‘আলফা মেল’ (Alpha Male) এই শব্দবন্ধটি ১৯৭০ সালে ডেভিড মেক (David Mech) নিজের বই The wolf: Ecology and Behaviour of an Endangered Species-এ সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। সেখানে তিনি ১৯৪৭ সালে রুডলফ শ্ন্যাঙ্কেল (Rudolph Schenkel) দ্বারা নেকড়েদের উপর করা এক স্টাডি বা গবেষণার সাহায্য নিয়ে দেখান যে, নেকড়েদের মধ্যে কিছু নেকড়ে বেশ কর্তৃত্বপূর্ণ এবং আধিকতর প্রভাবশালী। তারাই এই নেকড়ে সমষ্টির নেতা হয়ে ওঠে, অন্যকে কন্ট্রোল করে, মহিলা নেকড়েরা সহজেই এদের সঙ্গিনী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ডেভিড মেক নিজেই এই গবেষণার সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেন এবং বলেন এই গবেষণা ত্রুটিপূর্ণ। কারণ এই গবেষণা হয়েছিলো বন্দি করে রাখা নেকড়েদের উপর,তাই তাদের ব্যবহারে-আচরণে কিছু পরিবর্তন চলে আসে। জঙ্গলে থাকা নেকড়েরা আসলে পরিবারের মধ্যে একসাথেই বেড়ে ওঠে, মিলিয়ে মিশিয়ে থাকে। এমনকি তিনি তাঁর প্রকাশককে বইটি প্রকাশ করতে বারণও করে দেন।
আজকের জনপ্রিয় ‘আলফা মেল’ কিংবা ‘বিটা মেল’ অথবা হাল আমলের ‘সিগমা মেল’ সমস্তটাই পরবর্তীকালে পপ মিডিয়ার হাত ধরে তৈরি। যেখানে বলা হয়-
আলফা মেল হল- এমন পুরুষ যা অনেকবেশি পুরুষালি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, সামাজিক স্তরের উপরের দিকে থাকে,মেয়েরা যাকে সহজেই পছন্দ করে, যে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, নেতৃত্ব দিতে পারে।
বিটা মেল– ঠিক আলফা মেলের উল্টো, তাদের পুরুষালি বৈশিষ্ট্য কম থাকে, মেয়েরা যাদের অবহেলা করে, যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা কম।
সিগমা মেল– এরা হল আলফা মেল এর আরও উদগ্র এক রূপ। যেখানে সে একাই যথেষ্ট, প্রচণ্ড স্বনির্ভর কাউকে পাত্তা না দেওয়া সফল এক পুরুষ।
Zoology বা প্রাণীবিদ্যার একটি শাখা হল ইথোলোজি (ethology), যেখানে প্রাণীদের আচার-আচরণ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা হয়। এখানে প্রাণীদের কিছু বিশেষ আচরণের ক্ষেত্রে এই আলফা মেল শব্দটি ব্যবহৃত হলেও মানুষের বর্ণনায় কখনই এর কোনও উল্লেখ নেই। স্পষ্টত প্রথম থেকেই মানুষের চারিত্রিক বিশ্লেষণে এই ‘আলফা মেল’ এর ব্যবহার, অবৈজ্ঞানিক এবং ভিত্তিহীন।
মোটামুটি ভাবে ১৯৮২ সালে প্রাইমেটোলজিস্ট (Primatologist) ফ্রান্স দ্য ওয়ল (Frans de Waal) তাঁর বই Chimpanzee Politics: Power and Sex Among Apes প্রথমবার ইথোলজির বাইরেও মানুষের ব্যবহার আর পারস্পরিক সম্পর্কের বর্ণনায় এই ‘আলফা মেল’ এর ব্যবহার করেন। সাংবাদিক জেসে সিংঙ্গেল (Jesse Singal) যিনি সে সময় New York Times-এ লেখালিখি করতেন তিনি, মিডিয়া হাউসের বিভিন্ন ইন্টারভিউতে এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন, এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে নিল স্ট্রস (Neil Strauss) তাঁর বিখ্যাত বেস্ট সেলিং বই The Game এ আলফা মেলের ধারনাকে জনমানসে জোরালো ভাবে হাজির করেন।
পাশাপাশি Pickup Artist Movement (PUA) এর বৈধতাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। PUA হল একটি আন্দোলন যা পুরুষের যৌনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, অন্যলিঙ্গের মানুষকে যৌনভাবে আকর্ষণ করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এবং অন্য লিঙ্গের উপর আধিপত্য বা কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যবহারই, পুরুষের সফলতার কথা বলে।
২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন ইন্টারনেট মিম, অনলাইন জার্নাল এবং মিডিয়া হাউসের রঙচঙে খবরের পাতায়, বিভিন্ন সিনেমায় এর ছড়াছড়ি চোখে পড়ে। আমেরিকান সাইকো (American Psycho) সিনেমায় ক্রিস্টিয়ান বেল (Christian Bale) অভিনীত প্যাট্রিক ব্যাটম্যান (Patrick Bateman) চরিত্রটি আলফা মেলের সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি সমস্যা হল এইসব শব্দবন্ধ বা ধারণাগুলো এসেছে প্রাণী জগতের উপর গবেষণা করে। পশুদের ক্ষেত্রে যেসব স্বভাব নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা হিসেবে চিহ্নিত হয়, তা সভ্য মানুষের ক্ষেত্রে উপযোগী নয়, এবং তা প্রাণী জগতের বদলে মনুষ্য জগতে প্রযোজ্য হলে তা ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। মানুষের পারসোনালিটি কিম্বা চরিত্র নিয়ে কোনও সাইকোলজিক্যাল গবেষণায় আলাফা মেলের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। মানুষকে আসলে এইভাবে সাদাকালো দুই ভাগে তাই ভাগ করে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে বুনিয়াদি সমস্যা। আলফা মেলের গল্পের আড়ালে নোংরা নারী-বিদ্বেষী পুরুষালি স্বভাবের গৌরবাখ্যান আমাদের পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও কিছুই করে না।
তাই নিজেকে ‘আলফা’ বা ‘বিটা’ পুরুষ ভাবার আগে প্রথমে নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখুন বা ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করুন। সর্বোপরি এই ভালো মানুষ হতে পারার চাহিদা যেন আমাদের সারাজীবন এগিয়ে নিয়ে যায়।