরটায় দুটো। বললাম, “বেগুন, না অভয়ারণ্য?” তৃতীয় বেগুনটার চারপাশ ঘুরিয়ে দেখে প্রতীপের হাতে দিয়েছি, প্রতীপ মাথা নেড়ে বলল, “বড্ডো ভারি। বিচি ভর্তি হবে।” বলে আর একটা বেগুন নিয়ে ওজন করল। ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, “তবে কাল এলে, আজকের এইটাই ভালো বেগুন হবে… আপনার ফ্রিজের মতো।”