অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে একটা বড় লেখার ইচ্ছে ছিল। সেদিন সময় হয় নি, আজ লেখাটার শুরু করা যাক এই ভাবে।
এই শতাব্দীর সূচনালগ্নে, ইউনিসেফ ও ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক সম্মিলিতভাবে ওগিলভি বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে নির্বাচিত করে পোলিও টিকাদান কর্মসূচির জন্য বিজ্ঞাপন তৈরির কাজে । অমিতাভ বচ্চন, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন, ঘোষণা করলেন—তিনি এই বিজ্ঞাপনে অংশ নেবেন বিনা পারিশ্রমিকে।
এইবার এই বিজ্ঞাপনে এর দায়িত্বে থাকা সদ্য প্রয়াত বিজ্ঞাপন গুরু পীযূষ পান্ডের লেখায় দেখে নেওয়া যাক উনি কি লিখেছেন, “আমাদের হাতে ছিল এক অনন্য উদ্দেশ্য—দেশের প্রতিটি শিশুকে পোলিওমুক্ত ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া। সঙ্গে ছিল বচ্চন সাহেবের মতো এক বিশ্বাসযোগ্য মুখ। এখন কেবল প্রয়োজন ছিল এমন একটা আইডিয়া এর, যা মানুষের মন ছুঁয়ে যাবে; যা সরকারি প্রচারের যান্ত্রিক ঢংয়ে হবে না, বরং হবে হৃদয়ের গভীর থেকে আসা আহ্বানের মতো।”
“একদিন হঠাৎ মাথায় এলো এক চিন্তা। আমি ছুটে গেলাম মি. বচ্চনের কাছে। বললাম, “স্যার, সবাই আপনাকে আপনার পুরোনো চলচ্চিত্রগুলোর জন্য ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর প্রতীক হিসেবে চেনে। এই বিজ্ঞাপনে যদি আপনি হন ‘অ্যাংরি ওল্ড ম্যান’—যিনি রাগে নয়, মমতায় ভরা তিরস্কারে মানুষকে সচেতন করেন—কেমন হয়?” বচ্চন সাহেব হাসলেন, চোখে ঝলমল করে উঠল আগ্রহের আলো। “চমৎকার ভাবনা,” বললেন তিনি।
সুধী পাঠক এই ভাবনার প্রেক্ষিত বুঝতে গেলে ওই সময়টা আমাদের মনে রাখতে হবে। পোলিও খাওয়ানো নিয়ে অভিভাবকদের একটা বড় অংশের মধ্যে দোলাচল ছিল, সংশয় ছিল। অনেকেই বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পেরে অবহেলাও করতেন বুথে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে।
পীযূষ পান্ডে ও অজয় গহলৌত সেই ভাবনার উপর ভিত্তি করে স্ক্রিপ্ট লিখলেন। তারপর অমিতাভ নিজে প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি বিরতি, প্রতিটি সুর জারে নিখুঁত হয় সে নিয়ে পরামর্শ দিলেন এমন ভাবে যে তাঁর হাতে পরে প্রতিটি শব্দ যেন হৃদয়ের নির্দেশে জন্ম নেয়।
আবার পীযূষের জবানি তে শোনা যাক, “যখন আমরা স্ক্রিপ্টটি ক্লায়েন্টদের সামনে উপস্থাপন করলাম, ঘরে এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর বিস্ময়ের ঢেউ। বিশেষ করে আমলারা হতভম্ব, চেয়ার থেকে পড়ে যায় আরেকটু হলেই, “মি. বচ্চন লোকজনকে ধমক দেবেন রেগেমেগে?”—তাদের প্রশ্ন। আমি শান্তভাবে বললাম, “হ্যাঁ, দেবেন। কিন্তু সেটি স্রেফ রাগ নয়—সেটি হবে এক বাবার মমতাভরা বকুনি তার সন্তানের প্রতি। রাগের আড়ালে থাকবে ভালোবাসা, উদ্বেগ, আর দায়িত্ববোধ।”
“ইউনিসেফের এক তরুণ কর্মকর্তা তখনই ধারণাটির গভীরতা বুঝে ফেললেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “এই পথেই যেতে হবে।” এরপর আমরা আমাদের শেষ তাসটি খেললাম—বচ্চন সাহেবের নিজের বিশ্বাস যে, “আমাদের এই ধারণাটা কার্যকর হবে, । এটা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারবে”
আর সত্যিই, সেটিই ছিল সব সিদ্ধান্তের শেষ কথা।
একজন ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ সেদিন রূপ নিলেন এক ‘অ্যাংরি ওল্ড ম্যান’-এ—যাঁর রাগে ছিল ভালোবাসা, আর ভালোবাসায় ছিল দেশের প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎ।”
প্রথম পর্ব সমাপ্ত।
তথ্যসূত্র: পীযূষ পান্ডে, পান্ডেমোনিয়াম, প্রকাশিত ২০১৫











