অখিলদা আমাদের পাখি দেখার দলের দাদা। আমার চেয়ে বিশ বছরেরও বেশি বড়ো, অখিলদা সবসময় সমবয়সীদের মতো আচরণ করতেন। আজ আমি প্রায় ষাট, অখিলদা এখনও আমার সমবয়সী দাদা।
অখিলদা একটা ব্যাপারে আমার ঠিক উলটো। সম্রাট নেপোলিয়ন, বা সম্রাট আকবরের সম্বন্ধে যেমন শোনা যায়, অখিলদা ঘুমোতেন না। সারা দিনেরাতে ঘণ্টা দু-তিন ঘুমোলেই চলত। বলতেন, “তোদের তো রাত্তির কাটে ঘুমিয়ে। আর আমার কথা ভাব, কত কাজ করতে পারি – আমার সব হাজার হাজার ছবি ক্যাটালগ করা, সেগুলোর নেগেটিভ গুছিয়ে রাখা, ইনকাম ট্যাক্সের কাজ – সব কী সুন্দর শেষে হয় রাত্তির দশটা থেকে তিনটের মধ্যে, তার পরে তিনটে থেকে পাঁচটা বা ছটা অবধি ঘুমোলেই, ব্যস – ঝরঝরে হয়ে উঠি।” এবং সত্যিই, অখিলদার মতো গোছান’ লোক খুব কম দেখেছি।
সমস্যা হত আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গেলে। আমরা সবাই তো আড্ডা-টাড্ডা মেরেও মেরেকেটে দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বিছানায় – পরদিন ভোর থাকতে পাখি দেখতে বেরোতে হবে – কিন্তু অখিলদার তো ঘুম নেই, আর বেড়াতে গেলে কাজও নেই! করেন কী? একদিন জলদাপাড়ায় আমাদের ঘরের দরজায় রাত বারোটার পরে দমাদ্দম ধাক্কা। ধড়ফড় করে উঠে অসীমদা দরজা খুলেছে, ভেবেছে কারও নিশ্চয়ই অসুখ করেছে বলে কেউ অনিরুদ্ধকে ডাকছে। ও মা! দরজা খোলা মাত্র অখিলদা ঢুকে, সিদ্ধার্থদার বিছানার নিচে রাখা কাঁচা আনাজ থেকে একটা বেগুন নিয়ে বেরোতে বেরোতে বলে গেলেন, “ঘুম তো আসছে না, দেখি বেগুন মাথায় দিয়ে শুলে ঘুম আসে কি না!” বলে হতভম্ব আমাদের রেখে চলে গেলেন। পরে কাকে বলেছিলেন, “আমি একাই কেন জাগি রে বাপু?”
দারুণ ছবি তুলতেন অখিলদা। এখনও তোলেন, তবে বয়সের ভারে চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আর অত ঘোরাঘুরিও করতে পারেন না। আমাদের অল্প বয়সে অকৃতদার অখিলদার অনেক দায়িত্ব ছিল। সারাক্ষণ ছোটাছুটি। বলতেন, “বিয়ে না করে তোদের চেয়ে অনেক বেশি সংসারী। এই দেখ না, তোরা সব আড্ডা সেরে যাবি বাড়ি, আর আমাকে এখন যেতে হবে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে বিধান সরণী, বাবার বাজার করতে। বাবামশাইয়ের বাজার আমি করে দিই। দাদারা আর ভাই সংসারী, তাই ওদের সময় কম। তার ওপর আমার যত বন্ধু এখন কলকাতার বাইরে – কেউ দেশে, কেউ বিদেশে – তাদের বাবা, মা, পিসি, জ্যাঠা – সবার দায়িত্ব আমার ওপর। কাল যাব খিদিরপুর। অংশুমানের পিসিকে দেখতে। অংশুমানকে মনে আছে? নেই? ওই যে, সাউথ অ্যাফ্রিকা চলে গেল?”
একদিন দেখি অখিলদা খুবই বিচলিত। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল? আজ যে আড্ডায় মন নেই?”
বললেন, “আরে, আর বলিস না। পার্থ, আমার পুরোনো বন্ধু – গিয়েছে অ্যামেরিকা। এক বছরের জন্য। আমাকে বলেছিল, ‘বাড়িতে দারোয়ান রেখে গেলাম। কেউ কোত্থাও নেই, এমন এক জায়গায় বাড়ি। তুই মাঝে মাঝে একটু দেখে আসবি? ব্যাটা ভাড়াটে না বসিয়ে দেয়।’ তখন তো বলে দিয়েছি, ‘ঠিক আছে।’ কিন্তু এখন ভাবছি, তিন মাস হয়ে গেল, কী করে সল্ট লেক গিয়ে খবর নিই?”
“সল্ট লেক!” শুনে তো আমদের চক্ষুস্থির! তখন আশির দশক, বাইপাস বলে কোনও রাস্তা হয়নি। দেশপ্রিয় পার্ক থেকে সল্ট লেক যেতে হলে এসপ্ল্যানেড হয়ে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে, মানিকতলা, খান্না হয়ে বা শেয়ালদা, বেলেঘাটা, সিআইটি রোড হয়ে – উলটোডাঙা পৌঁছতে হত। সে সবই আমাদের মতো দক্ষিণ কলকাতাবাসীদের কাছে দ্বীপান্তর, বা সাহারা মরুভূমি যাবার মতো! অসীমদা তো বলেই ফেলল, “ওখানে গিয়ে মানুষ ফেরে না, অখিলদা। যাবেন না।”
শেষে দেবদত্তদা, যে কী না আমাদের তখনকার চোখে স্কট্, বা আমুন্ডসেন-এর সমতুল্য – কারণ সে প্রতি শনিবার ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে সল্ট লেক যেত সকাল সাতটায় কোন প্রফেসরের ক্লাস করতে, অখিলদাকে বলল, “ওদের কথা শুনবেন না, অখিলদা, আমি নিয়ে যাব।”
সল্ট লেক থেকে ফিরে দেবদত্তদা হেসে কুটিপাটি। “ওরে, শোন, শোন – অখিলদার হিন্দির আর একটা নমুনা নিয়ে এসেছি।”
অখিলদার হিন্দি এক সাংঘাতিক ভাষা। হিন্দি বলতেও পারেন না, কিন্তু বলতে ক্ষান্তও দেন না। একবার বেতলার জঙ্গলে ভোরবেলা পাখি দেখতে দেখতে কয়েকজন হাঁটছেন, এমন সময় কে বলেছে, “এই যে রাস্তার ওপরে কোন জন্তু সক্কালবেলায় ইয়ে করে গিয়েছে। সাবধানে আসবেন।”
সেই দেখে আর একজন কে বলেছে, “কী জন্তু? শেয়াল, না নেকড়ে?”
আরও এক জন কেউ বলেছে, “না না। ভাম হবে, ভাম।”
এমন সময়ে অখিলদা গিয়ে পৌঁছেছেন ওখানে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, “জানো না তো জিজ্ঞেস করতে কী হয়েছে? অদ্ভুত ব্যাপার!” বলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাইডকে বললেন, “অ্যাই ব্যাটা, এদিকে আ।” এই ‘আ’ শব্দটাই গোটা বাক্যটাকে হিন্দিতে রূপারন্তরিত করল বলে অখিলদার ধারণা।
গাইড এল। রাস্তায় বিষ্ঠার ঢিবিটা দেখিয়ে অখিলদা বললেন, “ইধর পটি কোন কিয়া রে?”
গাইড কিছুই বুঝতে পারল না, আসেপাশে সবার মুখ চাপা হাসিতে ফুসকায়িত – অখিলদা বুঝলেন হিন্দি বাক্যে ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করা ভুল হয়েছে। শুদ্ধ করে বললেন, “আরে ব্যাটা, নাম্বার টু কোন কিয়া?”
তা, অখিলদা সল্ট লেকে গিয়ে আবার কী কাণ্ড ঘটালেন?
অখিলদা মুচকি মুচকি হাসছেন, দেবদত্তদা বলল, “সারা রাস্তা টেনশন করতে করতে গেলেন, বন্ধু তিন মাস হল অ্যামেরিকা গেছে, দারোয়ানটার ওপর কোনও খবরদারি নেই, হয়ত ভাড়াটে ঢুকিয়ে দিয়েছে! তারপর বললেন, হয়ত কী? ধরে নে ঢুকিয়েই দিয়েছে! তারপর বললেন, গিয়েই তো ভাড়াটের মুখোমুখি হতে হবে! এমনি করতে করতে গিয়ে পৌঁছলেন সল্ট লেক। সেখানে দেখা গেল, বাড়ির পাশের ড্রাইভে বসে দারোয়ান বাসন মাজছে। বাড়ির সব দরজা-জানলা বন্ধ। দারোয়ান যে অখিলদাকে চেনে না আমি তো তা জানি না, কিন্তু অখিলদার পরোয়া নেই। গেট খুলে গট্-গট্ করে ঢুকেছেন, দারোয়ান হাঁ করে চেয়ে আছে – অখিলদা সটান সামনে গিয়ে বললেন, ‘কী রে ব্যাটা? ইহাঁ ঔর কোন কোন থাকতা হ্যায় রে?’”
অখিলদা বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছেন উত্তর প্রদেশে করবেট ন্যাশনাল পার্কে। বাস যাত্রার মধ্যে কথায় কথায় হিন্দির কথা উঠল – কে যেন বলল, “আরে অখিলদা, আপনি সারা ভারত ঘুরে বেড়ান – হিন্দি ছাড়া! কী করে পারেন?”
অখিলদা অম্লান বদনে বললেন, “আরে, অতটা হিন্দি আমি জানি রে বাবা।”
বন্ধুরা মজা পেয়ে বললেন, “বেশ। ধরুন এখন একটা বাচ্চা যদি বাস থেকে পড়ে যায়, ড্রাইভারকে কী বলে বাস থামাতে বলবেন?”
অখিলদা ফাঁপড়ে পড়লেন। ভাবলেন খানিকক্ষণ। তারপরে বললেন, “এটা কঠিন হয়ে গেল। বাচ্চা হিন্দি কী? বচ্চাকচ্চা বলব? ‘এক বচ্চাকচ্চা গির গিয়া?’ না কি নান্নামুন্না বলব? ‘নান্নামুন্না গির গিয়া?’”
বন্ধুদের মুখে হাসি আর ধরে না! সেই দেখে অখিলদা আর একটু ভাবলেন। তারপর এই অনবদ্য বাক্যটি বললেন – “ড্রাইভারজি, বচপন হি গির গিয়া, আব কেয়া ফায়দা?”
বন্ধুদের একজন পরে বলেছিলেন, “অখিলটা এমন একটা ফিলজফিক্যাল স্টেটমেন্ট দিল, যে আমাদের ট্রিপটাই ভেস্তে যায় আরকি! কিছু গণ্ডগোল হলেই যে ভুল করেছে সে বলে, ‘আরে, অত ভাবলে চলে? বচপন হি যখন গির গিয়া, তখন তো আর কোনও ফায়দাই নেই!’”
গল্প শুনে আমরা খুব হাসছি, অখিলদাও হাসছেন, তারপর বললেন, “আচ্ছা, হিন্দিটা কী হবে, বল তো?” আমরা সাত জন হাসি থামিয়ে সাত রকম বললাম, অখিলদা বললেন, “ব্যস, বুঝেছি। কেউই জানিস না, শুধু আমার পেছনে লাগা। আরে, হিন্দি ভাষাটাই ও রকম। একবার গিয়েছি কেদার। জানিস তো আমার বন্ধুরা চার জন যায় বছরে একবার। কী বেড়ায় জানি না। সারাদিন হেঁটে যেখানে রাতে থাকার জায়গা, সেখানে থেমে বাবুরা তাস খেলতে বসেন। অদ্ভুত ব্যাপার। আমাকে নিয়ে যায় যাতে আমি ট্রিপটার বন্দোবস্ত করি। ওরা তাস খেলে আর মদ খায়, আর আমি রান্নাবান্না দেখি। মদ তো খাই না, তাসও খেলি না। আমার ট্রিপটা ওরা স্পনসর করে। আমারও মজা, ওদেরও হেড-এক নেই।”
এ বন্দোবস্তটা আমরা জানতাম। তাই বললাম, “তা, কেদারে কী হল?”
“কেদারে না। আগে। গৌরীকুণ্ডে নাইট হল্ট। আজকালকার মতো তো না। লোকজনের ভীড় প্রায় নেই বললেই চলে। ট্যুরিস্ট বলে কিছু নেই। ডিভোটি-ও নেই। আমরা গিয়ে একটা ঘর ভাড়া করেছি, আর চার মক্কেল সঙ্গে সঙ্গে তাস নিয়ে বসে গেছেন। আমি বাইরে গিয়ে গ্রাম থেকে একটা বুড়িকে ধরে এনে রান্নাঘর সাফ-টাফ করে, একটা উনুন জোগাড় করে চা বানিয়ে, বুড়িকে দিয়ে পাকোড়া বানিয়ে বাবুদের খাইয়ে লোকাল বাজারে গিয়ে বাজার করে এনে রান্না চাপিয়েছি, তখন সন্ধে হয়ে গেছে।”
ঘরের ওধারে রাজাদা হাসতে শুরু করেছে। আমরা বললাম, “কী, তুমি জান নাকি গল্পটা?”
রাজাদা হাতের আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসতে হাসতে মাথা হেলিয়ে জানাল, জানে।
বললাম, “তুমি বলে দিও না। অখিলদাকে বলতে দাও।”
রাজাদার বলে দেবার অবস্থা নেই। হেসেই চলেছে।
রাজাদার হাসি দেখে অখিলদাও হাসতে লেগেছেন। শেষে দুজনেই এত হাসছে যে কারওরই কথা বলার অবস্থা নেই। আমরা বোকার মতো তাকিয়ে আছি।
শেষে রাজাদা-ই আগে সামলাল। বলল, “আরে, সন্ধে হয়েছে, ঠাণ্ডাও বাড়ছে। অখিলদা একবার পাকোড়ার প্লেট নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বুঝেছে আরও রাত বাড়লে ঠাণ্ডা জব্বর হবে। এসে বুড়িকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আরে ব্যাটা, রাত্তিরে ঠাণ্ডায় তো জমে জায়গা। কী উপায় টুপায় হোগা?’
অখিলদা সম্মান করে হিন্দিতে সবাইকেই ব্যাটা বলতেন।
“সে শুনে বুড়ি কী বলেছে, অখিলদা কিছুই বোঝেনি। তখন বুড়ি অখিলদাকে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে ফায়ারপ্লেস দেখিয়ে দিয়ে আবার রুটি করতে গেছে। অখিলদা খানিকক্ষণ এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে কিছু না পেয়ে আবার গিয়ে বুড়িকে বলেছে, ‘কোথাও তো কাঠকোট কিছু নেই হ্যায়। তাহলে ফায়ারপ্লেস মে জালায়গা কেয়া?’ বুড়ি এবারে আর উত্তর দেবার দরকার মনে করেনি।
“অখিলদা তখন এসেছে বন্ধুদের কাছে। বলেছে, ‘শোন, রাত্তিরে কিন্তু খুব ঠাণ্ডা হবে। বুড়িটাকে জিজ্ঞেস করলাম, বলছে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে শুতে। কিন্তু কাঠ কোথায় পাব? এই কথাটা বুড়িকে হিন্দিতে কী করে জিজ্ঞেস করব?’
“মধুকরদা – ওই যে রিপোর্টার (তখনকার দিনে খবরের কাগজে কাজ করা সবাই রিপোর্টার হতেন। জার্নালিস্ট কথাটা চালু হয়নি), তাস খেলতে খেলতে বলেছেন, ‘যা, গিয়ে বল, রাত কে লিয়ে লকড়ি কাহাঁ মিলেগা?’
“অখিলদা দু মিনিটে ব্যাক! ‘কী বলতে বলেছিস? বুড়িটা তো শুনে হাঁউ-মাউ করে কী সব “বদমাশ আদমী, বদমাশ আদমী” বলতে বলতে পালিয়ে গেল!’”
শুনে আমাদের চোখ চড়কগাছ! “অখিলদা, আপনি লকড়ি না বলে কী বলেছেন?”
অখিলদা হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বললেন, “এইজন্যই তো বলছি, হিন্দি ভাষাটাই গোলমেলে।”
অখিলদার তামাশার গল্পও শোনার মতো। একদিন এসে বললেন, “হরিপদর বাবা মারা গেলেন।”
হরিপদ কে রে বাবা! শুনে বোঝা গেল, হরিপদও অখিলদার কোনও বন্ধু, যে এখন শিকাগোতে থাকে, তার সব সাহেব বন্ধুরা তাকে হ্যারি বলে ডাকে। তার অসুস্থ বাবার দায়িত্বও এতদিন অখিলদারই ছিল, আজ মুক্ত হলেন। বললেন, “অদ্ভুত ব্যাপার, জানিস, হরিপদর বাবার এখন তখন অবস্থা, আমি ডাক্তারকে কল দিয়েছি। সকালে ডাক্তারবাবু এসেছেন তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। এসে বললেন, ‘জ্ঞান আছে?’ আমরা বললাম, ‘বুঝতে পারছি না। ডাকাডাকি করছি, সাড়া নেই।’ ডাক্তারবাবু ডেকে বললেন, ‘অনাদিবাবু, অনাদিবাবু…” আধখানা চোখ খুলে হরিপদর বাবা ডাক্তারকে দেখে একগাল হাসলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কেমন আছেন?’
“ঘাড়টা একদিকে কাত করে বোঝালেন, ‘ভালো।’ ডাক্তারবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘খেয়েছেন কিছু?’ আবার ঘাড় কাত করে জানালেন, ‘হ্যাঁ।’ অবাক হয়ে ডাক্তারবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খেয়েছেন?’ আমরা জানালাম, ‘না। কাল দুপুর থেকে একটু জলও দেওয়া যায়নি।’ ডাক্তারবাবু আবার বললেন, ‘কী খেয়েছেন? ও অনাদিবাবু, কী খেয়েছেন সারা দিনে?’ এবার চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন, সে প্রায় শোনা যায় না, ‘খাবি!’
“আধঘণ্টা বাদে মারা গেলেন। ভাব, কী সাংঘাতিক সেনস অব হিউমর!”
সাংঘাতিক সেনস অব হিউমর কার জানি না। অনাদিবাবুর, না অখিলদার। অখিলদার সেনস অব হিউমরের সম্মুখীন যে হয়েছে, সে কোনও দিন ভুলতে পারবে না।
শ্যামলের বিয়ে। শ্যামল আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু না, কিন্তু নেমন্তন্ন করেছে অনেককেই। সবাই মিলে স্থির করেছি, শ্যামলকে বিয়েতে বই দেওয়া হবে। তখনকার দিনে বিয়েতে বই দেওয়াটা খুব চল ছিল। যে কোনও বিয়েতে সাত আটটা সঞ্চয়িতা, চয়নিকা মিলিয়ে নবদম্পতি গোটা পঞ্চাশেক বই পেতেন। একদিন আড্ডায় দেবদত্তদা আমাকে বলেছে, “অনিরুদ্ধ, তুমি তো রোজ কলেজ স্ট্রিট যাও। একটা বই-টই কিছু কিনে এনো।”
আমি বলেছি, “দেখো, লোকটাকে আমি চিনিই না। কী পড়ে, না পড়ে, কী বই আছে, কিছুই জানি না। কী আনব বলে দাও।”
দেখা গেল, কেউই জানে না। এমন সময়ে অখিলদা বললেন, “টাকাটা আমাকে দিয়ে দে। আমি নিয়ে আসব।”
নির্দিষ্ট দিনে সবাই যাবার জন্য তৈরি, একে একে অসীমদার বাড়ি এসে জুটছি আমরা। অখিলদাও এলেন। হাতে রঙীন কাগজে মোড়া সুদৃশ্য বইয়ের প্যাকেট, তাতে পাখির ছবিওয়ালা গিফট ট্যাগ – কিছু লেখা নেই।
প্যাকেট এল আমার হাতে – তোমার হাতের লেখা ভালো… লিখে দাও কিছু। তারপরে শুরু হল, আরে, শুভেচ্ছা লিখো না… ও তো সবাই লেখে… ভালোবাসা লিখো না… সে তো শ্যামল ওর বউকে বলবে… আরে, আমরা সবাই লিখো না… সব্বার নাম দাও… ও অত জায়গা নেই?… দম্পতি লিখো না… অত লম্বা করে কিছু লিখো না…
শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছি, “ধুস, পারব না, যাও।” তখন অখিলদা বললেন, “দে, আমি লিখছি।” বলে কলম কেড়ে নিয়ে কী লিখলেন, তারপরে নিজের ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “কী বই, অখিলদা?” উত্তরটা এড়িয়ে গেলেন।
দু-সপ্তাহ বাদে শ্যামল ফিরে এল আমাদের আড্ডায়। মুখ এক্কেবারে গোমড়া। এটা-সেটা বলে বলল, “বিয়ের উপহারটা কার আইডিয়া?”
কী বলে রে? আইডিয়া মানে? বই দেওয়া হবে সে তো আমরা সবাই মিলে স্থির করেছিলাম। কী বই সেটা ঠিক করেছিলেন অখিলদা। আমরা ঠিক করতে পারছিলাম কী দেব…
“এই দেখ কী দিয়েছ,” বলে শ্যামল ব্যাগ খুলে বের করে দিল। দেখি বইয়ের নাম ‘মরণের পারে’, স্বামী অভেদানন্দর লেখা। কার্ডটাও রয়েছে ভেতরে। শ্যামল নিশ্চয়ই যত্ন করে রেখে দিয়েছে। তাতে লেখা আছে, ‘খেলাম, তাই দিলাম।’
পরে অখিলদা বলেছিলেন, “তো? ভুল কী হল? শ্যামলর নিশ্চয়ই বইটা আগে পড়েনি। আর বিয়েতে নিশ্চয়ই ওই বইটা আর কেউ দেবে না। সুতরাং দু দিক থেকেই অনিরুদ্ধর টেনশনের উত্তর পাওয়া গেল। আর বইটা তো সবারই পড়া উচিত, না কি? আজ না হলে কাল। বুড়ো হয়ে পড়তেই তো হত। না হয় এখনই পড়ে রাখল। হানিমুনে গিয়ে দুজনে একসঙ্গে পড়লেই বা ক্ষতি কী?”
দেবদত্তদা বলল, “আপনি বিয়ে করেননি বলে কী হানিমুনে লোকে কী করে তা জানেনও না?”
অখিলদা হেসে বললেন, “জানি বইকি! আরে, আমার ছোটোবেলার বন্ধু নীতিশের হানিমুনের ব্যবস্থা তো আমিই করে দিলাম। মাঝখান থেকে তারপরে আমার সঙ্গে কথাই বন্ধ হয়ে গেল।”
হাসি থামার পর জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? কী প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছিলেন?”
“আরে শোন না। এমন লোক, এসেছে সেদিন আমার কাছে। বলেছে, ‘অখিল, কোথায় হানিমুনে যাওয়া যায় বল তো?’
“আমি অবাক! নীতিশ আবার বিয়ে করেছে! জানিই না! এ কেমন ধারা!
“জিজ্ঞেস করতে রেগে গেল আবার! অদ্ভুত ব্যাপার। বলল, ‘আবার কোথায়? একবারই তো বিয়ে করেছি। কবজি
ডুবিয়ে খেলি, কোমরে গামছা জড়িয়ে সার্ভ করলি – ভুলে গেলি?’
“বললাম, ‘তা সে তো দশ বচ্ছর আগেকার কথা! সেই কবে বিয়ে করলে, আর এই হানিমুন যাচ্ছ?’
“তখন বলে, ‘আরে দশ বছর কোথায়? সাড়ে সাত পেরোল সবে। জানিসই তো, তখন বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, হানিমুন যাওয়া হয়নি। আজ ঠিক করলাম, ঘুরেই আসি।’
“বললাম, ‘ও, তাই বলো। কোথায় যেতে চাও?’
“বলল, ‘আরে অত যদি জানতাম, তাহলে কি তোর কাছে আসতাম? তোরা সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিস – কোথায় যাওয়া যায় হানিমুন, বলে দে না?’
“আমি বললাম, ‘আহা, কীরকম জায়গা অন্ততঃ সেটা তো বলবে! পাহাড়, না সমুদ্র, না মরুভূমি, ঐতিহাসিক জায়গা, না ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি…”
“বলল, ‘পাহাড়ই ভালো। গরমও পড়ছে বটে এবারে বেশ। এপ্রিলের শেষে, কিংবা মে-র শুরুতে যাব। কিন্তু বলে দিলাম, বাঙালির দার্জিলিং-এ পাঠাবি না কিন্তু। দার্জিলিং পচে গেছে।’
“অবাক হয়ে বললাম, ‘দার্জিলিং পচে গেছে? ক’বার গেছ?’
“‘যাইনি একবারও – কিন্তু যাব না। সবাই দার্জিলিং দৌড়য় কথায় কথায়। আমি আলাদা কোথাও যেতে চাই।’
“বুঝলাম। বললাম, ‘তা হলে গয়া যাও।’”
রাজাদা সবে চায়ে চুমুক দিয়েছিল। বিষম খেয়ে ভাঁড় থেকে সমস্ত চা-টা কোলে ফেলে দিল।
লাফালাফি চেঁচামেচি শেষ হবার পরে আবার যখন বসা হল, অসীমদা, দেবদত্তদা, আমি – সবাই, সমস্বরে (এবং তারস্বরে) বলতে থাকলাম, “ধ্যাৎ, হতেই পারে না! আপনিও এমন নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারেন না। সত্যি বলুন।”
অখিলদা অম্লানবদনে বললেন, “শোন, বলছি তো। প্রথমে নীতিশও একটু ঘাবড়ে গিয়েছে। বলেছে, ‘গয়া? গয়া কি ঠাণ্ডা? বিহারে তো।’
“আমি বলেছি, ‘তো কী হয়েছে? বিহারের ম্যাপটা ভুলে গেলে? এক্কেবারে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে গাঙ্গেয় সমতল হয়ে ছোটোনাগপুর অবধি না?’ তখন একটু থতমত খেয়ে বলেছে, ‘তা বটে।’”
জানতে চাইলাম, “তার পর?”
“তারপর আবার কী? মনের আনন্দে বউকে গিয়ে বলেছে, ‘হানিমুনের জায়গা স্থির হয়েছে। অখিল বলেছে, দারুণ জায়গা।’ কিন্তু কী জায়গা, বউকে বলেনি। বলেছে, ‘সারপ্রাইজ।’”
“তার পর?”
“তারপর রোজ আমার বাড়িতে যাওয়া আসা শুরু – কী কী লাগবে? কী কী নিয়ে যাব? লম্বা লিস্ট বানিয়ে দিলাম। দুজনের জন্য দুটো কম্বল – ওখানে হোটেলে কম্বল দেয় বটে, কিন্তু তাতে যদি না শানায়? গায়ে পরার জন্য উলিকটের থার্মাল আন্ডারওয়্যার, অন্ততঃ দুটো বড়ো হাতার সোয়েটার এক এক জনের। মাংকি ক্যাপ, মাফলার, উলের দস্তানা, ওভারকোট! শুনতে পেলাম বউ বুঝে গেছে পাহাড়ে যাওয়া হচ্ছে, খুব খুশি। শেষে এত জিনিস হল, যে বাক্স কিনতে হল, আর কম্বলের জন্য হোলডল। যাত্রার দিনে দুজনে খুশি খুশি আমাকে ফোন করে গেল হাওড়া।”
রাজাদা জানতে চাইল, “এ সব কবেকার কথা?”
অখিলদা বললেন, “আরে, এই তো গত বছর মে মাসে…”
উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলাম, “তারপরে কী হল? ফিরে আপনাকে মারতে আসেনি?”
“নাঃ। বরং ফিরে থেকে কথাই হয়নি। অন্য বন্ধুদের মুখে শুনেছি, সকালবেলা গয়া স্টেশনে ট্রেন থেমেছে –
হানিমুনিং কাপ্ল্ নেমেছে ট্রেন থেকে লটবহর নিয়ে। বউ এদিক ওদিক দেখে বলেছে, ‘এ কোথায় আনলে গো? এ কী রকম হিল স্টেশন?’
“নীতিশ দেখে সামনে পাহাড়! গয়া স্টেশনে সামনে তাকালে পাহাড় দেখা যায় না? বলে, ‘আরে ওই তো পাহাড়! চলো। এখন গরম লাগছে বটে, পাহাড়ে উঠলে আর ভাবতে হবে না।’”
“তার পর?”
“তার পর আর জানি না। সব কিছু জানতে হবে না। হুঁঃ!”
অখিলদা চলে গেলেন। শুনলাম প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলছেন, “বাঙালির দার্জিলিং ওনার পচে গেছে… শা–!”
৫ই মে, ২০২১