সকালের দিকে মাথা ভালো কাজ করে না। সামান্য ঘটনাই হতভম্ব করে দেয়। তাই সাত সকালে বাইক বের করে যখন দেখলাম পেছনের চাকায় হাওয়া নেই, কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।
সারাদিন খুপরি থেকে খুপরিতে ঘুরে রোগী দেখার প্যাকড প্রোগ্রাম। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও যাবে না। গলার স্বরে যতটা পারা যায় মধু ঢেলে বললাম, ‘রূপালী গো…, আমার স্কুটারের চাকা লিক, তোমারটা নিয়ে যাব?‘
ফলাফল জানাই ছিল। কাল রাতেই রূপালীর সাথে আমার একটু সংঘাত হয়ে গেছে। রাতের খুপরী থেকে ফেরার সময়ে টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে আসতে বলেছিল। যথারীতি ভুলে গেছিলাম। তাতেও সমস্যা ছিল না। বাইক বাইরেই ছিল। ঝট করে কিনে আনলেই মিটে যেত। কিন্তু শীতের রাতে আর বেরোতে ইচ্ছে করছিল না।
রূপালী বলেছিল, তুমি বাড়ির একটা কাজও করোনা।
বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি তো সারাদিন হাওয়া খেয়ে বেড়াই। একদিন আমার জায়গায় থাকতে, বুঝতে। করো তো সরকারী চাকরী। বছরে অর্ধেক দিন ছুটি।
তারপর থেকে রূপালী কথা বন্ধ করে দিয়েছে। সানাই আর রানীকে রাত বারোটা অবধি অংক করিয়েছে। রাতে খিচুড়ির সাথে নিজের ডিম ভাজা আমাকে নিজেই ভাজতে হয়েছে।
রূপালী মৌনতা ভেঙে সকালের প্রথম কথা বলল, তোমার পক্ষে অত্যন্ত খারাপ খবর আজ আমার সরকারী চাকরিতে ছুটি নেই এবং আমি নিজের স্কুটারেই সময় মতোই ডিউটিতে যেতে ইচ্ছুক।
নিজের অদৃষ্টকে গালাগাল দিতে দিতে ব্যাগ পত্র নিয়ে হাঁটা লাগালাম। এতো সকালে লিক সারানোর দোকান খোলা পাব না। অটো পেতেই কতক্ষণ সময় লাগে কে জানে।
ভাগ্য ভালো প্রায় সাথে সাথেই একটা সোদপুরের অটো পেয়ে গেলাম। পেছনের সিটে উঠতেই মাঝের ভদ্রলোক বললেন, চেপে বসেন, সমস্যা নাই। শীতকালে চেপে বসলেই ভালো লাগবে।
অটো চালক বললেন, বাইশ টাকা ভাড়া দাদা। সবে বেরিয়েছি। দুটাকা খুচরো আছে তো?
এতো আরেক জ্বালা। মানিব্যাগ হাতড়ালাম। ভাগ্য ভালো, আছে।
আজ ১২ জানুয়ারি। আগে বিবেকানন্দর জন্মদিন তেমন পালন হতো না। কিন্তু আজকাল রাজনৈতিক দলগুলির সৌজন্যে বিবেকানন্দর জন্মদিনও বেশ মোচ্ছবে পরিণত হয়েছে। পার্টি অফিসের সামনে বিবেকানন্দের ছবিতে মালা ঝুলছে। এই সাতসকালে মাইকে তারস্বরে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে, ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো- তোমার মনের মন্দিরে।’ এই গানের সাথে বিবেকানন্দের কী সম্পর্ক সেটা আমার মতো নিম্ন মেধার লোকের পক্ষে বোঝা মুশকিল। তাই বোঝার চেষ্টা না করে গুনগুণ করছিলাম। পাশের ভদ্রলোক বললেন, ডিসগাস্টিং।
আমি থতমত খেয়ে চুপ করে গেলাম। আমার গানের গলা যে সুবিধার নয় সেটা আমি ভালোভাবেই জানি। তা বলে একটু গুনগুণ করার জন্য এমন অপমানিত হতে হবে ভাবিনি। কিন্তু চুপ করার পরও ভদ্রলোক আবার বললেন, ডিসগাস্টিং, যত আমরা বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছি, ততো ধর্ম ধর্ম করে আরো বেশি কুসংস্কারে ডুবে যাচ্ছি। আপনি ধর্ম মানেন?
থতমত খেয়ে বললাম, ইয়ে… আমি মানে তেমন করে ভেবে দেখিনি।
ভেবে দেখেন নি কেন? এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গেছেন কেন? আপনারা ভেবে দেখেন না বলেই তো ধর্মের আফিমে এখনও ক্ষমতাবানরা সাধারণ মানুষদের বুদ করে রাখেন। এদের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সবচেয়ে আগে নাস্তিকতার চর্চা করতে হবে। জানেন মার্ক টোয়েন কী বলেছেন?
আমি দ্বিগুণ থতমত খেয়ে বললাম, মার্ক টোয়েন মানে… ইয়ে সেই আমেরিকান লেখক যিনি টম সয়্যারের এডভেঞ্চার লিখেছিলেন?
ভদ্রলোক খুশি হলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, তিনি ধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন “ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল যখন প্রথম ঠকবাজ দেখা পেয়েছিল প্রথম নির্বোধের“। আপনি গ্রীক দার্শনিক এপিকুরোস সম্পর্কে জানেন?
কী কুক্ষণেই যে গুনগুণ করেছিলাম। ঘাড় নেড়ে বললাম, কিচ্ছু জানি না।
তিনি যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে গ্রীক দেশের এক বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন। ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “ঈশ্বর কি অশুভ শক্তি রোধ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু সক্ষম নন? সেক্ষেত্রে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
নাকি তিনি সক্ষম, কিন্তু ইচ্ছুক নন? সেক্ষেত্রে তিনি অমঙ্গল কামনাকারী।
নাকি তিনি সক্ষম এবং ইচ্ছুকও? তাহলে অশুভ শক্তির উৎপত্তি কোথা থেকে?
নাকি তিনি সক্ষমও নন, ইচ্ছুকও নন? তাহলে তাঁকে ঈশ্বর ডাকা কেন?”
আমি রীতিমতো অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি তো রীতিমতো কাল্টিভেট করার যোগ্য।
ভদ্রলোক একটা করুণার হাসি দিলেন। বললেন, আপনি ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, এই যথেষ্ট। কিন্তু অন্যদের তো সেই বুদ্ধিটুকুও নেই। দেখুন না, এতো জাঁকজমক করে এক ধর্মনেতার আজ জন্মদিন পালন করছে। অথচ এদেশে ধর্মের নেশা ধরিয়ে দেওয়া ধর্ম নেতার কোনো দরকার নেই। বরঞ্চ যুবকদের জন্য দরকার মাস্টারদা, নেতাজী, আশফাকউল্লাহ প্রমুখ বিপ্লবীদের। তাই বিবেকানন্দ নয়, আমাদের স্মরণ করা উচিৎ আজকের দিনে শহীদ হওয়া সূর্য সেনকে।
মুখে প্রায় চলে এসেছিল, সমস্যা হলো নেতাজী এই বিবেকানন্দের ভাব শিষ্য ছিলেন। মাস্টারদার দলে ঢোকার জন্য কালী মায়ের সামনে শপথ বাক্য পাঠ করতে হতো। কিন্তু বলার সাহস পেলাম না। এরপর উনি আরও প্রাচীন দার্শনিকের বাণী শোনাতে শুরু করলে সামলালে পারব না।
আমার ভাগ্য ভালো উনি মুড়াগাছা মোড়ের একটু পরেই অটোওয়ালাকে বললেন, ভাই, বাঁদিক চেপে দাঁড় করাও। কত যেন?
বাইশ টাকা। দু’টাকা খুচরো দেবেন।
খুচরো তো নেই।
সে কী? ওঠার সময়ই তো বলে দিয়েছিলাম, খুচরো দিতে হবে। তখন তো দিব্যি বলেছিলেন আছে।
আপনি মোটেই অটোয় ওঠার সময় জিগ্যেস করেননি?
কেন শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলছেন দাদা।
আমি মোটেই মিথ্যা কথা বলছি না। মা কালীর দিব্যি , আপনি ওঠার সময় কিছু বলেননি।
“মা কালীর দিব্যি!!!” শোনা মাত্র আমার বেদম হাসি পেল। বহু কষ্টে সামলালাম।
ভদ্রলোক দেখি রোষকষায়িত নয়নে আমার দিকে চাইছেন। কাঁচুমাচু মুখে বললাম, আমি হাসিনি। একটুও হাসিনি। বিশ্বাস করেন। একেবারে আইনস্টাইনের দিব্যি।
খুব সুন্দর লেখা, কৌতুক রস আর সিরিয়াস মেসেজে র ঠাস বুনন, হেব্বি লেগেছে।