আদিবাসীদের মদ খাবার চল অনেক দিনের। নানা উৎসবে, বিয়েতে ওরা মহুয়া, তারি ও সলফি (ছত্তিশগড়ের একটা মদ) খায়। তবে এমনভাবে মদ খাওয়া যাতে সমাজের ধাঁচাটা ভেঙ্গে না পড়ে।
দল্লী রাজহরা ও অন্যন্য খনি বসতিতে মদ খাওয়ার চলটা বিপদ তৈরী করে। আদিবাসীরা ছাড়া নানা ধরনের জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস করে। তারা অনেকেই থাকে ঘনবসতির ঝুপড়ি এলাকায়। ট্রাক চালক, চালকের সহায়ক, দোকানদার এমন ধরনের অনেকে। বস্তি বসবাসের কুচাল চুপিসারে ঢুকে পড়ে এই বসতি এলাকায়।
এই সবই নিয়োগীজী ও কমরেডদের কাছ থেকে শোনা ১৯৮১ তে দল্লী রাজহরায় আমরা প্রথম যাওয়ার কালে। এরা বুঝতে পেরেছিল মদ কি ভাবে মজদুরদের ঘরের ভিতরটা তছনছ করে দিচ্ছে। অনেকেই মাইনের দিনই মাতাল হয়ে যায়। রাস্তার ধারে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘরণীদের, সন্তানদের মারধর করে। প্রতিদিনের রেশন তোলার জন্য অল্প টাকা পড়ে থাকে।
ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা সমাজ বদলের লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই মজদুরদের জীবনকে বদলের কাজে নামে। মজদুরদের জীবন বলতে তাদের সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলাধুলা এমন সব। মদ বিরোধী আন্দোলন এই বড়ো কাজের একটা অংশ।
দল্লী রাজহরায় আমার যাবার অনেক আগে থেকেই মদ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। নিয়োগীজী কমরেডদের সাথে আলোচনা করে, জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে, ঘরে ঘরে গিয়ে মদ খাবার খারাপ দিক নিয়ে কথা বলে গণআন্দোলন শুরু করে দেন।
অনেক মজদুর মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়। কয়েকজন ছাড়েনি। আর তখনই নিয়োগীজী মোক্ষম কাজটা করেন। মহিলা মুক্তি মোর্চাকে দায়িত্ব নিতে বলেন।
যারা মদ খেয়ে পরিবারে টাকা দিত না, পরিবারের লোকজনকে মারধোর করতো তাদেরকে মহিলা মুক্তি মোর্চার মিটিংএ ডেকে পাঠানো হতো। ২০ থেকে ৩০ জন মহিলা কর্মী দোষী মজদুরদের খারাপ দিকগুলি নিয়ে প্রথমে কথাবার্তা বলতো। তারপর শাস্তি দিতো।
শাস্তি সাধারণতঃ ২ ধরনের। দোষীকে মোটাসোটা ফাইন দিতে হতো। ফাইন থেকে পাওয়া টাকাটা শাস্তি পাওয়া মজদুরদের ঘরনীর হাতে লুকিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো।
আরেকটা অন্যরকমের শাস্তি ছিল। সুরেশবাবুর মার্ক্সবাদের ক্লাসে ১৫ থেকে ৩০ দিন যেতে হবে। সন্ধ্যেবেলায় ১৫ থেকে ২০ জন অপরাধী ইউনিয়ন রুমের একটা কোনে সুরেশবাবুর চারপাশে বসতো। আর ১ ঘন্টার আলোচনা শুনতো। আমার মনে হতো এ এক ধরনের অত্যাচার।
নিয়োগীজীর আর একটা ধরন ছিল। একজন বা দুজন নিয়মিত মদ খাওয়া মজদুরকে সারাটা দিন তাঁর সাথে নানা কাজে নিয়ে যেতেন। তারা বাড়ি ফিরতে পারতো গভীর রাতে।
একদিন ইউনিয়ন অফিসে রয়েছি। নিয়োগীজী চার-পাঁচ জন মজদুরদের সাথে নানা প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলছেন। একজন মজদুর ঘরে ঢুকলো জানালো মজদুর মহল্লার বাইরে এক জন মদ বানাছে।
নিয়োগীজী তখনই বেরিয়ে জিপে উঠলেন। সাথে তিনজন মজদুর, আর সাথে যে খবর এনেছে সে। আমি চুপচাপ জীপের পিছনের সিটে বসে পড়লাম। আমাকে দেখে নিয়োগীজী ভুরু কোঁচকালেন কিছু বললেন না।
খানিক বাদেই একটা ঝুপড়িতে পৌঁছালাম। মদ বানানো চলছিল। শুনশান জায়গা। দরজায় টোকা মারতে একজন পুরুষ, তার স্ত্রী আর আট কিংবা নয় বছরের একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। দু’জন মজদুর ঘরের ভিতর ঢুকে দুটো বড়ো কলসি ভর্তি মদ বের করে আনলো।
মজদুররা কলসিটা মাটিতে আছড়ে ভেঙ্গে দিল। দম্পতি কান্না জুড়ে দিল। বললো এভাবেই ওরা সংসার চালায়।
নিয়োগী পরিবারটির সাথে অনেকক্ষণ কথা বললেন। কমরেডদের বললেন শ্রমিক মহল্লার কাছে ওদের একটা পান বিড়ির দোকান বানিয়ে দিতে। খরচ দেবে ইউনিয়ন।
নিয়োগী দেখলেন ছোটো ছেলেটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে, হাঁটুর ঘা থেকে পূঁজ বেরোচ্ছে। আমাকে বললেন দেখে নিতে যদি চিকিৎসা করা যায়। ছেলেটার হাড়ে সংক্রমণ হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সারিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। দুজনেরই কপাল ভালো। আমার আর ছেলেটার।
ইংরেজী থেকে অনুবাদ: শুভেন্দু দাশগুপ্ত