স্টেথোস্কোপটা আজই বের করেছে আরভা, আজকাল এর ব্যবহার খুব কমে এসেছে। আরভাও সচরাচর গলায় ঝোলায় না। পঁচিশ বছর পুরনো স্টেথোস্কোপ। সন্দেহটা ছিলই, রিপোর্ট পেল হাসপাতালে গিয়ে। একটা নতুন ভাইরাস, ২০২০ সালের কোভিড ১৯ এর চাইতেও ছোঁয়াচে। এর মধ্যেই আমেরিকার শ’খানেক মানুষ নিউমোনিয়ার সিম্পটম নিয়ে ভর্তি।
এই স্টেথোস্কোপটা ছিল বাবার সব সময়ের সঙ্গী। কোভিড ১৯ যখন এলো ঝাঁপিয়ে পরেছিল মেডিক্যাল কলেজের ইনফেকশাস ডিসিস ওয়ার্ডে। শেষে নিজেই আক্রান্ত হন। শেষ সময়ে দূর থেকে পলিথিনে ঢাকা একটা দেহ ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি আরভা। শুধু এই স্টেথোস্কোপ ফিরে এসেছিল কিছুদিন পর। পিপিই-র ওপর স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে আরভা আয়নায় ফিরে পেল কুড়ি বছর আগের হারিয়ে যাওয়া বাবাকে। ইনফেকশাস ডিসিস ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আর একবার স্টেথোস্কোপ টাছুঁয়ে নিল আরভা।
এই থার্মোমিটারটা কেউ আর ব্যবহার করে না, পিপিই-র পকেটে সযত্নে ঢুকিয়ে নিল নার্স জোসুয়া। এটা মার পার্সনাল থার্মোমিটার ছিল। ২০২০ প্যান্ডেমিকের সময় জোসুয়াকে বন্ধুর বাড়ি রেখে এসেছিল মা। সিঙ্গল মাদার, কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি পরেছিল জোসুয়ার মা নার্স মার্থার। আর মা কে দেখতে পায়নি জোসুয়া। মায়ের থার্মোমিটার পকেটে নিয়ে ইনফেকশাস ডিসিস ওয়ার্ডে ডক্টর আরভার পাশে দাঁড়ালো জোসুয়া। মুখ ঢাকা মাস্কে কিন্তু চোখের ভাষায় তারা একে অপরকে বুঝিয়ে দিলে “সেবারও হারিনি এবাও হারব না আমরা।”
লকডাউন নোটিশটা সই করল হোম সেক্রেটারি আনোয়ার আলি। একটা পুরোন পার্কার পেন দিয়ে। মা ব্যবহার করত। ২০২০-তে অতিমারির সময় টানা দুমাস দশ দিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলার করোনা পরিস্থিতি সামলাতে পথে নেমেছিল মা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিনও প্ল্যান করেছিল করোনা শেষ হলে দার্জিলিং যাব। আর ফেরা হয়নি মায়ের। প্লাস্টিকে মোড়া দেহটা বাড়িতেও আনা যায়নি। আর দার্জিলিংও যায়নি আনোয়ার কোনদিন। পার্কার পেনের মুখ লাগিয়ে বুকপকেটে রাখলো আনোয়ার, আলতো করে ছুঁয়ে নিল আরেকবার।
লকডাউন অর্ডারটা হাতে পেয়ে মিটিং রুমের দিকে চলল পুলিশ সুপার অমৃতা। ঢোকার মুখে একবার হাত বোলালো গলায় ঝোলানো লকেটে। এটা বাবার গলায় থাকতো। করোনা মহামারির সময় ইন্সপেক্টর হিসেবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করেছে বাবা। ফিরে এসেছে শুধু লকেটটা। এটা এখন অমৃতার গলায় ঝোলে সবসময়। শুধু নিজের ছোটবেলার ছবিটা পাল্টে বাবার ছবি লাগিয়ে নিয়েছে সে। লকেটটাতে আরেকবার হাত বুলিয়ে নিয়ে মিটিং শুরু করল অমৃতা।
হাউস কিপিং স্টাফদের সাথে মিটিং করে ইনফেকশাস ডিসিস ওয়ার্ডে ডিউটি রোস্টার বানালো শবনম। হাউস কিপিং হেড হিসেবে নিজে কোন অফ ডে নেয়নি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একবার ছুঁয়ে নিল পুরোন চাবির রিং। সব দরজায় ডিজিটাল কি এখন, চাবি আর লাগে না। কিন্তু এইটা আজ সঙ্গে এনেছে শবনম। এইটা বাবার। কোভিড ১৯ মহামারীর সময় টানা ডিউটি করেছে বাবা, করোনা রোগর মল মূত্র পরিষ্কার করেছে নিজের হাতে। তারপর সেই ওয়ার্ডেরই একটা বেডে দিন দশেকের লড়াই। চাবির রিংটা ফেরত দিয়েছিল বাবার বন্ধু আর সহকর্মী রঘুবীর কাকু। চাবির রিংটাকে আর একবার ছুঁয়ে হাতে গ্লাভস পরে ইনফেকশাস ডিসিস ওয়ার্ডের বাথরুমে ঢুকল শবনম। মনে মনে বলল “সেবারও হারিনি এবারও হারব না আমরা।”