প্রতিজ্ঞা করেছি চেম্বারে কিছুতেই রাগব না। কাল রাতে রূপালী বলেছে, ‘তুমি চেম্বারে এতো চিৎকার চেঁচামেচি করো কেন? ছি ছি… লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমি চিৎকার চেঁচামেচি করি? একেবারেই না। কবে করলাম?’
‘ওই তো গতকাল আমি হাসপাতাল থেকে ফিরছিলাম, তুমি একটা বয়স্ক লোকের সাথে চিৎকার করছিলে, “আপনার জীবন, আপনি কীভাবে মরবেন পূর্ণ স্বাধীনতা আপনার আছে। আপনি রোজ একটু একটু বিষ খেয়ে তিলে তিলে কষ্ট করে মরবেন, নাকি একবারে বেশি বিষ খেয়ে আরামে টেঁসে যাবেন, সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।” আহা… কী মুখের ভাষা… একেবারে ডাক্তারের উপযুক্ত।’
বললাম, ‘ওই ভদ্রলোক-. যদিও তিনি সেটা কিনা তাই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, তিন বছর ধরে হাঁপানিতে ভুগছেন। কিন্তু কিছুতেই বিড়ি সিগারেট বন্ধ করছেন না। বন্ধ করতে বললেই বলেন, অনেক কমিয়ে দিয়েছি। আর সাতদিন বাদে বাদে কাশি নিয়ে দেখাতে আসছেন। তুমি আমার জায়গায় থাকলে তোমারও বিরক্তি লাগত।’
‘পরশুদিন তোমাদের চা দিতে নেমেছি, দেখি তুমি একজনকে বলছো, “ঘুষি মেরে আপনার নাক ফাটিয়ে দেওয়া উচিৎ। নেহাত বাবার বয়সী বলে কিছু বললাম না।” এটা ডাক্তারের ভাষা না মস্তানের?’
‘উনি নির্ঘাত সুগারের ওষুধ বন্ধ করে করলার জুস খাচ্ছিলেন। এই করলার জুস খাওয়ার কথা শুনলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারি না।’
‘কেন? কেউ করলার জুস খেলে তোমার সমস্যা কী? করলার জুস খাক, টেংরির জুস খাক, আমসত্ত্ব খাক, তুমি মাথা গরম করছো কেন?’
অবাক হয়ে বললাম, ‘আমসত্ত্ব খেলে তো আমি মাথা গরম করি না। আমসত্ত্ব অত্যন্ত ভালো খাবার… পুষ্টিকর খাবার। আজ পর্যন্ত আমসত্ত্ব খাবার জন্য আমি কাউকে কিছু বলিনি।’
‘ওসব শুনতে চাইনা। রাগ অত্যন্ত খারাপ জিনিস। ষড় রিপুর অন্যতম খারাপ রিপু। রাগ মানুষকে পশু বানিয়ে দেয়। যে যা ইচ্ছে করুক, তুমি আর রাগবে না, ব্যাস। হাসিমুখে কথা বলবে।’
আপাতত চেম্বারে রুগী দেখতে দেখতে হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করছি। ‘প্রেশার এতো বেড়ে গেল কী করে? ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছেন… সাবাস দাদা… আপনার সাহসকে কুর্নিশ। প্রেশার বেড়ে যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন জেনেও আপনি যেভাবে অকুতোভয়ে জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করেছেন… আচ্ছা দাদা আপনার হাতে ঘড়ির মতো এটা কী?’
আমার থেকে কয়েকবছরের বড়ো মানুষটি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বললেন, ‘এটা ডিটক্স ম্যাগনেট। ব্যাটারিতে চলে। এই যে এই সুইচটা টিপলেই একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হবে। এবং যার ফলে ব্লাডের ডি টক্সিফিকেশন হবে। আসলে আমাদের মতো যারা প্রেশার, কোলেস্টেরলের রোগী এবং চাকরির প্রেশারে ব্যায়াম টেয়ামের সুযোগ পাই না, তাঁদের রক্তে অনেক টক্সিন জমা হয় তো। সেগুলো তো দূর করতে হবে।’
আমি রীতিমতো অবাক হয়ে বললাম, ‘এই একটা সুইচ চাপলেই সব টক্সিন দূর হয়ে যাবে? হয় নাকি কখনো?’
‘কেন হবে না। আমাদের রক্তের মূল উপাদান হিমোগ্লোবিন। তাতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। সেই হিমোগ্লোবিন যখন ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আর এই আলোড়নই টক্সিন গুলিকে আলাদা করে ফেলে। আপনি নিশ্চয়ই সেন্ট্রি-ফিউজ যন্ত্রের মাধ্যমে আলোড়ন তুলে রক্তের বিভিন্ন উপাদানকে পৃথক করার কথা শুনেছেন?’
সেন্ট্রি-ফিউজ যন্ত্র দেখেছি অনেকবার। চালিয়েও দেখেছি। কিন্তু এতটা ফিউজ কাটা মানুষ খুব কমই দেখেছি। রূপালীর উপদেশ মনে পড়ল। রাগা যাবে না। আগে লোকজন আঙটি পরতো, মাদুলি কবজ পরতো। মানুষ যতো বিজ্ঞান মনস্ক হচ্ছে, কুসংস্কার গুলিও ততো বেশি বিজ্ঞানসম্মত হয়ে উঠছে। যেমন বিজ্ঞান সম্মত জ্যোতিষ, বিজ্ঞান সম্মত বাস্তু সংস্কার, বিজ্ঞান সম্মত হনুমান চল্লিশা যন্ত্র।
ভদ্রলোকটির তখনও উৎসাহ কমেনি। বলে চলেছে, ‘আপনাদের তো মানব শরীর নিয়ে অনেক বেশি জ্ঞান। আপনার এই ব্যাপারে কী মতামত, এভাবে কী ব্লাড ডিটক্স করা সম্ভব?’
‘ব্লাড ডিটক্স করা সম্ভব কিনা জানি না? তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এ পদ্ধতিতে মানব দেহ থেকে কমার্শিয়াল ভাবে লোহা নিষ্কাশন সম্ভব। এ ব্যাপারে আপনিই ভালো বলবেন। আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ।’
পরের রোগী মেজাজ আরও গরম করে দিলেন। সুগারের রোগী। মাস ছয়েক পরে দেখাতে এসেছেন। কিচ্ছু আনেননি। আগের প্রেসক্রিপশন, ওষুধপত্র, রিপোর্ট টিপোর্ট কিচ্ছু না। শুধু বলছেন, ‘আপনি ওষুধ লিখে দেন। আগের বার যে ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, ওটাই লিখুন। ওটা খেয়ে সুস্থ ছিলাম।’
বললাম, ‘সেই ওষুধটা অন্তত দেখান। না হলে কী করে লিখব?’
‘কী আশ্চর্য, আপনিই তো লিখেছিলেন, আর আপনিই মনে করতে পারছেন না। আপনি কারো চারশো সুগার ধরা পড়লে কী ওষুধ দেন? সেই ওষুধই লিখে দেন।’
বললাম, ‘আপনি আরেকবার সুগার করে কাল বা পরশু আসুন। সব কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে।’
‘কাল আসা সম্ভব নয়।’
‘তাহলে পরশু?’
‘বললাম তো, কাল, পরশু, তার পরের দিন… আপাতত আর আসা সম্ভব নয়। আজ রাতেই আমি পুনেতে ছেলের কাছে চলে যাচ্ছি। আপনি চার মাসের মতো ওষুধ দিয়ে দেন। ফিরে এসে যা হয় করা যাবে।’
প্রায় জিভের আগায় চলে এসেছিল, ‘মরণকালে হরি নাম করে বিশেষ লাভ নেই।’ চুপচাপ গিলে ফেললাম। কিছুতেই রাগা যাবে না। গৌর কে ডেকে বললাম, ‘একটা র্যান্ডম সুগার করো।’
র্যান্ডম সুগার এলো ৬৩০ মিগ্রা/ডেসিলি। সুগার দেখে রোগী ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, ‘এতো কী করে হলো? আমি তো মাসখানেক ওষুধ খেয়েছিলাম।’
বললাম, ‘কবে কী ঘি খেয়েছিলেন, আর গন্ধ শুঁকে লাভ নেই।’ বলেই জিভ কাটলাম। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
কথা কম বলে চটপট রোগী দেখতে শুরু করলাম। ঝগড়া ঝাঁটি ছাড়াই প্রায় শেষ করে এনেছি। এক মহিলা এসেছেন, একাধিক বাড়িতে ঘর মোছা, বাসন ধোওয়ার কাজ করেন। প্রেশার সুগার সব কিছুই আছে। ইনিও ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন না। তবে এনার ওষুধ না কেনার মূল কারণ আর্থিক। মহিলাকে বললাম, জন ঔষধি থেকে ওষুধ কিনতে। তাতে ওষুধের খরচ প্রায় তিনভাগের একভাগ হয়ে যাবে।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘যা গরম পড়েছে, আর পারা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। চোখ মুখও কেমন গর্তে ঢুকে যাচ্ছে।’ তারপর আমায় প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ওই এনশিওর না কী একটা, যে বাড়িতে কাজ করি ওই বাড়ির বৌদি খায়, ওই টা খেলে কী চেহারা ভালো হবে? ওটার কী অনেক দাম?’
কিছুতেই রাগ করা যাবে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, ‘ওই সব না খেয়ে আগে ওষুধটা ঠিকঠাক খান। আর যদি পয়সা থাকে একটা করে ডিম সেদ্ধ খান। ঐসব গুড়োর থেকে কম পয়সায় অনেক বেশি পুষ্টি হবে।’
ডক্টর ভৌমিক কে জানাই ধন্যবাদ ও অভিনন্দন🙏 হোয়াটসঅ্যাপ এ এই রিকোনা পেয়ে,আপনার এই গল্পের নাট্য রূপান্তর ও অল্পবিস্তর সংলাপ যোগ করে করে নাটক ও শ্রুতি নাটকের রূপ দিয়েছি, পারিবারিক সম্মেলনে শ্রুতি হিসেবে মঞ্চস্থ করলাম, প্রচুর প্রশংসা ও দর্শকের হাঁসির খোরাক ও পেয়েছি । বড় কথা হাঁসির ঝলকে মানুষের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বিভ্রান্তির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।আগামী দিনে মঞ্চ নাটক করার ইচ্ছে। আশাকরি আপনার অনুমোদন পাবো।