“খুব খারাপ অবস্থা,’জিসিএস’ সাত-আটের বেশি হবেনা” – আতঙ্কগ্রস্ত গলায় রঞ্জন জানায়। শোল্ডার জয়েন্টটাও ডিসলোকেটেড হয়ে রয়েছে। তীব্র মদের গন্ধ। রাতদুপুরে আমাদের মেডিকেল সেন্টারের কাছে উপুড় হয়ে পড়েছিল। মনে হয় পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে গেছে। লোকটাকে আমাদের সুইপার ভাই চ্যাং-দোলা করে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে এসেছে। রাত দু’টো বাজে। মাতালদের স্বর্গ থেকে খসে পড়ার আইডিয়াল সময়। সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার আমাদের ইন্টারকমটা কয়েকদিন হ’ল দেহ রেখেছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে কোনোমতে ঠেকনা দিয়ে যে লোকটাকে শিলিগুড়ি পাঠাবো তার উপায় নেই। রঞ্জন বেশ কড়া গলায় সুইপারকে বকাঝকা করছিল। আপদটাকে তুলে এনে কেন আমাদের বিপদে ফেলা! সুইপারভাইও গলা পর্যন্ত গিলে আছে। তাকে যে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে বাড়ি থেকে ডাকতে পাঠাবো তার উপায় নেই। ভুল করে অন্য কারোর বাড়িতে ঢুকে পড়লেই তো চিত্তির – এইরাতে ভূত আর চোরছ্যাঁচড় ছাড়া অন্যকিছু লোকে ভাববেই না। লোকের মার খেয়ে ইঞ্জিওরড্ হয়ে আমাদের কাজ বাড়াবে। “ছেড়ে দে রঞ্জন, বরং এই মালখোরটাকে সামলাই।” – আমার নতুন আসা কলিগকে জানাই। দুজন মিলে টেনেটুনে শোল্ডার ডিসলোকেশনটাকে ঠিক করার সাথেসাথে লোকটার খিঁচুনি শুরু। খিঁচুনি থামার পরে হড়হড় করে বমি। বমি, রক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে রঞ্জন মহাপুরুষদের মতো ঘোষণা করে – “তুমি লিখে নাও অনিদা, ও আর ঘন্টাখানেকের বেশি বাঁচবে না। ওর বিশ্রীরকম হেড ইঞ্জুরি আছে। কাল সকাল থেকে পুলিশি ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে।”
রঞ্জন আমার কলেজের জুনিয়র। নতুন একজন জলঢাকায় পোস্টিং পাচ্ছে জেনে একটু ভয়ে ছিলাম। মিসেসকে আগের কলিগের সাথে সুমধুর সম্পর্কের কথা বলেছিলাম। সেও বেশ আতঙ্কে ছিল। কি জানি বাবা, কেমন হবেন ভদ্রলোক? যেদিন জয়েন করবে সেদিন জানলাম নতুন ডাক্তারের নাম রঞ্জন। এই রঞ্জনই যে কলেজের রঞ্জন হবে এতোটা আশা করিনি। ও গাড়ি থেকে নামতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। ওর অতোটা উচ্ছ্বাস নেই দেখে বললাম “কিরে, তুই মনে হচ্ছে আমাকে দেখে খুশি হোসনি?”
“খুশি হওয়ার কি আছে, আমি তো জানি তুমি এখানে আছো।” – রঞ্জনের সোজাসাপটা জবাব।
ওকে নিয়ে বাংলোয় এলাম। আমাকে এড়িয়ে চললেও দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে ওর বৌদির সাথে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। ফ্রেশট্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে দিব্যি দুজনে মিলে চা খেতেখেতে গল্প করছে। আমি ওর থাকা আর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে ইন্সপেকশন বাংলোতে গিয়েছিলাম। আমাকে ফিরতে দেখে দুজনেরই মুচকি হাসি। “অনির্বাণদার কোনো কথা পুরোপুরি বিশ্বাস কোরো না বৌদি, ডাক্তারিতে চান্স না পেলে লোকটা গল্প লিখে পেট চালাতো নির্ঘাত।” আমাকে এড়িয়ে চলার কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম।
তখন আমার থার্ড ইয়ার বোধহয়। কলেজ রাজনীতির প্রথম পাঠ পড়া হয়ে গেছে। শৌভিকের কড়া নির্দেশ ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সাথে লিয়াজঁ রাখতে হবে। নর্থবেঙ্গল থেকে একটা সহজসরল মিষ্টি দেখতে ছেলে এসেছে। মাজা রঙ, লম্বা বেশ – নাম রঞ্জন। শৌভিক আমাকে তার সাথে ভিড়িয়ে দিলো। মেন হোস্টেলের পাল ব্লকের একটা ঝুলন্ত ওয়ান-থার্ড ছাদ আছে। ফার্স্টইয়ারের ছেলেদের ওখানেই মুখাগ্নি হয়। অনভ্যস্ত হাতে সিগারেট ধরিয়ে রঞ্জন আমাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করে যে, কোন কোন দাদা ভালো আর কার কার কাছ থেকে র্যাগিং-এর ভয় আছে। আমি সবার সম্বন্ধে টুকটাক খবর দিচ্ছিলাম।
“ভাইপোদা নাকি খুব পড়াশোনায় সাহায্য করে। ভাইপোদা কোন ফ্লোরে থাকে বলতো?” রঞ্জনের প্রশ্নে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।
বললাম “থার্ডফ্লোরের বত্রিশ নম্বর ঘরে ঢুকে যে লোকটার মাথায় দেখবি একটা মাত্র চুল আছে সেই ভাইপোদা।”
রঞ্জন আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে “মাত্র একটা চুল?”
“হ্যাঁ” – আমি বর্ণনা দিই – “একটা চুল যদি বাঁদিকে শুইয়ে রাখে তো বুঝতে হবে ডানদিকে সিঁথি, ডানদিকে শোয়ালে বাঁদিকে সিঁথি আর উল্টে রাখলে বুঝতে হবে ব্যাকব্রাশ করেছে। মাসে একদিন হোস্টেলের নাপিত একটা চিমটি দিয়ে চুলটাকে ধরে মাঝখান থেকে কুচ করে কেটে দিয়ে দশটাকা (তখন ওটাই চুল কাটার রেট ছিল) নিয়ে যায়। ভাইপোদা সেদিন ওই একটা চুলে শ্যাম্পু করে বিকেলবেলা শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে ঘুরতে যায়।”i
রঞ্জনের চোখদুটো রাজভোগ একেবারে। ওযে এতোটা সরল বুঝতে পারিনি। পরের দিন ভাইপোদার সাথে আলাপ হতে মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল “তোমার তো ভালোই চুল আছে, দাদা!” আসলে ভাইপোদার “স্মৃতিটুকু থাক” মার্কা টাক ছিল। একটা ফার্স্টইয়ারের ছেলে তার টাক দেখে “ভালোই চুল আছে ” বলায় বেশ রেগে গিয়েছিল ভাইপোদা।
“কিছুটা ট্যাক্সের অংশ ছেড়ে অনিদার কথা বিশ্বাস কোরো বৌদি।” আমিও আমার ছেলেমানুষির কথা মনে পড়ে ওদের হাহা হাসিতে যোগ দিয়েছিলাম।
রঞ্জন বেশিদিন থাকেনি। আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম পড়াশোনা ঠিকঠাক হচ্ছেনা। এভাবে চালালে পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে চান্স পাওয়া যাবেনা। তার ওপর দুজনের চলতো রেষারেষি করে ডাক্তারি। আমি কি কি ভালো কেস পেলাম আর ও কটা দুর্দান্ত ডায়াগনোসিস করলো এই নিয়ে হিসেব চলতো। মাঝখান থেকে রেজিস্টার দেখাচ্ছে কদিনেই প্রায় পাঁচ-ছয়গুণ পেশেন্ট বেড়ে গেছে। বেশ মাস ছয়েক কেটে গেল। চিকিৎসার একটা নেশা আছে, সে একমাত্র চিকিৎসকরাই বোঝেন। ফলে সুযোগ থাকলে প্রাণ খুলে ডাক্তারি করা যায়।
সেই পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়া পেশেন্টটাকে সেলাইটেলাই দিয়ে হেডইঞ্জুরির চিকিৎসা শুরু করে দিলাম। কিছু এমারজেন্সি মেডিসিন সবসময়ই মজুত থাকে। খুঁজে পেতে ম্যানিটল, ফেনিটয়েন পাওয়া গেলো। কলেজতুতো দুই ভাই মিলে হিসেব নিকেশ করে চিকিৎসা শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর রঞ্জন বললো – “বৌদি একা আছে, তুমি চলে যাও।” আমার আবার রঞ্জনকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত দুজনেই চেয়ারে বসে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পাহাড়ের ভোরের সুন্দর কম্বলমুড়ি দেওয়া সৌন্দর্য আছে। একটা হালকা আলস্য নিয়ে দিন জেগে ওঠে। সোনালি আলো পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা গাছের পাতা থেকে ঝরে ঝরে পড়ে। পাথুরে পথ যেন চোখে হাতচাপা দিয়ে পাশ ফেরে, অন্য বাঁক ঘুরে ছায়ার দিকে শুয়ে পড়ে। মেঘগুলো অনেক নিচে নেমে এসে ঝর্ণার কানে কানে কথা বলতে চায়। এরকম একটা ভোর এলো সেদিন।
সুইপারভাই আমাদের ঠেলা দিয়ে বলে “চিয়া পিনুস, সাহাব। ” দেখি ছেলেটা চার গ্লাস চা এনেছে। “চার গ্লাস কেনরে পাগল?” ইশারায় দেখায় আমাদের পেশেন্ট উঠে বসে দাঁতের অ্যাডভারটাইজমেন্ট করছে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রঞ্জন বলে “সেকি গো, তোমার তো কালই মরে যাবার কথা ছিল!”
স্বপ্নের মতো ছিল সেইসব দিন। রঞ্জন একদিন সন্ধেবেলায় গল্প করতে করতে জানালো যে আর চাকরি করবে না। চাকরি সামলে পড়া সম্ভব নয়। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে বছর পিজি এন্ট্রান্সে আমার কোনো র্যাঙ্কও হলনা। বুঝতে পারছিলাম যতটা মন দিয়ে পড়া উচিত ততটা ভালভাবে পড়া হচ্ছে না। রঞ্জনই ঠিক বলছে, দু নৌকায় পা দিয়ে চললে হবেনা। কিন্তু রঞ্জনের মতো আমার তো চাকরি ছাড়লে চলবে না! এদিকে পাহাড়ে আমার তিন বছর হয়ে গেছে। মন বলছে অন্তত কলকাতার কাছাকাছি কোথাও ট্রান্সফার হলে সবার সাথে যোগাযোগ রেখে পড়াশোনা করতে পারবো।
আমার বাংলোর পিছন দিয়ে জলঢাকা নদী পাথরের বাধা টপকাতে টপকাতে অবিরাম ভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। অনন্তকাল ধরে। আর আমি যেন হতাশার হাত ধরে অন্ধকার আবর্তে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি। “জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই…… “।
চমৎকার
ধন্যবাদ ???
খুব ভালো হয়েছে গল্প, গল্প তো ঠিক বলা যায় না, এ গুলো তো আপনার জীবনের ঘটনা, জেনে ভালো লাগলো। আবার অপেক্ষায় থাকলাম ।
তুমি বোধহয় আমার সব লেখা পড়েছো।???
ভালো লাগছে।
ধন্যবাদ জয়। ❤
অবশ্যই পড়েছি,আগামী দিনেও সব গল্প পড়তে চাই ☺।
???
এ লেখাগুলোর একটাই দোষ,বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়… ☺
❤❤❤❤???
Khub sundar
ধন্যবাদ ম্যাডাম। ???
Just a blind fan-follower..
God bless you..Dr Ani..
We r really proud of u..
Carry on..my Hero..
Perhaps ,U r on the right track..
Keep it up..
So many thanx..
???
আপনার জীবনের এই ঘটনা গুলো জানতে পেরে খুব ভালো লাগল। আরও জানতে চাই। মজার ছলে এত সুন্দর লেখেন আপনি ।আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম ?