ভবতারণবাবুর এই এক নতুন সমস্যা। আরো কিছু সমস্যা তার আগে থেকেই আছে।
সেদিন ব্যাঙ্কের ছেলেটা বললো- কাকু, এটা কি আপনার সই? মিলছে না তো।
– আমিই তো করলাম।
চেকটা বাড়িয়ে দিয়ে বললে- আর একবার করুন। এখানে, এই যে এই খানটায়।
– ঠিক আছে দাও।
এরা চেনা লোক। পনেরো বছর ধরে পেনশান তুলছেন। বছরান্তে নিজের হাতে ‘জীবিতের সংশাপত্র’-টাও জমা দিয়ে যান।
তবুও সমস্যাটা হচ্ছে। একটু একটু করে বাড়ছে। তবে অন্য সমস্যাটা খুব মারাত্মক। সেদিন মাছের বাজারে সুবলকে মাছের দাম দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে ফিরতে যাচ্ছেন তখন সুবল বললো- পোস্ট আপিস সামলে, ভবো কাকা।
প্রথমে ঈঙ্গিতটা বুঝতে পারেননি। পরে বুঝলেন এবং বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি প্যান্টের চেনটা টেনে দিলেন।
আজ সাত বছর হলো তার সঙ্গিনী সুভদ্রা গত হয়েছেন। ছেলে বৌমা কানাডায় তাদের একমাত্র সন্তান নিয়ে থাকে। দুই তিন বছরে একবার আসে। কয়েকদিন থাকে।
তারা যে খুব নিজের এটা আর অনুভব করেন না ভবতারণ মুখোপাধ্যায়।
সেদিন স্টেশনের চার নম্বর কাউন্টারের সামনে একটা ছেলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো,- জ্যেঠু ভালো আছেন, আমি সুমনের বন্ধু। আমার নাম বিমল কান্তি দত্ত। আপনি চিনতে পারছেন?
সত্যি বলতে গেলে তাকে চিনতেই পারেননি ভবতারণ। না মুখাবয়ব, না গলার স্বর।
– আপনি আমাকে ইংলিশ নিতে বলেছিলেন। আমি এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রফেসার। সুমন তো বিদেশে?
– হ্যাঁ, বিলেতে। না না আমেরিকায়।
– ও যে আমাকে বলেছিলো কানাডা।
– কানাডা না? তাই হবে, কানাডাই হবে।
– জ্যেঠু কোয়ান্টাম থিয়োরির ওপরে আপনার লেখা বইটা এখন আমাদের কলেজের লাইব্রেরিতে হট কেক। মাসে অন্ততঃ তিন বার ইস্যু হয়। আমি তো লাইব্রেরি কমিটির মেম্বার।
– ও, সেটা ভালো খবর।
– জ্যেঠু আমার ট্রেন এসে গেলো, চললাম। সাবধানে থাকবেন।
চলে গেলো ছেলেটা। আসলে এরা আর ছেলে নেই এরা চল্লিশের গন্ডি পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়াতে পৌঁছে যাওয়া এক একজন মানুষ ।
স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের দূরত্বে একটা ফুটবল, ক্রিকেট খেলার মাঠের সীমান্তে তাঁর বাড়ি। দোতলা একটা ছোট্ট কুটির। যখন সুভদ্রা ছিলো সুমন ছিলো তখন সেটা বাড়ি ছিলো এখন সেটাকে আর বাড়ি বলা যায় না। পাঁচিল ঘেরা ইঁট কাঠ পাথরের একটা বাসস্থান। চৌহদ্দির মধ্যে একটা নারিকেল গাছ ছিলো। সেটা আর নেই শুকিয়ে গেছে। একটা ডালিম গাছ ছিলো। পরিচর্যার অভাবে সেটাও মৃতপ্রায়।
কাজের একটা মেয়ে আসে সকালে সে রান্না করে দেয়, ঘর গুছিয়ে দেয়। বাকিটা নিজে হাতে করতে হয়।
তবে কে আছে তার রক্ষণাবেক্ষণে? আছে কিছুটা দূর এগিয়ে সুভদ্রার তুতো ভাইয়ের ছেলে বৌমা আছে। তাদের ওপরে ন্যস্ত আছে তাঁর দেখভাল করার দায়িত্ব।
বৌমাটা বোধহয় মেয়ে খারাপ নয়। কিন্তু ভাইপো ছেলেটি ঠিক সুবিধার নয়। নানা অছিলায় সে টাকাপয়সা চায় এবং তিনি বাধ্য হয়েছেন কিছু দিতে।
সকালে একটা ব্লাড প্রেসারের ট্যাবলেট তাঁর রোজকার বরাদ্দ। কিন্তু তিনি মনে করতে পারছেন না ওষুধটা আজ খেয়েছেন কি না! এই ধরনের দ্বিধা যে আগে হয়নি তা নয়। কিন্তু আজ কিছুতেই ফয়সালা করতে পারছেন না।
হাঁটতে হাঁটতে গেলেন পরিচিত ফার্মেসিতে যেখান থেকে নিয়মিত ওষুধ নেন।
দোকানদার বসতে বলে ফুস ফুস করে তার অটোমেটিক মেশিনে ব্লাড প্রেসার মেপে বললো,- থাক একদিন যদি নাও খান কিছু অসুবিধা নেই। কাল থেকে নিয়ম করে খাবেন। আগের রাতে পরের দিনের বরাদ্দ ওষুধগুলো আলাদা করে রাখবেন।
ভবতারণবাবু কলেজে পড়াতে গিয়ে কখনও বই কিম্বা নোটের সাহায্য নিতেন না। পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্বগুলো ঠোঁটে লেগে থাকতো। ছাত্ররা বলতো স্যার পদার্থবিদ্যার চলন্ত টেক্সট বুক।
সেলুনে গিয়ে ভবতারণবাবু রবি নামের ছেলেটাকে টাকা দিলেন। বরাবরই এই সেলুনে এর কাছেই চুল কাটান। সুমন যখন ছোট ছিলো তাকেও ছুটির দিনে নিয়ে আসতেন। খুব কান্নাকাটি করতো। রবি ঠিক সামলে নিয়ে একটা উঁচু চেয়ারে বসিয়ে খুব যত্ন নিয়ে চুল ছেঁটে দিতো। বড় হওয়া ইস্তক সেও বরাবর এখানেই চুল কাটাতো। এখনও বিদেশ থেকে এলে সে রবির কাছে চুল কাটিয়ে নেয়।
-টাকাটা ফেরত দিয়ে রবি বললো,- একবার তো দিলেন কাকু।
দিয়েছেন কিনা মনে করতে পারছেন না ভবতারণবাবু। তবু টাকাটা ফেরত নিয়ে পকেটে রাখলেন।
সুমন রাতের দিকে ফোন করে। তিনি ন’টা থেকে দশটায় খেয়ে শুতে যান। সে সময়ে ওর ফোন আসে। এখনও আসে। আগে আরো বেশি আসতো। ও একটা কলেজে পড়ায় ওটাওয়া-তে। এই নামটা মনে থাকে। কিন্তু সেটা আমেরিকার না কানাডার না বিলেতে সেটা গুলিয়ে যায় তাঁর।
আজ যে রবিবার ভবতারণবাবু সেটা ভুলে পোষ্ট অফিসে চলে গেলেন। বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন এবং মনে মনে বেশ খুশি হলেন যে আজ তিনি লাইনের প্রথমেই থাকবেন। কাউন্টার খুললেই তার পালা আসবে। মান্থলি স্কিমে কিছু টাকা তুলে বাড়ি ফিরবেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে দশটা প্রায় বাজে। কোন কর্মচারী এখনও আসেনি।
কর্মসংস্কৃতি নিয়ে কখনও তিনি উচ্চকন্ঠ নন। তিনি জানেন এটা নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের সদিচ্ছার ওপরে আর কিছুটা কর্তৃপক্ষের চাপের ওপরে। কেউ নিজগুণে ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ হয় তো আবার কেউ ফাঁকিবাজ।
কিন্তু সরকারি অফিসে কেন আধঘন্টা দেরি হবে দরজা খুলতে?
– স্যার, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কেউ আসবে?
– কে বিমল?
– আমি বিজন স্যার। কেউ কি আসবে?
– না কেউ তো আসবে না। দেরি করছে গেট খুলতে? আমি লাইনে প্রথম। তুমি দাঁড়াও আমার পেছনে।
– স্যার আজ তো রোববার, আজ কেন পোস্টাফিস খুলবে?
একথা তো তাঁর মনে হয় নি যে আজ রবিবার। বড় ভুল হয়ে গেছে। গেটে তালা দিয়ে এসেছেন বাড়িতে। বাথরুম পরিষ্কার করার ছেলেটা আজ আসে। নির্ঘাত ফিরে যাবে।
একটু অপ্রস্তুত বোধ করে নিজেকে সামলে নিলেন এবং বললেন,- তাই তো একদম খেয়াল নেই। ঠিকই বলেছো আজ রোববার। আমি যাই সুইপার আসবে বাড়িতে।
– সাবধানে যাবেন, স্যার।
পঁচাত্তর বছর বয়স হলো। পেনশনের টাকা অনেকটা বেড়ে গেছে। কমিউটেশনের টাকাটা যোগ হয়েছে এই পেনশন ক্যালকুলেশনে। ছেলে মাঝে মাঝে পাঠায়। তবে সেটা তাঁর দরকার হয় না। চারটে নিজের লেখা বই থেকে প্রকাশকরা কিছু কিছু টাকা দিতে বাধ্য হয়।
বিকেলে মাঠের কিনারায় বসে গল্প করেন দু একজন সমবয়সী লোকের সাথে। আজও কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে বসেছিলেন। কৃষ্ণকান্ত ঘোষ সমবয়স্ক, তাঁর সঙ্গে একই কলেজে চাকরি করতেন তিনি ছিলেন অফিসের নন টিচিং স্টাফ। তবুও দুজনের হৃদ্যতা ছিলো। কলেজ শেষে ফেরতা পথে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ফিরতেন। বেশি দূরে তো ছিলো না। হয়তো সাকুল্যে মাইল দুয়েক হবে। কৃষ্ণকান্ত এখন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন, তাঁর হাঁটুতে ব্যথা। লাঠি নির্ভর জীবন। তাঁর ছেলে একটা আর দুটি মেয়ে। সবার বিয়েথা হয়ে গেছে। ছেলে একটা সরকারি চাকরি করে। বারাসাত অঞ্চলে। একটা ছোট দোতলা বাড়িও করেছে। হাঁটুর সমস্যা ছাড়াও আরো কিছু শারীরিক সমস্যা তাঁর আছে। তবুও নাতিনাতনি নিয়ে বেশ খোশ মেজাজে থাকেন। তাঁর স্ত্রী এখনও জীবিত।
বিকেলের ফুরফুরে হাওয়াতে কৃষ্ণকান্ত বললেন ,- সামনে তো ভোট ভবো- দা, কি মনস্থির করলেন?
– আমাদের মতামতের কি দাম?
– আপনিই তো আগে বলতেন যারা শিক্ষিত তারাই যদি নির্বাচনে এগিয়ে না আসে তবে ভালো কাজ কি করে ঠিক হবে?
– ও সব কথার কথা। ভোটে কিছু হয় না।
কৃষ্ণকান্ত খেয়াল করেছেন আজকাল এই বিচক্ষণ মানুষটি সব সময় কেমন যেন নিস্তেজ থাকেন । কোন কিছু বললে ঠিক উত্তর দেন না। নিঁখুত হিসাব করা মানুষটি সেদিন মুদির দোকানের সামান্য যোগফলে ভুল করে বসলেন। ধরিয়ে দিলে তিরিক্ষি মেজাজে দোকানিকে একটু কটু কথা একটা ছোট গালাগালও করলেন। কখনও ভবতারণবাবু আবার নৈরাশ্যের মেঘের নীচে তলিয়ে যান। বারবার ডাকার পরে হুঁ শব্দ করে সাড়া দেন। একদিন দুই পায়ে দুরকম চটি পরে এসে বসলেন এই কৃষ্ণচূড়ার নীচে বৈকালিক অধিবেশনে। কানাইলাল সরকার যিনি বরাবর একটু রসিক মানুষ। বলল,- মুখুজ্যে মশায়ের কি একপাটি জুতো কুকুরে নিয়ে গেছে? ভবতারণবাবু শুধু তখনই খেয়াল করলেন যে তাঁর দু পায়ের চটি দু’রকম।
কমলা বলে যে মেয়েটি রান্না করে বাসন মাজে, সে সুভদ্রার আমলের। তাঁকে দাদা বলে ডাকে। কমলার মাস মাইনের টাকা সুমন ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেয়। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও সে সেটা করে। তিনি নিতে চান না। তাঁর তো যা আছে চলে যায়।
একদিন কমলা দেখলো দাদা গেঞ্জিটা কিছুতেই পরতে পারছেন না। একটা হাত ঢুকিয়ে আর একটাকে কিছুতেই সামলাতে পারছেন না।
– ও দাদা, কি হলো বাঁ হাতটা ঢোকাও। আমি টেনে দিচ্ছি, নাও এবার ঠিক হয়েছে।
আসলে অনেক কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না। খেই হারিয়ে যাচ্ছে কথার সাবলীলতায়।
রাতে ছেলে ফোন করলো। নিয়ম করেই সে ফোন করে। ভবতারণবাবু ধরে ‘ হ্যালো’ করলেন কিন্তু আর এগোতে পারছেন না।
– বাবা, শরীর ঠিক আছে তো? বাবা চুপ করে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
– তোর মার সাথে কথা বল।
স্তম্ভিত হয়ে গেলো সুমন। কিছুক্ষণ ফোন ধরে রইলো। বুঝলো তার বাবা এরকম কথা আগে কখনো বলেনি। মা মারা যাওয়ার সময় সুমন আসতে পারেনি। সে পাপ-বোধ তার আছে।
বাবা কি সেটা নিয়ে নিরন্তর চিন্তা করে?
এই রাতে এখন সে কাকে ফোন করবে? কৃষ্ণকাকার ফোন নম্বর তার কাছে আছে। এতো রাতে কি তিনি জেগে আছেন?
– খোকা, বৌমা কি করছে?
– আমি তো অফিসে বাবা, এখন তো দুপুর এখানে, তোমার বৌমা তো বাড়িতে।
– ও আচ্ছা। আমার ঘুম পাচ্ছে।
– ঠিক আছে। তুমি শুয়ে পড়ো, ওষুধটা খেয়ে নিও। আমি কাল আবার ফোন করবো।
সুমন খুব অস্থিরতায় ভুগলো কিছুক্ষণ। আর একটা ফোন করলো কৃষ্ণকাকার বাড়িতে- কাকা, আমি সুমন বলছি, চিনতে পারছো কি, কানাডা থেকে?
– বলো, বলো বুঝতে পেরেছি। বাবাকে ফোনে পাচ্ছো না?
– না কাকা, পেয়েছি। কিন্তু তার কথাবার্তায় কিছু অস্বাভাবিকতা বোধ হলো। সেটা কনফার্ম করার জন্য তোমাকে বিরক্ত করলাম।
– না সুমন, বিরক্ত কেন করবে। তোমরা কাছে নেই বলেই তোমাদের বাবা একা আছেন। আমরা ছাড়া আর কে খোঁজ খবর দেবে বল?
– তোমার তেমন কিছু কি মনে হয়েছে?
– মনে হয়েছে, বাবা। ভবদা আমার থেকে মাত্র দু’ বছরের বড়। কিন্তু ইদানিং তাকে বড়ো আনমনা লাগে। তোর মা চলে যাওয়ার পর থেকে আরো বেশি অগোছালো মনে হয়। মাস তারিখ বার গুলিয়ে ফেলছে।
– তোমার কি মনে হয় এটা বয়সজনিত।
– আমরা যারা গাছতলাতে আড্ডা দিই তারা অনেকেই তো দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকে নাতি নাতনিদের পড়া দেখিয়ে দেয়। একজন তো মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলার হয়ে খুব ভালো কাজ করছে।
– বাবার তো পঁচাত্তরের কাছে বয়স হলো। এখানে অনেকে এই বয়েসে ডিপার্টমেন্টে পড়ায়।
– হয়তো তোর মা থাকলে এমন হতো না।
– কৃষ্ণকাকা, হয়ত সত্যি কিন্তু সেখানে আমাদের কি কোন হাত আছে, কাকা?
– সত্যি নেই।
– আমাকে একটু আগে বাবা বললো তোর মায়ের সাথে কথা বল।
কৃষ্ণকাকা একটু সময় নিয়ে বললো,- হচ্ছে, মাঝে মাঝেই অন্যের নাম ভুলে যায়। কথা বলতে বলতে ‘শব্দ’ খুঁজে পায় না। আমাকে কৃষ্ণ বলতে গিয়ে কখন অন্য নামে ডেকে বসে।
– বাবা কি ওষুধ খায় নিয়মিত?
– যতটুকু জানি রোজ বরাদ্দগুলো খায়। তুই একবার ফার্মেসির সুবলবাবুর সাথে কথা বলে নিস। ওরা সবাই তোকে চেনে। পরিচয় দিলেই হবে।
– বাবাকে কি কলকাতায় নিয়ে কোন ডাক্তারকে দেখাতে হবে? সাইকিয়াট্রিস্ট কিম্বা নার্ভের ডাক্তার?
– কলকাতা থেকে একজন নিউরোলজিস্ট মাসে একবার আসে একটা পলিক্লিনিকে। তাকে একবার দেখালে হয়?
– আমি তাহলে প্রবীরদাকে বলে দেব যোগাযোগ করে দেখিয়ে নিতে।
– ওর নাম করলেই ভবো-দা বেশ বিরক্ত হয়। ঠিক আছে আমি খোঁজ নিয়ে তোকে বলব ।
– আমি ফোন করলে এরকম সময়েই করব ।
– ঠিক আছে। আমার কোন অসুবিধা নেই। আসলে মানুষটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না। যে মানুষটার মুখে আমরা কখনও অশালীন কথা ভাবতেও পারিনা। সেদিন রেগে ফলওয়ালাকে ‘ শালা’ বলে গাল দিল। ভবো-দার মুখে কু কথা শুনে সে ও অবাক।
– আমি এতো দূর থেকে তো কিছুই করতে পারছি না। এখন মিড সেমেস্টার চলছে। যেতেও পারব না।
– তোমাকে অতটা উতলা হতে হবে না। আমরা নার্ভের ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করি।
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাসটা হু হু করে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়ায় আবার ছেড়ে দেয়। একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলেন ভবতারণবাবু। বাসের দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেল । খুব ভোরের গাড়ি তাই লোকজন একটু কম।
– টিকিট, টিকিট, কাকু ভাড়া দিন।
ভাড়া শব্দটা মনে হলো ভবতারণবাবু এই প্রথম শুনলেন। কন্ডাক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বিশ টাকার নোট বার করে হাতে ধরে রইলেন।
কন্ডাকটর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে পরে প্রশ্ন করলো- কোথায় যাবেন?
কোথায় শব্দের কোন উত্তর জানা নেই ভবতারণ বাবুর। কিন্তু যাবেন শব্দটার মানে জানেন। এই দুটো শব্দ পর পর যদি কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে, তবে তার উত্তর কি হবে? পেটে আসছে অথচ মুখে আসছে না। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং গেটের দিকে চললেন।
– পয়সা ফেরত নিন ও কাকু। যত্তোসব পাগল।
নামার পরে মনে পড়লো তিনি যেতে চাইছিলেন নেপালগঞ্জ। সেখানে একটা বাঁকা নদীর পাড়ে ছোট হাট বসে। চাষিরা কাঁচা মাল বিক্রি করে আর মদনের চায়ের দোকানে চা বিস্কুট খায়। একবার এসেছিলেন তখন তিনি খুব হাঁটতে ভালোবাসতেন। ছুটি পেলে হাঁটার আনন্দে আশপাশের অনেক গাঁ গঞ্জে ঘুরেছেন। এই তো সেই বটের নীচে বাঁধানো চাতাল। তিনি হাঁটতে থাকলেন। একটা পোড়ো মন্দির। অনতিদূরে শান বাঁধানো কিন্তু অতি প্রাচীন কালো জলের গভীর পুকুর। তিনপাশে বাঁশ ঝাড়।
এখানে একটা ছেলে তাঁর ক্লাসে খুব ভালো উত্তর করতো। মনে আছে তার নামটা, বিভাস। তাদের বাড়িতে কাঠের ঘানি ছিলো। দুটো চোখ বাঁধা বলদ নিরন্তর ঘুরে ঘুরে সরিষার তেল বার করতো। আজ কি বার, আজ কি বিভাস বাড়ি আছে? নিজে খুশি হলেন তার নামটা মনে আসাতে।
আরো খানিকটা এগিয়ে একটা ঈদগা।
একটু গাছের ছায়ায় বসলেন ভবতারণবাবু। এই ঈদগাতে তিনি আগে এসেছেন। কথা হয়েছিলো পীর সাহেবের সাথে। স্পষ্ট মনে আছে তাঁর নাম মোশারফ হোসেন। আমডাঙার বেড়াবেড়িতে তাঁর বাড়ি। অন্নসংস্থানের জন্য এখানে থাকেন।
পথচলতি একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,- মোসারফকে কোথায় পাওয়া যাবে। সে বললো মৌলভী সাহেব বাড়ি গেছেন দুই একদিন বাদে আসবেন।
এখনও সকাল তেমন স্পষ্ট হয়নি। মোরগের বাক আর পাখ-পাখালির কুজনে ভরে আছে জঙ্গলাকীর্ণ এই জনবসতি।
কাল রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। সারারাত খুটখাট আওয়াছে তিনি সতর্ক থেকেছেন। মনে হচ্ছিল কেউ কি অনধিকার প্রবেশ করেছে।বাইরের দরজা গ্রীল বারবার দেখে এসেছেন। তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি। ভোররাতে কেউ তাঁকে বাইরে ডেকে নিয়ে আসে। দরজা খুলে অবশ্য কাউকে সামনে দেখতে পাননি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পাকা রাস্তায় এসে সামনে বাসটা পেয়ে উঠে পড়লেন।
জেলেরা টানা জাল কাঁধে আর হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাঁড়ি নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে। তাঁর বোধ হয় ক্ষিদে পেয়েছে। এ সময় কমলা চা বিস্কুট দেয়। কমলা কি এখন এসেছে বাড়িতে? পকেটে চাবি তো নেই। তবে কি তালা দেওয়া হয়নি দরজায়? কি হবে?
চিন্তা ভাবনার কুয়াশার মাঝে তাঁর মনে হলো। বাড়ি যাওয়া দরকার। দরকার কিছু খাওয়ার। পেটের ভিতরে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে ক্ষিধেতে। বেশ অনেকক্ষণ না খেয়ে আছেন তিনি। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলেন সেই রাস্তা ধরে আবার ফিরে এসে বড় রাস্তায় পড়লেন ।
কমলার পাঁচ বাড়ির কাজের শুরুটাই হয় এই বাড়ি থেকে। মাসিমা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকে এখানে এসে চা বিস্কুট খেয়ে কাজটা শুরু হতো। বাসন মাজা ঘর ঝাঁট দেয়া আরো একটু ফাইফরমাশ। আগে রান্নাটা করতে হতো না। এখন সেটা যোগ হয়েছে।
বাইরের গেটটা শুধু ভেজানো আছে দেখে কমলার কিছু সন্দেহ হল । ভিতরে গিয়ে দেখল বাবু ঘরে নেই। পাশের বাড়ির কাকিমা-কাকুকে জিগ্যেস করেও কিছু বোঝা গেল না। শুধু খবরের কাগজওয়ালা বললো, সে ভবতারণবাবুকে বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে দেখেছে।
কমলা জানে কাছাকাছি বন্ধু চেনাজানা লোক বলতে কৃষ্ণকান্তবাবুর সাথে একটু যা যোগাযোগ। কিছু খবর দেয়া নেয়া করতে গেলে কৃষ্ণকান্তবাবুকে প্রথমে জানাতে হবে।
কমলা তার বাড়ি চেনে। কড়া নাড়তেই কৃষ্ণকান্তবাবু বেরিয়ে এলো।
– কি হয়েছে?
– বাবুকে সকালে এসে দেখছি না। দরজা খোলা ছিলো।
– সে কি? প্রবীরকে জানানো হয়েছে?
– না, এখনও কাউকে বলা হয়নি।
– আমি প্রবীরকে একটা ফোন করছি। তুমি চলো।
প্রবীর এলো, আরো পাড়ার দু চারজন এসে জড়ো হলো। কি করা হবে এই সকালে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বলতে গেলে প্রবীরই নিকটতম। তার কথা সর্বাগ্রে গ্রাহ্য হবে।
একজন বৃদ্ধ মানুষ ভোর রাত থেকে নিখোঁজ এটা আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো কিছু ব্যাপারই নয়। তবু প্রবীর বললো,- আমার মনে হয় একটু অপেক্ষা করা উচিৎ। ন’টা অবধি দেখে নিয়ে তারপর দরকার হলে থানায় জানাবো।
– সুমনকে কি জানানো হবে?
– তখন জানানো হবে, এখন নয়।
কমলা কয়েক কাপ চা বানাল। যারা এসেছিল সবাইকে দিল।
ভবতারণবাবু বাজারে যান, দোকানঘাট করেন ব্যাঙ্ক পোষ্টঅফিস করেন। কিন্তু যাই করেন তার একটা সময় আছে এই সাত সকালে কমলা আসার আগে কখনও বার হন না। অবশ্য এটাও ঠিক খুব প্রয়োজন হলে তিনি কি-ই বা করবেন। কখনও যদি ইমারজেন্সি কোন ওষুধ বা ভীষণ দরকারি কোন জিনিসের দরকার হয় তখন তাঁকে বেরোতে তো হবেই। প্রবীর তন্ন তন্ন করে সব টেবিল চেয়ারগুলো ঘেঁটে দেখলেন কোথাও কিছু লিখে টিকে রেখেছেন কিনা। কাছাকাছি আরো দু এক জায়গায় লোক পাঠানো হ’লো। তারা ফিরে এসে সুসংবাদ কিছু দিতে পারলো না। না আপাততঃ কোথাও কোন সূত্র মিললো না।
প্রায় হতাশ হয়ে সবাই যখন ঠিক করছে থানায় গিয়ে কি কি বলবে এবং কিভাবে বলবে।
সে সময়ে মাঠের কোণাকুণি একটা লোককে আসতে দেখে সবার মনে হলো তিনি ভবতারণবাবু হতে পারেন । একহাতে একগোছা শাকপাতা আর অন্য হাতে একটা কালো পলিপ্যাকে কিছু একটা ধরা।
স্পষ্ট হলো তাঁর অবয়ব। সবাই নিশ্চিন্ত হলো তাঁকে নিরাপদে ফিরতে দেখে।
তিনি মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন, কিন্তু কিছু অনুধাবন করতে পারলেন না কেন এই সকালবেলা সবাই এখানে হাজির।
– কোথায় গিয়েছিলেন কাকা?
– গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথায়? মনে হয় বাজারে। না না বাজারে নয়। অন্য কোথাও হবে।
– এগুলো কোত্থেকে নিলেন?
– একজন দিলো, বললো নিয়ে যান ভালো হবে।
কৃষ্ণকান্ত কথা বাড়ালেন না। কিন্তু এটা বুঝতে পেরে বিমর্ষ হলেন, কে সামলাবে এই একক মানুষের পরিবারের একক সদস্যকে?
– কমলা, আমি চললাম, দাদার রান্না বসিয়ে দাও,প্রবীর আমি চললাম। আজ রাতে সুমনের সাথে আবার কথা হবে।
অসময়, তবুও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ভবতারণবাবু। আর ঘুম থেকে উঠেই মাথার মধ্যে পাক খেতে শুরু করলো একটা শব্দ। বার বার ঘুরে ফিরে আসছে এই শব্দ দুটো ‘কমলা সুন্দরী, কমলা সুন্দরী, সুন্দরী কমলা’।কমলা এই বাড়িতে আসছে অন্ততঃ বারো বছর। তখন ও পনেরো ষোল বছরের হবে। এখন সে বিবাহিতা এবং দুই সন্তানের মা। কৃশকায়া এবং কৃষ্ণাঙ্গী কমলা। কয়েকটা পাড়া ডিঙিয়ে গিয়ে থাকে। তার স্বামী রিকশা চালায় এবং মদও খায়। কমলা বিশ্বস্ত এবং যত্নশীলা। সে অনেকটা কাজও করে দেয়।
ভবতারণবাবুর মাথায় কমলা নামটা চরকির মতো ঘুরতে থাকলো।
কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে প্রাত্যহিক বৈকালিক আসর। বয়সজনিত হাঁটুর ব্যথা গ্যাস অম্বল থেকে পেনশানে প্রাপ্ত টাকার অপ্রতুলতা আর কেন্দ্র ও রাজ্য রাজনীতির নানান আলোচনার মাঝে ভবতারণবাবু ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আলোকের প্রতিফলন প্রতিসরণ নিয়ে একটা ছোটখাটো লেকচার দিলেন। কুড়ি বছর আগে নিঃশব্দ ক্লাসে যেভাবে পড়াতেন। বাকি বন্ধু ও উপস্থিত সবাই উৎসুক হয়ে রইলেন আর উৎসাহ দিয়ে গেলেন আরো বলতে।
কিন্তু তিনি থামলেন এবং বললেন,- এবার সুমন বিলেত থেকে এলে বলব, তুই এখানে থেকে যা। তোকে ফিজিক্স পড়াব। তোর শিক্ষাটা ঠিক হয়নি।
– দাদা সে-ই তো এখন অন্যদের পড়ায়, বড় কলেজে।
– সে তো ঠিক। তবে কি আমিই কি চলে যাব? সেখানে পড়াব। আমি ইংলিশ লেকচার দিতে পারি।
প্রসাঙ্গন্তরে যাওয়ার জন্য কৃষ্ণকান্ত বললো,- দাদা সকালে কোথায় গেছিলেন?
– সকালে, কই না তো। সত্যি গেছি, মনে করতে পারছি না। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।
– সে কি মোহনপুর?
– আমি জানি না। তবে আগে গেছি এক দু বার।
এক শুক্রবার স্থানীয় পলিক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো ভবতারণ মুখার্জিকে। কলকাতার বড় হাসপাতালের এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর সুযোগ মিললো। যেহেতু কৃষ্ণকান্ত ভবতারণবাবুর কাছাকাছি অনেকক্ষণ থাকেন তাই প্রবীর সঙ্গে থাকলেও তাঁকেই ভিতরে ঢুকতে বলা হলো।
প্রাজ্ঞ চিকিৎসক। কথা শুনলেন এবং প্রশ্ন করলেন ।
ভবতারণবাবু প্রশ্নোত্তরে প্রায় সবই বললেন।
– আপনি কি ভালোবাসেন?
– পড়াতে।
আরো কিছু কথা হওয়ার পর। ভবতারণবাবুকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হ’লো। ভিতরে রইলো প্রবীর ও কৃষ্ণকান্ত।
– ডাক্তারবাবু কেমন দেখলেন?
– ওনার কাছের লোক বোধহয় কেউ বিশেষ সঙ্গে থাকে না?
– না, ডাক্তারবাবু। আমরাই দেখাশুনো করি।
– মামুলি কিছু টেস্ট করতে হবে। কিছু রক্তের এবং একটা সি টি স্ক্যান। হয়তো কিছু পাওয়া যাবে না। তবুও করতে হবে। ব্রেনে কোন টিউমার বা রক্তক্ষরণ আছে কিনা দেখতে হবে।
– আপনার কি ধারণা?
– অভিজ্ঞতায় বলছে, উনি অ্যালজইমার্স-এ ভুগছেন। স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে। মেডিসিনে বিশেষ সুবিধা হবে না। সাপোর্টিভ চিকিৎসাই প্রধান।
– ওনার পারিবারিক সাপোর্ট তো নেই।
– সেটাই তো সমস্যা। এতো স্কলার একজন মানুষ অথচ একদিন দুই প্লাস দুই যোগ করতে ভুলে যাবেন। নিজের নাম বলতে থতমত খাবেন। এটা ভাবা যায়?
-এবার তাহলে উপায়?
– আমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে যে এই ধরনের সমস্যার কাউন্সেলিং করে। আপনারা তার সাথে কথা বলবেন।
– ওনার ছেলেকে কি বলবো?
– কথা বলে মনে হলো ওনার ছেলে আমার বয়সি হবে। আমার কার্ডটায় একটা ফোন নম্বর আছে রাতের দিকে ফোন করতে বলবেন। আমি সবিস্তারে বলে দেবো।
– সে কানাডায় থাকে।
– উনি বলেছেন। তবে অ্যামেরিকা ও কানাডা ওনার গুলিয়ে যাচ্ছে।
– ঠিক আছে ডাক্তারবাবু।
– দু সপ্তাহ বাদে আবার দেখবো। রিপোর্ট সমেত।
বাইরে বেরিয়ে ভবতারণ বাবু বেশ উৎসুক মনে এপাশ ওপাশ করলেন এবং প্রবীর ও কৃষ্ণকান্ত চেম্বার থেকে এক পা ফেললেই ধরলেন।
– ডাক্তার বাবুর কি মনে হচ্ছে আমি পাগল? তোমরা নিশ্চয় সেটাই তাকে বুঝিয়ে এলে?
– না, তা উনি বলেন নি আমরাও তা ওনাকে বোঝাই নি। উনি ছাত্রাবস্থায় আপনার বই পড়েছেন। সেটার প্রশংসা করলেন। উনি কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে দু সপ্তাহ পরে আবার আসতে বললেন।
– এমনি বোঝা গেল না? আবার পয়সা খরচ।
প্রবীর একটু উষ্মা প্রকাশ করে বলল,- সেটা আমরা বুঝব ।
পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে রিপোর্ট চলে এসেছে। এর পর একরাতে কৃষ্ণকান্তকে ফোন করলো সুমন কানাডার ওটাওয়ে শহর থেকে।
– কাকা, আমার খুব খারাপ লাগছে। এই সময়ে আমি কিছুই করতে পারছি না।
– এই যে তুমি জানতে চাইছো, পরামর্শ দিচ্ছো। সেটাই বা কম কি?
– বাবা এর মাঝে আর বাইরে যান নি তো?
– না, আমি কয়েকটি চায়ের দোকানে বলে এসেছি। তারা যেন নজর রাখে ওনার যাতায়াতের ওপরে।
– নতুন কোন উপসর্গ?
-সন্দেহ বাতিক এবং কৃপণতা।
– এমন তো বাবার কখনও ছিলো না।
– হয়তো এই রোগের এগুলো লক্ষণ।
– আমিও বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম, অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে।
রিপোর্ট পত্র খুঁটিয়ে দেখার পর ডাক্তারবাবু তাঁর প্রেসকৃপশান প্যাডে ডায়াগনসিস লিখলেন ‘এ ডি’।
বললেন কোন কারণে ব্রেনের নার্ভ টিসুতে জমতে থাকে এক ধরনের জিলেটিনের মতো পদার্থ যার নাম অ্যামাইলয়েড, আস্তে আস্তে সব নার্ভের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। সেভাবে মেডিসিন বিশেষ কিছু নেই। মানে এখনও ব্যবহার করার মতো বাজারে আসেনি। বিদেশে পরীক্ষামূলক ভাবে এ সব কেসে দেয়া হচ্ছে।
– এই ভাবে কতদিন চলবে?
– কতদিন যাবে, সেটা বড় কথা নয়। কতটা সহনযোগ্য ভাবে যাবে? রুগীর পক্ষে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের পক্ষে। ধরে নিচ্ছি আপনারাই তাঁর পরিবার এবং কাছের লোক। আজ রাতে দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ ওনার ছেলেকে বলবেন একবার যোগাযোগ করে নিতে।
এখন আপনারা একটু কাউন্সিলারের সাথে কথা বলুন। সে খানিকটা দিশা দেখাতে পারবে।
রুগীকে নিয়ে চারজন। যিনি কাউন্সেলিং করবেন তিনি, প্রবীর এবং কৃষ্ণকান্ত।
এই পর্বের শুরুতে রুগীর সাথে কথা হলো। তাঁর স্মৃতিহ্রাসের পরিমাপ করা হলো এবং তাঁর কি পছন্দ সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো।
– আপনি কি ভালোবাসেন?
– পড়তে ও পড়াতে।
– আপনি শেষ কি পড়েছেন বা পড়িয়েছেন?
– এখন তো খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কিছু পড়া হয় না। আর শেষ কবে পড়িয়েছি মনে নেই।
আরো কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন। তিনি কি মনে করেন তাঁর বিরুদ্ধে কিছু চক্রান্ত হচ্ছে কি না। কিম্বা কে সেই চক্রান্তকারী?
রুগী বাইরে গেলে তিনজন বসলেন।
– এই সব রুগীর ক্ষেত্রে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু দরকার সেইটুকুই শুধু করতে হবে। আপনারা দুজনার কেউ ফার্স্ট ডিগ্রী ব্লাড রিলেটিভ নন। তবুও শেষ অবধি আশা করি আপনারা সঙ্গে থাকবেন।
– আমরা তো চেষ্টা করবো।
– উনি সন্দেহপ্রবণ হবেন, হয়তো কেউ ওনার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে এই চিন্তা নিজে করবেন এবং অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। এগুলো অসুখের উপসর্গ। এগুলো পাত্তা দেবেন না। অনর্থক ওনার সাথে তর্কে যাবেন না। কথাবার্তার মধ্যে নারী প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে। সেটাও একটা অসুখের লক্ষ্মণ। এড়িয়ে চলবেন। সেটা নিয়ে অনর্থক ওনাকে অন্যরকম ভাববেন না।
– তেমন তো হচ্ছে আজকাল।
– একজন ডেডিকেটেড চব্বিশ ঘন্টার লোক চাই। যে একটু সহানুভূতিশীল হবে। একজন না পারলে দুটো শিফ্টে করবে দুজন। তেমন লোক যতক্ষণ না পাওয়া যায় আমাদের একটা হেল্পার গ্রুপ আছে। যারা আপাততঃ দেখে দেবে এবং একজনকে ট্রেনিং দেবে। ওনার নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতা থাকবে। সামলাতে হবে।
এবার আর একটি কথা বলি ওনাকে সামান্য হলেও কাজে এনগেজড করতে হবে। কি ধরনের কাজ সেটা পরে বলছি।
-উনি তো বাজার করা এবং ব্যাঙ্ক পোষ্ট অফিস ছাড়া বিশেষ কিছু কাজ করেন নি অনেকদিন ।
– একটা কাজে উনি এক সময়ে দক্ষ ছিলেন। সেটা ওনার পছন্দের জিনিস অবশ্যই। সেটাকে উজ্জীবিত করতে হবে।
– পড়ানো, উনি কি পারবেন?
– পারবেন না অবশ্যই, কিন্তু পারার চেষ্টা করতে হবে।
– পদার্থবিদ্যার মতো বিষয়?
– সেটা অবশ্যই সম্ভব নয়। অন্ততঃ এই মুহুর্তে।
– ওনার নিজস্ব বাড়ি আছে এবং যা শুনলাম কেউ সেখানে থাকে না।
– সেটা বলতে গেলে ফাঁকাই পড়ে থাকে।
– একটা ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকা বা অ আ ক খ শেখানোর স্কুল চালু করুন। যারা প্রিভিলেজড নয় এমন পরিবারের বাচ্চাদের জোগাড় করার চেষ্টা করুন। এটা ওনাকে খানিকটা সেল্ফ অর্গানাইজড্ করার সুযোগ দেবে। নিজেদের কথা বলে ঠিক করুন।
মাঠের প্রান্তে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বয়স্ক মানুষদের আসরে আজ সবাই একটু উত্তেজিত। কৃষ্ণকান্তবাবু সবাইকে চা বিস্কুট টিফিন খাওয়ালেন। বাড়ি থেকে এনেই খাওয়ালেন। কারণ গতকাল তাঁর এক নাতনির জন্মদিন ছিল। ভবতারণবাবুকেও বেশ প্রসন্ন মনে হলো। এই বৃদ্ধ সংঘের এক সদস্য যিনি এক ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তিনিও আজ কোন কারণে হাজির। সে সময়েই কৃষ্ণকান্তবাবু প্রস্তাবটা রাখলেন।
– কাউন্সিলর সাহেব আমাদের একটা প্রস্তাব যদি আপনি বিবেচনা করেন।
– বলুন কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?
– ভবতারণবাবু চান তাঁর বাড়িতে একটা ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকা ও অ আ ক খ শেখানোর স্কুল খোলা হোক। ওনার দুটো তিনটি ঘর তো তালা বন্ধ হয়েই থাকে। ঘরগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে।
– এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। ভবতারণবাবু কি বলেন?
ভবতারণ বাবু শুনছিলেন। বললেন,- কাল রাতে খোকা যখন ফোন করছিলো, তখন সেও একথা বলছিলো। আমি বললাম সেটা তো খুব ভালো কথা। বাচ্চারা আসবে হৈ চৈ করবে।
– আমি একটা পারমিশন করিয়ে নেবো চেয়ারম্যানকে দিয়ে। লিগ্যাল ব্যাপার তো থাকে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী কোথায় পাবেন? মানে ঠিক কি ভাবে জোগাড় হবে?
– এটা অবৈতনিক হবে এবং গরীব মানুষের বাচ্চারাই আসুক। খোকা বলেছে টিচার যারা থাকবে তাদের মাইনে সে দেবে। ভবতারণ বাবু বললেন।
– এও তো অতি উত্তম প্রস্তাব। আমার কাছে বি পি এল কার্ড হোল্ড করে এমন যারা আছে তাদেরকে বলবো এখানে যোগাযোগ করতে।
কথাবার্তা আলোচনা এবং কথা কাটাকাটি, সব কিছু হয়ে কাজ কিছুটা এগোল এবং একদিন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে দিয়ে উদবোধন করা হলো বাচ্চাদের খেলাঘর। শিশুরা আসবে এখানে খেলবে পড়বে আবার অল্প কিছু খাওয়া দাওয়া করবে।
সুমন সব শুনে ভীষণই আনন্দিত। তার কাছে এই সামান্য টাকা বাচ্চাদের কল্যাণে খরচ করা নিতান্ত মামুলি ব্যাপার।
কমলার একটা নতুন কাজ সংযোজিত হলো। সে বাচ্চাগুলোকে দেখাশুনো করে। বলতে গেলে সবাই গরীব ঘরের ছেলে মেয়ে। সাকুল্যে দশ জনকে জোগাড় করা গেলো। তারা সকালে আসে দুপুরে খেয়ে বাড়ি ফেরে। একজন শিক্ষিত তরুণকে মাষ্টার হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সে একা পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। আর একটি অল্প বয়স্ক মেয়ে আছে যে ছবি আঁকা শেখায়। কমলা তাদের দুবেলা খাবার বানিয়ে দেয়। তার বাচ্চা দুটোকেও সকালে এখানে নিয়ে আসে। তারা ছবি আঁকে অক্ষর জ্ঞানলাভ করে।
একটু হলেও ভবতারণবাবু কাজ পেয়েছেন। সকালে উঠে বাজারে যান। চেনা দোকানে ফর্দ নিয়ে মালপত্র কেনেন। কখনও মাছের দোকানে মাছ কেনেন। কয়েকদিন পর পর খাতা পেনসিল নিয়ে বসেন এবং হিসাব করেন। কটা বাচ্চা এলো? কটা এলো না? মাসের শেষে তার একটা হিসাব চাই। এখন তিনি আর বড় কিছু ভুল করেন না। অল্প ভুল যে হয় না তা নয়। দশটা বাচ্চার মধ্যে আটজন এলে, বাকি দুজন যে আসেনি সেটা চটপট হিসাব করে ফেলেন।
তাদের জন্য যতটুকু রান্না করতে হবে সেটা কমলাই ঠিক করে। তবে সেই খাবারের হিসাবটাও আস্তে আস্তে ভবতারণবাবু করছেন। রাতের বেলা সুমন নিয়মিত ফোন করে এবং সব ব্যাপার নিয়ে তার সাথে কথা হয়।
সুমনের মনে হয়েছে বাবা এখন আর বাইরে অপ্রয়োজনে বেরোতে চায় না। হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমেছে। এটা তার কাছে একটা বিরাট স্বস্তি।
ছবি আঁকা শেখায় যে মেয়েটা সে ভবতারণবাবুকে দাদু বলে ডাকে। তাই বাচ্চারাও তাঁকে সেভাবে ডাকে।
‘এ ডি (অ্যালজাইমার্স ডিজিস) হেল্পার গ্রুপ’ থেকে যে কাউন্সিলর দায়িত্ব নিয়েছেন ভবতারণবাবুর কাউন্সেলিং করতে, তিনি বলেছেন ভবতারণবাবু যেন সব বাচ্চার নাম মনে রাখেন।
সবাইকে নাম ধরে ডাকলে বাচ্চারাও খুশি হয়।
রোজ অ্যাটেনডেন্সে একটা কাউন্টার সিগনেচার করতে হয়। দুই শিক্ষকের সইয়ের নীচে।
– সেগুলোতে করবেন আর বাচ্চাদের কপিগুলোতেও আপনি করবেন এবং সেটা ব্যাঙ্কের স্পেসিমেন সিগনেচারটাই করবেন। কারণ ওটা নিয়মিত করতে থাকলে আপনার সই নিয়ে কোন প্রশ্ন করতে পারবে না কেউ।
ভবতারণবাবু জানেন তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলোতে এখন কেবলমাত্র তাঁর নাম আছে। এটুকু তিনি মনে করতে পারেন, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বলেছিলো ছেলে কিম্বা বৌমার সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করতে। ছেলে সঙ্গত কারণে রাজি হয়নি, কারণ প্রয়োজনের সময় তাদেরকে পাওয়া যাবে না।
ইদানিং তাঁর এই ভুলটা হচ্ছিল। সইয়ের শুরুটা মনে করতে পারছিলেন কিন্তু শেষ অংশটা ভুলে যাচ্ছেন। কাগজে একটা স্পেসিমেন সিগনেচার করে তিনি সঙ্গে রাখছিলেন বুক পকেটে।
বাচ্চাদের কপি চেক করা এবং অন্য খাতাপত্র ও বিলগুলোতে সই করতে করতে তিনি একটু সড়োগড়ো হয়েছেন। ভুল কম হচ্ছে। পারছেন এখন, না দেখেই নির্ভূলভাবে সই করতে। প্রথম প্রথম বাজারের ফর্দ লিখতে তাঁকে পুরোনো নমুনার সাহায্য নিতে হতো। এখন মনে মনে তিনি সেটা বানাতে পারেন ও ঠিক ভাবে লিখতে পারেন।
তিনের নামতা পড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন প্রথম দিন। শখ করে বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে বিপত্তি। সংখ্যাগুলো মনে আসছে অথচ ধরতে পারছেন না। মুখে আসছে না অথচ পেটে ঘুরপাক খাচ্ছে। হতবাক হয়ে গেছিলেন।
– কথাটা তার এ ডি কাউন্সিলর মানে যিনি তাঁর সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করেন তাঁকে ভবতারণবাবু বললেন।
– আপনি হতাশ হবেন না। এটাই স্বাভাবিক। আপনার ব্রেনের নার্ভগুলো আর একশো শতাংশ কাজ করছে না। যদি আপনি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেন যে আমাকে অন্ততঃ পঞ্চাশ শতাংশ নার্ভের কাজ পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে সেটা কেবল আপনি নিজের অধ্যাবসায়েই পারবেন।
বৃদ্ধ মানুষ ভবতারণবাবু। জন্মাবধি ইগো সমস্যা কোন দিন তাঁর ছিলো না। বরং নিজেকে লো প্রোফাইল মানে একটু লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই তিনি পছন্দ করেছেন। যেখানে আর পাঁচজন মানুষ নিজেকে জাহির করতে চায়। সেখানে তিনি জাহির তো দূরের কথা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করেন।
আজ প্রথম তিনি আহত হলেন কাউন্সিলরের কথায়। তাঁর আত্মসম্মানবোধে লাগলো।
অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেলো তাঁর। গ্রামের স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন। এক বছর বাদে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষায় হতাশজনক ফল হলো তাঁর। হেডমাস্টার মশাই নিজের ঘরে ডেকে বললেন- ভাবতাম তুমি ভালো ছেলে। কিন্তু তোমার রেজাল্ট দেখে মনে হচ্ছে আমাদের আশা করা বৃথা। জমিজমাও তো বিশেষ কিছু নেই যে চাষ বাস করবে। তোমার বাবা আমার বন্ধু। না হলে কথাগুলো বলতাম না। নিজে ভাবো কি করবে?
সবাই এবং হেড মাষ্টার মশাই নিশ্চয় আশা করেছিলেন যে তাঁর পরীক্ষার ফল ভালো হবে। কোন রকমে পঞ্চাশ শতাংশের গন্ডি পেরিয়েছিলেন বটে। তবে সেটা অবশ্যই আশানুরূপ নয়।
অপমানজনক এইসব কথাবার্তা, সঙ্গে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা ভবতারণ মুখার্জিকে কোণঠাসা করে দেয়। বাড়িতে এসে তিনি কিছু বললেন না। বাবা হয়তো বন্ধু মারফত দুঃসংবাদটা আগে পেয়েছেন তাই খানিকটা বাস্তব জগৎ থেকে নিজেকে ছিন্ন করে নিজের কাজের মধ্যে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করলেন।
মা শুধু ফলাফল শুনে বললেন,- বাবা, এখনও তিনশো পঁয়ষট্টিটি দিন বাকি। তুমি কেন এতো ভেঙে পড়ছো?
নিম্নবিত্তের সংসারে তাঁর নিজস্ব কোন ঘর ছিলো না। একটা বারান্দার কোণে তার পড়ার ব্যবস্থা ছিলো। একটা ঘেরা জায়গা। পুরোনো চটের বস্তা জুড়ে পর্দা বানিয়ে ঘেরা ছিলো সে জায়গাটুকু।
ভবতারণবাবু নিজেকে একটু গুটিয়ে নেন। তখনও গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসেন। জেদ তাঁর কোন কালেই ছিলো না। অথচ হেডমাষ্টার থেকে শুরু করে সবাই যে তাকে বিদ্রূপ করেছেন সেটা ভবতারণবাবুর হজম করতে সমস্যা হলো।
মাকে গিয়ে বললেন,- মা, এক বছরে হবে ?
মা বললেন,- ছয় ঋতু এবং বারো মাস। তোমার কাজ স্কুল, খাওয়া এবং পড়া। তোমার বাবা ও আমি একটা বছর বাকি সব সামলে নেবো। দেখো ঠিক হবে।
মার কথায় নিজেকে একটু উদ্দীপিত মনে হয়েছিলো। দিন রাত এক করে উচ্চমাধ্যমিকের পড়া করতে লাগলেন। পড়া এবং লেখার চর্চা। আপাততঃ বাইরে অন্য কারণে বেরোন বন্ধ। পুজো পার্বণ বন্ধ।
মনঃসংযোগের সব ব্যবস্থা করা হলো। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফল পেলেন। তবে চমক দেওয়ার মতো ফল হলো কাউন্সিলের পরীক্ষায়। সবার মুখ বন্ধ করে দিলেন। হেড মাষ্টার মশাই যেদিন ফল বেরলো সেদিন এক হাঁড়ি মিষ্টি এনে এসে হাজির। ভবতারণবাবু জেলার ভিতরে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন।
তিনি এখন অনেক কিছু মনে করতে পারেন না। তা বলে সব কয়টি ছাত্র ছাত্রীর নাম মনে রাখতে পারবেন না? তা কি করে সম্ভব হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। খাতায় টুকে, অবসর সময়ে নামগুলো আউড়ে তিনি মনে রাখতে চাইলেন।
একদিন আগে ভাগে কৃষ্ণচূড়ার তলে আড্ডাস্থলে এসে রেজিস্টার বুকটা খুলে কৃষ্ণকান্তকে বললেন,- দেখতো সবার নাম মনে রাখতে পারছি কি না? তারপর একটু আধটু হোঁচট খেলেও সবকটা বাচ্চার নাম মনে করতে পারলেন।
কৃষ্ণকান্ত অবাক হয়ে বললো,- করেছেন কি দাদা, সব মুখস্থ।
– কাল রাতে সুমনকে বলেছি, ও যে ওটাওয়াতে থাকে সেটা আমি জানি এবং সেই শহরটা কানাডাতে এবং কানাডা যে আমেরিকার প্রতিবেশী রাষ্ট্র সেটাও বলেছি।
– ভবোদা কোনদিন না আপনি আবার ফিজিক্স পড়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
ভবতারণবাবু হাসলেন এবং বললেন,- কৃষ্ণকান্ত তোমার মনে আছে ডঃ মৈত্র যখন প্রিন্সিপাল হয়ে এলেন তখন কলেজে আমরা একটা বিজ্ঞান প্রদর্শনী করেছিলাম। সে বছর যে ছেলেগুলো প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলো তাদের নাম শুনতে চাও?
– না, ভবোদা। আমি নিজে বিশেষ মনে রাতে পারিনা। গুটি কতক ফোন নম্বর তাও খাতা দেখতে হয়।
ভবতারণবাবু নামগুলো মনে রাখতে পারছেন সেটা যতটা না খুশির খবর কৃষ্ণকান্তের কাছে। তার থেকে অনেক বেশি খুশির খবর যে তিনি অনেকটা চাঙ্গা হয়েছেন মনেপ্রাণে। খুব মনমরা হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে থাকেন না। কিছু একটা করছেন এবং করবেন এই চিন্তাতেই সর্বক্ষণ মগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর আশে পাশের লোকজনও এখন খানিকটা নিশ্চিন্ত যে ভবতারণবাবু আবার জীবনের প্রতি উৎসাহ পাচ্ছেন। সকালে বাচ্চাগুলো আসবে তারা কিছুক্ষণ এখানে থাকবে, খেলবে,পড়বে, আঁকবে। তাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। কি বাজার করবে? কি কিনতে হবে? তার হিসেব মেলানো। সবগুলো তিনি নিজে রাখারও করার চেষ্টা করেন।
ওনার যিনি ক্লিনিক্যাল কাউন্সিলর তিনি বলেছেন- ধরে নিন, এটা আপনার স্কুল। আপনি তার প্রিন্সিপাল বা হেড মাষ্টার। সবাই হয়তো করছে কিন্ত আপনি তার প্রধান।
কথাটা তাঁর ভালো লেগেছে। আগে রাতে সুমন কথা বললে তিনি কথা খুঁজে পেতেন না।
ওটাওয়াতে এবার বসন্ত একটু আগাম চলে এলো। পাতাঝরা গাছে কিশলয় আর ফুলকুঁড়িতে ডাল ভরে গেল। সুমনের স্ত্রী নন্দিনী গুজরাটের মেয়ে। সে বায়না ধরল এক পারিবারিক উৎসবে দেশে গিয়ে যোগাদান করবে। সে একটা স্কুলে পড়ায় সেখানে পনেরো দিনের ছুটি পেয়েছে। ছেলে জুনিয়র স্কুলে পড়ে। তাই খুব চাপ নেই। সুমনের ছুটি নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল, কিন্তু সেই বাধা থেকে সে কোন রকমে উৎরে গেল এবং পনের দিনের একটা ট্যুর প্রোগ্রাম বানিয়ে টিকিট কেটে ফেলল। বাবার সাথে এ ব্যাপারে সে কিছু আলোচনা করেনি। হয়তো বাবাকে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে একটু অবাক করে দিতে চাইছিল। একটু বেশিই দাম মেটাতে হলো আপ ডাউন টিকিটের। এত অল্প সময়ের মধ্যে কাটার জন্য খেসারত দিতে হলো। সেটা গায়ে মাখল না সুমন। তারা একটু কম যাতায়াত করে দেশে।
নন্দিনী দিল্লি থেকে ছেলেকে নিয়ে গুজরাটে চলে যাবে। আর সুমন দমদমে নামবে। অনুষ্ঠান শেষে মা ও ছেলে কলকাতা হয়ে আবার তিনজনে কানাডায় ফিরবে।
সরকারের শিশু কল্যাণ দফতরের একটা চিঠি এসেছে ভবতারণবাবুর নামে। ভবতারণবাবুরা এই স্কুলের পঠনপাঠন এবং স্যাংশানের ব্যাপার নিয়ে সরকারের কাছে পৌরসভার অ্যাপ্রুভাল নিয়েই একটা আবেদন করেছিল। আজ চিঠি এসেছে। তবে এখনও চিঠি খোলা হয়নি।
কোনদিন যা হয়নি আজ ভবতারণ বাবুর একটু টেনশন হচ্ছে। তারা কি নাকচ করে দেবে। কিম্বা তারা পারমিশন দিল এটাকে? ভালো প্রকল্প, তোমরা এগিয়ে চল। যাই হোক চিঠি খোলা এবং ফয়সালা হবে বিকেলের আসরে।
একটু আগে আগেই তিনি গাছতলায় আজ পোঁছে গেলেন। তর সইছিল না। কৃষ্ণকান্ত এসেই বললে,- কি দাদা, আজ তো আপনি ফার্স্ট?
– একটা খবর আছে?
– কি?
– একটা চিঠি, ভালোমন্দ জানি না। সরকারি চিঠি। আমরা যে দপ্তরে আবেদন করেছিলাম। সেখান থেকে এসেছে।
– বাঃ, সে তো সুখবরই হবে।
– আমার ভয় লাগছে।
– আপনিও ভয় পাচ্ছেন? হলে হবে, না হলে না হবে।
– তুমিই খোল চিঠিটা।
– তবে এক কাজ করা যাক। সবাই আসুক। আমি একটু বাড়িতে বলে আসি আর কাউন্সিলর সাহেবকেও একটা ফোন লাগাই। যদি ফ্রি থাকেন চলে আসবেন।
– তাহলে চায়ের সাথে অন্য কিছুর একটা ব্যবস্থা ক’রো।
– ঠিক আছে।
দেখতে দেখতে অনেকে হাজির হলো। অন্য দিনের তুলনায় বেশিই হলো। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছিল। তারাও উঁকি মেরে যাচ্ছে। কি ব্যাপার ‘কাকু’রা আজ সংখ্যায় এত বেশি কেন? শেষ অবধি চিঠির মুখ খুললেন কাউন্সিলর সাহেব। পড়লেন তিনি এবং পড়ার শেষে সবাই হৈ হৈ করে উঠল আনন্দে। সবাই মনে মনে যা চাইছিল তাই হল। সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে এই স্কুলের এবং তার পাশাপাশি দুটো শিক্ষকের পোষ্ট তৈরি করা হয়েছে। এদের হুল্লোড় শুনে বাকি ফুটবল প্লেয়াররাও দল বেঁধে হাজির।
– কাকু, সত্যি হয়েছে? আপনারা যা খেটে করেছেন। আমাদেরও খুব ভালো লাগছে। একটা বড় করে অনুষ্ঠান করুন না!
বড়রা খুব মজা পেল ওদের কথায়। এরা সবাই পরের প্রজন্ম। সবার মুখ চেনা সম্ভব না। তবে অনেকেরই মুখ দেখে দেখে ভবতারণ বাবু অভ্যস্থ।
– তুই টুলুর ছেলে না? তোর মাকে আমি পড়িয়েছি।
– হ্যাঁ, মা আপনার কথা বলে।
– তবে তো তোরাই অনুষ্ঠান করতে পারবি। আমরা পিছনে থাকব। আর খরচা পাতি যা হয় আমরা দেব।
ছেলেরা সবাই রাজি। তবে এখনই তারা কিছু মিষ্টিমুখ না করে যাচ্ছে না। মানে আজকেই আনন্দের কিছু ভাগ চাই তাদের।
– বেশ বেশ। দু’জন চলে যা। এই নে টাকা। সবার জন্য নিয়ে আয়।
ভবতারণবাবু পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করলেন। আর তিনি একটা খসড়া হিসেব করে দিলেন ঝটপট । কুড়ি বাইশ জনের জন্য চা- জলখাবারের। এই হিসাবেও তিনি এখন কিছুটা সাবলীল, সেটা তার হিসেবে বোঝা গেল।
ওরা চলে গেল। তখন সবাই সবার কাউন্সিলরকে ধরলেন- সাহেব, আপনিই বলুন আমরা কি করব?
– দেখুন, এটা খুব সামান্য ব্যাপার নয়। এমন নয় যে এই ধরনের ঘটনা খুব ঘন ঘন ঘটে। ভবতারণবাবুর সদিচ্ছা এখানে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। তাই হয়তো এই পারমিশনটা এত সহজে হয়ে গেল। আমরা উদযাপন তো করবই। কি ভাবে করব, সেটা সবাই মিলে ঠিক করতে হবে। সবার মতামতের দরকার আছে।
অনুষ্ঠানের খুব বেশি দিন আর দেরি নেই। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। সেটা বয়স্কদের প্রাত্যহিক আড্ডা দেওয়ার জায়গার কাছাকাছি।
ভবতারণবাবু মনে এখন বেশ স্ফূর্তি অনুভব করেন। ব্যাঙ্কের কাজে আর তাঁর কোন অসুবিধা হয় না। সই বাঁকাচোরা হলেও মিলে যায় স্পেসিমেন সিগনেচারের সাথে। সপ্তাহের বার গুলিয়ে যায় না। কারণ তিনি জানেন যেদিন স্কুলের ছুটি সেদিন রবিবার। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ দিনে খাতার হিসাব দেখেন। একদিন ব্যাঙ্কের কাগজপত্র নিয়ে বসে তিনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। সব মিলিয়ে অনেকটা টাকা তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে জমে আছে। সে ভাবে খরচা করা তো হয় না । আগামী অনুষ্ঠানের জন্য কিছু টাকা তুললেন। সবাই মিলে চাঁদা দিয়েই এই অনুষ্ঠান হচ্ছে কিন্তু তাঁকেই তো সবাই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। খোকাকে বলতে হবে। নিজের জমে থাকা টাকার ব্যাপারটা। সে শুনলেই তো বলবে- বাবা ওটা তোমার টাকা। তুমি যেমন খুশি খরচা করো। ছেলেটার টাকা পয়সার বোধটা আর কবে হবে কে জানে?
ঠিক তাই হল রাতে সে যখন শুনল টাকার কথা। সে নির্লিপ্ত ভাবে বলল,- বাবা,ঐ পরিমাণটা ডলারে কনভার্ট করলে এমন কিছু বেশি হয় না। এদেশে ওর মূল্য তেমন বেশি কিছু হবে। ওটা তুমিই খরচা কর।
মনে মনে আক্ষেপ করলেন ভবতারণবাবু। সন্তানের বিষয় বুদ্ধি না থাকার আক্ষেপ।
আসর আলো করে বসে আছেন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। এখন এখানে ওখানে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হচ্ছে। তার মধ্যে এই অনুষ্ঠান একটু অন্যরকম হলেও মাঠের প্রান্তে লোকজন জমেছে মন্দ নয়। কচি কাঁচারা এসেছে, তাদের মা বাবা দিদি দাদারা এসেছে। ভবতারণ মুখুজ্যে আজ আলমারি ঘেঁটে বিয়ের পাঞ্জাবি খানা বার করে পরে নিয়ে সেজেগুজে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছেন। কম বেশি অনেকে বক্তব্য রেখেছেন। একটু গান আবৃত্তিও হল।
অবশেষে তাঁর হাতে ফুলমালা তুলে দিয়ে কৃষ্ণকান্ত বলল- দাদা, আজ আপনার জন্য আমরা গর্বিত। এই গরীব বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ আপনার হাতে। আপনি কিছু বলুন।
আজ একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে। তখন বিকেল, কৃষ্ণকান্ত অনুষ্ঠানের জন্য বেরতে যাচ্ছেন এমন সময় দরজায় ঘন্টি বেজে উঠল। বিরক্ত হলেন কৃষ্ণকান্ত। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে তার চক্ষু চড়ক গাছ। একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে আর দরজায় দাঁড়িয়ে সুমন। ওটাওয়া থেকে সুমন।
– তুমি? এ সময়ে?
সুমন সব কিছু খুলে বলে বোঝালো এবং নিজের বাড়িতে বাবাকে না দেখতে পেয়ে সে এখানে চলে এসেছে।
– ঠিক আছে তুমি চাবি নাও। ফ্রেশ হয়ে মাঠে চলে এস। এসে দেখে যাও তোমার বাবার কীর্তি।
ছাত্রদের পড়াতে বরাবরই ভালোবাসতেন ভবতারণবাবু। তাই গুছিয়ে কথা বলতে তিনি পারদর্শী। তবে স্মৃতিভ্রংশ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি সব গুটিয়ে ফেলেছিলেন।
আজকের এই অনুষ্ঠান তাকে এতটাই উত্তেজিত করেছে যে তিনি মনে মনে তাঁর বক্তব্যের মুসাবিদা করে নিয়েছেন।
কৃষ্ণকান্ত সচরাচর মঞ্চে বা জনসমক্ষে বিশেষ ওঠেন না আসেন না। আজ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে বলতে অনেকটা বলে ফেললেন,- ভবদা আপনি শুরু করুন।
ভবতারণবাবু যেন ফিরে পেলেন তাঁর কর্মজীবনের সময়। কলেজ ইউনিভার্সিটি নিয়ে বললেন অনেক কথা। খুব বেশি ছন্দপতন হল না। সময় সারণিতে ঘটনার আগু পিছু হয়তো হয়েছে কিন্তু অন্যে অতটা বুঝতে পারেনি।
সুমন পিছনের সারিতে বসে এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল তার বাবার বক্তব্য। সে নিজের অবর্তমানে বাবার স্মৃতিভ্রংশের পূর্বাপর সব খবর জানে। মনে তার প্রবল অপরাধ বোধ আছে। হয়তো তারা কাছে থাকলে বাবার এই পরিস্থিতি হত না। কিন্তু আজকের এই অনুষ্ঠানে বাবাকে দেখে এবং বাবার কথা শুনে সে নিজেকে কিছুটা আশ্বস্ত করল।
ভবতারণ বাবুর কথা শেষ হলে কৃষ্ণকান্ত বললেন,- আমাদের মধ্যে একজন বিশেষ অতিথি এসে হাজির হয়েছেন। আমি তাঁকে মঞ্চে উঠে আসতে অনুরোধ করছি।
আবার কে এল? ভবতারণবাবু একবার কৃষ্ণকান্ত আর একবার সামনে বসে থাকা মানুষের দিকে তাকাচ্ছেন।
কখন সুমন বাঁদিকের সিঁড়ি দিয়ে বাবার একদম কাছে চলে এসেছে তা ভবতারণবাবু বুঝতে পারেন নি।
দীর্ঘাঙ্গ সুমন ঢিপ করে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিলেন না। সুমন বাবাকে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মাইকের সামনে চলে এল।
বাবার মত সুমনও সংযত বাক। অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না। ভালো ছেলে বলে তাকে সবাই জানে এবং সে মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলত বলে মোটামুটি সবাই তাকে চেনে। অনেকদিন তাকে সবাই দেখেনি সেটাও ঠিক।
সুমন মাইকের সামনে দাঁড়াল এবং একটা অতি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করল।
বক্তৃতার সারমর্ম শুনে ভবতারণ মুখার্জির এই ধারণা একেবারে বদ্ধপরিকর হল যে ছেলেটার বিষয় বুদ্ধি নিতান্তই শিশুসুলভ। তবে তিনি খুশি হলেন এবং ভীষণই খুশি হলেন।
সুমন সম্প্রতি একটা প্রোজেক্ট পেয়েছে তার নিয়মিত কাজের বাইরে। এই প্রজেক্টে পরিচালক হিসাবে প্রাপ্য আর্থিক সাম্মানিক সে পাবে আর্থিক মূল্য তার যথেষ্ট বেশি। এর একটা অংশ সে বাবার স্কুলের উন্নতির জন্য খরচ করতে চায়।
আজ ভবতারণ মুখার্জি অনেকদিন বাদে ছেলের সাথে মন খুলে কথা বললেন। রাতে শুতে যাওয়ার আগে সুভদ্রা দেবীর বাঁধান ছবির ওপরে হালকা ধূলোর আস্তরণ মুছতে মুছতে মৃতা সঙ্গিনীর সাথে কথা বলছেন,- তুমি রাগ করো না। ওদের ইচ্ছে থাকলেও কি সব সময় ওরা আসতে পারে? এই তো কত কথা হলো। আমরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছি ওরা এদেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে। এছাড়া আর কি পথ আছে?
(শেষ)