আদনান সামি, পৃথিবীবিখ্যাত পিয়ানোবাদক, টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র ভাষায় সুলতান অফ মিউজিক। এক সময়ে তাঁর ওজন দাঁড়িয়েছিল ২৩০ কেজি। ডাক্তার বলেছিলেন, এভাবে চললে ছ’মাসের বেশি বাঁচার আশা কম। প্রায় অলৌকিকভাবে দেড় বছরের কম সময়ে ওজন কমিয়ে ৭০ কেজির নীচে নামান আদনান। তবে সবাই এমন করতে পারেন না।
এখন বিশ্ব জুড়ে চলছে স্থূলত্বের মহামারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার ওয়েবসাইটে বলছে, পৃথিবীতে মোট ৭৯০ কোটি মানুষের মধ্যে ১০৪ কোটি স্থূল। এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। এর উলটো দিকে আছেন কম-পুষ্ট মানুষ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে, বিশ্বে ৭০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত বা কম-পুষ্টির শিকার।
স্থূল মানুষেরা সাধারণত প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য খান। সহজ পাটিগণিতের হিসেব বলে, ১০৪ কোটি স্থূল মানুষের অতিরিক্ত খাদ্য ৭০ কোটি কম-পুষ্টিতে ভোগা মানুষদের শরীরে কোনোভাবে চালান করে দিতে পারলে বিশ্বে অপুষ্টি আর স্থূলত্ব এক সঙ্গে বিদায় নেবে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্থা ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ তথা ‘ফাও’ বলছে, “আমাদের প্রত্যেককে খাওয়ানোর মত পর্যাপ্ত খাদ্যেরও বেশি আছে। পৃথিবীতে এখন খাদ্যের প্রকৃত ঘাটতি নেই। খাদ্য যথেষ্ট আছে, অপুষ্টি হয় রাজনৈতিক কারণে।”
ভারতের অবস্থা
কিছুদিন আগে ‘ফাও’ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে। তাতে আশঙ্কার সুরে তারা বলেছে, “বিশ্ব সমস্ত ধরণের ক্ষুধা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপ-পুষ্টির অবসানের প্রচেষ্টায় পিছিয়ে যাচ্ছে।” তারা জানিয়েছে, ভারতবর্ষে ১৬.৩ শতাংশ মানুষ কম-পুষ্টির কারণে রোগা।
এই রিপোর্টের অন্য এক অংশ নিয়ে এই জুলাই মাসে ভারতের প্রায় সব সংবাদপত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ৯৭ কোটির ওপর ভারতীয় যথাযথ পুষ্টিকর খাদ্য কিনে খেতে অক্ষম। তবে এরা সবাই রোগা নন। ক্রয় ছাড়াও নানাভাবে খাদ্য সংগ্রহ করা যায়, এবং সরকারি প্রচেষ্টায় বিনামূল্যে বা কম দামে কিছু খাদ্য অনেকের হাতে পৌঁছে যায়। সরকারি প্রকল্পে মূলত চাল-গম জাতীয় দানাশস্য মেলে, তাতে সর্বাঙ্গীণ পুষ্টি না হলেও ক্যালোরি ঘাটতি অনেকটা মেটে। শুনলে অবাক লাগতে পারে, যথাযথ খাদ্য না জুটলেও কেবল ক্যালোরি ঘাটতি মিটলে মানুষের ওজন স্বাভাবিক হতে পারে, এমনকি বেশি-ওজন ও স্থূল হতেও বাধা নেই। কেবল স্বচ্ছলেরাই স্থূল হন না, গরীবরাও স্থূল হতে পারেন।
ভারত সরকারের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫ (২০১৯-২০২০) রিপোর্ট জানাচ্ছে, এ দেশে স্থূলত্ব দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের চারজনের মধ্যে একজনের ওজন বেশি।
অন্যদিকে কম-পুষ্টির কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের পাঁচজনের মধ্যে প্রায় একজনের ওজন কম, বা উচ্চতা অস্বাভাবিক রকমের কম।
স্থূলত্ব কেবল অবস্থাপন্নদের অসুখ নয়। ছোটখাট চেহারার বাণী, তার স্বামী তাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে, পাঁচ বাড়ি কাজ করে দিন গুজরান করে। বস্তির বাড়িতে তার মা হাঁটুর ব্যথায় কাতর, ভারি শরীর নিয়ে নড়তে পারে না। ডাক্তার বলেছে, রোগা হতে হবে। বাণী অবাক, ডাক্তার কিনা মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ করতে চাইছে! বাণী তার দুই মেয়েকে বস্তির পাশের দোকান থেকে প্যাকেটের মিষ্টি বিস্কুট, পটেটো চিপস আর দু’মিনিটের নুডলস কিনে দেয়, সকাল-বিকেল টিফিন বানানোর সময় তার নেই। মেয়েরা দিব্যি গোলগাল হয়ে উঠেছে। বাণী বলে, তার মেয়েদের যেন “তোমাদের ঘরের মেয়ের মতন চেহারা। তবু তো ওদের ফল মাছ-মাংস দিতে পারি না।” আলু ছাড়া অন্য তরি-তরকারিও দিতে পারে না সে, যা দাম! বাণীর শরীরও দিনে দিনে তার মায়ের মতন ভারি হয়ে উঠছে।
ভারতে বিভিন্ন গবেষণা দেখিয়েছে, বস্তির মানুষের এক বড় অংশ বেশি-ওজন বা স্থূল। অথচ তাঁরা নিজেদের স্বাভাবিক, এমনকি রোগা, বলে ভাবেন; ওজন কমানোর কথা চিন্তাই করেন না। তাঁদের কাছে বাচ্চার সুস্বাস্থ্যের একটিই লক্ষণ, বাচ্চা কত নাদুস-নুদুস। এদের মূল খাদ্য বলতে কেবল চাল-গম, সবুজ সবজি বিশেষ পান না। অন্যদিকে আছে প্রক্রিয়াজাত নানা খাদ্য—পটেটো চিপস থেকে এগ রোল।
স্থূলত্বের ব্যধি
স্থূলত্ব একটি রোগ। স্থূল মানুষদের ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, বিভিন্ন ধরণের ক্যানসার, মানসিক অসুখ, চর্মরোগ, সবই বেশি হয়। কোভিড-১৯ রোগের সময়ে আমরা দেখেছি, স্থূলকায়দের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় তিনগুণ। অর্থাৎ স্থূলত্ব বিপজ্জনক। খাওয়া কমালে এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আমরা এসব জেনেও স্থূলত্ব কমাতে পারি না। কেন? মানুষের প্রাচীন ইতিহাসে এর উত্তর লুকিয়ে আছে।
তিন লক্ষ বছর আগে মানব প্রজাতির উদ্ভব হয়। তার পর থেকে ১০-১২ হাজার বছর আগে পর্যন্ত সে ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। কোনোদিন তার পেট পুরে আহার জুটত, কোনোদিন কিছুই জুটত না। মাসের পর মাস অনাহার অল্পাহার ছিল তার জীবনের অঙ্গ। সেই সময়ে খাদ্য পেলেই বেশি করে খেয়ে নেওয়া দরকার ছিল। মেদ জমানোর প্রবণতা ছিল অত্যাবশ্যক, কারণ শিকারি-সংগ্রাহক জীবনে প্রাচুর্য ছিল অস্থায়ী, আর অনাহারের সময় শরীরে জমানো মেদ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখত। যে মানুষ উচ্চ ক্যালোরি-যুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খেয়ে শরীরে মেদ জমিয়ে রাখতে পেরেছে, সে টিকে থেকে বংশবৃদ্ধি করেছে। এই স্বভাব তার বংশানুক্রমিক হয়ে গেছে। তার ফলে আধুনিক মানুষও নিয়মিত যথেষ্ট খাদ্য পাওয়া সত্ত্বেও বেশি খেতে পছন্দ করে, বেশি ক্যালোরি-যুক্ত খাদ্য ভালবাসে, আর তার শরীর সহজেই মেদ জমায়।
এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ সময়মত যথেষ্ট খাদ্য পায়। নানা উচ্চ-ক্যালোরির খাবার এখন সহজপ্রাপ্য। পেস্ট্রি, চানাচুর, ঠাণ্ডা পানীয়, রসগোল্লা, পিৎজার মত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সম্প্রতি এসেছে, এরা স্থূলত্ব বাড়ায়। এমনকি চাল, মাংস বা আপেলের মত ‘স্বাভাবিক’ খাদ্যগুলোও এখন অল্পবিস্তর প্রক্রিয়াজাত, ও বেশি চর্বি জমায়। ঢেঁকিছাঁটা চালের জায়গার এসেছে কলে ছাঁটা চাল, ঘরে পোষা মুরগির জায়গায় এসেছে পোলট্রির মুরগি। এই চাল বা মাংসে স্থূলত্ব বাড়ার উপাদান বেশি।
প্রাচীন শরীরে আধুনিক খাদ্য
আধুনিক খাদ্যপ্রাচুর্যের পরিবেশের সঙ্গে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকের খাদ্যরুচি বেমানান। নেহাত অপুষ্ট না হলে এখনকার মানুষের ক্যালোরি কম করা প্রয়োজন। অথচ আমাদের খাদ্যরুচি প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক পূর্বসূরিদের মত, ফলে আমরা বেশি ক্যালোরির মিষ্টি-তেল-নুন দেওয়া খাদ্য খেতে প্রলুব্ধ হই। এখনকার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হতে গেলে মানুষের খাদ্যরুচির স্থায়ী পরিবর্তন দরকার। কিন্তু তার জন্য দরকার জিনগত বিবর্তন, সেই বিবর্তনের গতি ধীর।
অন্যদিকে, আমাদের খাদ্য ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন হল সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফল, তার গতি দ্রুত। দ্রুত জীবনযাত্রার বিবর্তনের সঙ্গে ধীর জিনগত বিবর্তন তাল রাখতে পারে না, পিছিয়ে পড়ে। একে বলে বিবর্তনীয় অমিল। আমাদের শরীর যতটা শারীরিক পরিশ্রমের জন্য গড়ে উঠেছে, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ তার চাইতে ঢের কম পরিশ্রম করেন। এটা আরেক বিবর্তনীয় অমিল। এই যুগ্ম অমিলের ফলে স্থূলত্ব, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ক্যানসারের বাড়-বাড়ন্ত। এই রোগগুলোকে এক কথায় বলে ‘বিবর্তনীয় অমিল-জনিত রোগ’।
রোগ জয়ের উপায়
এরা দীর্ঘস্থায়ী মারণ রোগ। রোগ হবার পরে চিকিৎসা করে তাকে সারানো যায় না, কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় মাত্র। ক্যানসার হবার আগে তামাক ব্যবহার বন্ধ করা ক্যানসারের দীর্ঘ চিকিৎসার চাইতে বেশি কার্যকর। তেমনই, যথাযথ খাদ্য ও ব্যায়াম অধিকাংশ বিবর্তনীয় অমিল-জনিত রোগ আটকাতে কার্যকর। আদনান সামি দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় স্থূলত্বকে আটকানো যায়। কিন্তু সকলে আদনান সামি হতে পারে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনাও প্রয়োজন।
প্রথম প্রয়োজন হল সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা। কঠিন কাজ, তবে বিগত অর্ধশতক ধরে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ইতিহাস জানাচ্ছে, এ কাজ অসম্ভব নয়। খাদ্য নিয়ে নিশ্চয়তা না থাকলে গরীব মানুষের স্থূল হবার প্রবণতা থাকবে। খাবারের জোগাড় কম থাকলে মোটা হবে, এই কথাটা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, খাদ্যের নিশ্চয়তা না থাকলে স্থূলত্বকে গবীর মানুষেরা ভবিষ্যতের জন্য বিমা হিসেবেই দেখবেন। সেই অনিশ্চয়তা দূর না করে স্থূলত্ব ঠেকানোর স্বাস্থ্যশিক্ষা তাঁরা গ্রহণ করবেন না। তাই কেবল কম-পুষ্টি ঠেকাতেই নয়, স্থূলত্বের মহামারী ঠেকাতেও সকলের খাদ্যের নিশ্চয়তা দরকার।
অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল খাদ্যের গুণমান। মানুষের জন্য যথার্থ উপযোগী খাদ্য তৈরি করা দরকার, অনুপযোগী খাদ্য তৈরি বন্ধ করা জরুরি। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পৃথিবীর ক্ষুধার্ত কোটি কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে। এবার সঠিক খাদ্য সঠিক পরিমাণে তৈরির প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। খাদ্য ইন্ডাস্ট্রি আর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা প্রায়শই খাদ্যের গুণমানের হানি ঘটায়, সেটা আটকানো প্রয়োজন। বর্তমানে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার কথা মাথায় রেখে প্রক্রিয়াজাত কোনও খাদ্যের প্রভাব বিচার করতে হবে, ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সকলের খাদ্যের নিশ্চয়তা ও কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর খাদ্য তৈরি, এই দুটি বিষয় সুনিশ্চিত করতে পারলে একদিকে কম-পুষ্টি, আর অন্যদিকে স্থূলত্বের হাত ধরে আসা নানা মহামারী থেকে মানব-সভ্যতা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। নিঃসন্দেহে অতি কঠিন কাজ। তবে বিশ্বের সমস্ত মানুষের উদরপূর্তির জন্য যথেষ্ট খাদ্য তৈরির দুরূহ কাজটা আমরা অতি সম্প্রতি করেছি, তাই আশা হারানোর কারণ নেই।
প্রবন্ধটি প্রথম এই সময় পত্রিকায় ২২শে জুলাই ২০২২ তারিখে প্রকাশিত।
অসাধারণ !