আজ প্রতিপদের ভাইফোঁটা। অথচ বহুল প্রচলিত কিন্তু ভ্রাতৃদ্বিতীয়াটিই।
এই নিয়ে ছোটোবেলায় খুব ঝামেলা হত। প্রতিপদে যাদের বাড়িতে ভাইফোঁটা হত, তাদের মেয়েরা খুব ঘ্যাম নিয়ে বলত, আমরা প্রতি পদেই ভাইদের কল্যাণ চাই। তাই প্রতিপদে আমাদের ফোঁটা।
আমার নিজের বাড়িতে ভাইফোঁটা প্রতিপদ দ্বিতীয়া কোনওদিনই হত না। সহোদরা ছিল না আমার। তাই বলে ফাঁকা যেতাম তা নয়।
ভাইফোঁটা নিতে যেতাম কোনও বছর বড়মাসীমণির বাড়ি, কোনও বার মামা বাড়ি। সবটাই ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায়।
প্রতিপদের ভাইফোঁটাও নিতাম। পাড়ার এক বাড়িতে গণভাইফোঁটার আসর বসত। সেই বাড়িতে। এই প্রতিপদেই। পাঁচ বোন তারা। তাদের বাবা সাসেপ্টিবল ছেলেদেরকে জোর করে ভাইফোঁটা নিতে বাধ্য করতেন যাতে তারা ইমিউনাইজড হয়ে যায়। কী সব ভুলভাল ধারণা! আমি সাসেপ্টিবল মানে ওই সাতে পাঁচে থাকা কেউ না হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়িতে লুচিমাংস মিষ্টির লোভে পঞ্চকন্যার প্রতিপদের ভাইফোঁটা নিয়েছি অনেকবার। আমি আবার একা যেতাম না। সঙ্গে বেপাড়ার ছেলে দিগম্বরকেও নিয়ে যেতাম।
আমি আধুনিক নামের সাগ্নিক বসু। দিগম্বর মিত্র আমার বন্ধু। এমনি বন্ধু না, স্কুল জীবনের বন্ধু। সবাই জানে স্কুল জীবনের বন্ধুদের মত শত্রু আর দু’টি হয় না। আমরাও তাইই ছিলাম। ওর পেছনে লাগতাম খুব। ওকে আড়ালে, প্রকাশ্যেও আদর করে নেংটি মিত্তির বলে ডাকতাম আমরা, বন্ধুরা।
গার্লস স্কুলের সরস্বতী পুজো দেখতে যেতাম দল বেঁধে। মেয়েগুলোও ওঁৎ পেতে থাকত। তখন সরস্বতী পুজোর দিনটা এমন ভ্যালেন্টাইনের দিন হয়ে যায়নি। আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। তবু দিদিমণিরা নেই এমন সময়ে আমাদের গ্রুপটা ঢুকলেই ওরা আমাদের নাম জিজ্ঞেস করত। আর নামের মানে। তাও।
আমাকে জিজ্ঞেস করলে ডাঁটসে উত্তর দিতাম জেমস বন্ডের স্টাইলে,” সাগ্নিক, সাগ্নিক বোস। সাগ্নিক মানে হচ্ছে…”
কথা শেষ করার আগেই দিগম্বরের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করত শয়তান মেয়েগুলো।
যেই বলত, “নামের মানে বলো”, দিগম্বর স্মার্টলি বলার চেষ্টা করত, বামনদেবের বই থেকে, “দিক অম্বর যাহার”। ওরা হইহই করে বলত, “অত সব শক্ত কথা বুঝি না, আসল মানে কী?”
নিষ্ঠুর আমরা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে আরও হেনস্থার মুখে ঠেলে দিয়ে বলতাম, “বল না, আমার নাম ন্যাংটা মিত্র!”
ওদের কেউ চুকচুক করে আওয়াজ করে বলত,”অ্যাই, অসভ্য কথা বলবে না। বলো, উলঙ্গ মিত্র।” বলেই সখীদের দিকে ফিরে বলত, “কে কে উলঙ্গ মিত্রকে ভালো ভাবে চিনতে চাও হাত তোলো।”
বেচারা দিগম্বর আমাদের হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য আকুল ভাবে বাঁ দিকের কোণে, যেখানে দিদিমণিদের দেখা যাচ্ছে, সে’দিকে যেতে চাইত। তা আমরা তাকে যেতে দিলে তো!
যাই হোক, কালের নিয়মে আমরা বড় হলাম। কলেজে টলেজে গেলাম। সবার কলেজ আলাদা। বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। আমরা চাকরিও করছি। তবু আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট রইল। আড্ডায়ও বসাতাম পুরোনো বন্ধুরা। সেখানেই দিগম্বর চুপিচুপি জানাল সে প্রেমে পড়েছে। কলেজের দু’ ইয়ার জুনিয়র। লীলাবতী। সেই মেয়েও রাজি। কিন্তু সমস্যা রয়েছে। বিরাট সমস্যা।
খোঁচাখুঁচি করতে জানা গেল মেয়ের পুরো নাম লীলাবতী মিত্র। মিত্র আর মিত্রে নাকি বিয়ে হয় না। বিংশ একবিংশ শতাব্দীতেও যে মিত্রদের মধ্যে মিত্রতার বিধান নেই, এ’কথা ওই দিগম্বরের ঠাকুরদা’ ছাড়া আর কেউ জানত বলে মনে হয় না। এই সেই ঠাকুরদা যিনি দিগম্বরের আপত্তিকর নামটা রেখে ছিলেন। আপত্তিটা সে’খানেই উঠবে বলে আন্দাজ। দিগম্বরদের ফ্যামিলিতে আবার হায়ারার্কির দাপট খুব।
লীলাবতী এই সবে পাত্তা দিতে চায় না। দিগম্বর আমাদের বন্ধুদের আড্ডায় কোনও কথা লুকোয় না।বলে, “লীলাদের বাড়ি, খুব লিবারেল। লীলা বলেছে, এই রকম বিয়ে ওদের চেনাপরিচিতদের মধ্যে হরদম হয়। বোসএ বোসএ হয়। ঘোষএ ঘোষএ হয়।”
আমরা বিজ্ঞজনেরা অবাক হবার ভান করে বলে উঠি,”বলিস কী, বসে বসেও হয় আবার ঘষে ঘষেও হয়!”
এর কিছুদিন বাদে ঠাকুরদারই বাতলে দেওয়া রাস্তায়, ওর এক মেসো লীলাকে লোক দেখানো দত্তক নিয়ে গোত্রান্তর ঘটানোর পর,দিগম্বরেরও বিয়ে হয় ওই লীলাবতীর সঙ্গেই।
বন্ধুরা আমরা বেজায় আনন্দে আবার ওর পেছনে লাগলাম মজা করে। “তোর আর অসুবিধে রইল না। বসে বসে, ঘসে ঘসে, যেমন খুশি।”
সেই সব দিন কেটে গেছে কবেই। আড্ডা আর হয় না। ফোনে ফোনে যে’টুকু সদালাপ। দিগম্বরের ছেলে মেয়ে বিদেশে থাকে। ওরা দু’জনেই শুধু ফ্ল্যাটে।
আজ সকালে সেই দিগম্বর ফোনে মনোবেদনা জানাল, তাকে ভাইফোঁটা দিত যে বোন সে এখন দূরদেশে। তাই এ’বার নাকি দিগম্বরের ফোঁটা পাওয়া হবে না। প্রতিপদের ফোঁটাও না। পঞ্চকন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইফোঁটার ইমিউনাইজেশনের পাট তাদের মিটেছে বহুদিন আগে।
তাকে জানালাম, ঠাকুর বলেছেন (Ref:- রামকৃষ্ণ কথামৃত) দুটি একটি ছেলেপুলে হবার পর,স্বামীস্ত্রী ভাইবোনের মত থাকতে হয়। সেই উপদেশ মত দিগম্বর নিজের বাড়িতেই লীলার কাছে ফোঁটা পেতে পারে। ও উল্লসিত হল কিনা বোঝা গেল না।
সেই থেকে তাকে ফোনেও পাচ্ছি না। বন্ধ।
সম্ভবত ভাইফোঁটা চলছে।