অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধ যে কোনও মূল্যে রুখতেই হবে। শুধু নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন বানিয়ে যে সেটা রোধ করা যাবে না, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নিয়ম পড়ে থাকবে ঘরের এক কোণে। ওসব কেউ খুব একটা পড়েও দেখবে না। নিয়ম নিয়মের জায়গায় থাকবে আর যথেচ্ছাচার চলবে সমানে। কয়েকটা জিনিস মেনে চললে হয়তো ধ্বংসের গতি একটু হলেও রোধ করা যায়।
১.
পাশ করা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সেটা শুধু নিয়ম হয়ে পড়ে থাকলে হবে না। যেমন, এখন আর হাটে-বাজারে টিবির ওষুধ পাওয়া যায় না। সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রেই সেটা করা দরকার। প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে একটি নির্দিষ্ট কোড থাকা দরকার। যাতে যে কোনও সময় সংশ্লিষ্ট ওষুধটি কোথায় যাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা যায়।
২.
অ্যান্টিবায়োটিকের পাতা কেটে একটি-দুটি করে ওষুধ বিক্রি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভেবে দেখুন, আপনার একদিন জ্বর হ’ল। আপনি পাড়ার অমুক দাদার পরামর্শে দুটি অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। তারপর জ্বর কমে গেল। ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ হল না। এগুলো বিষধর সাপকে একটু করে খুঁচিয়ে দেওয়ার মত ব্যাপার।
৩.
পাশ করা ডাক্তারদেরও বছর তিনেক ছাড়া ছাড়া বাধ্যতামূলকভাবে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বইয়ের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে পুরোদস্তুর প্র্যাকটিসে নামলে অনেক কিছু ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
৪.
বাইরের দেশের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নিয়ম দিয়ে এদেশে চিকিৎসা হবে না। শুধু দেশ নয়, ছোট ছোট জায়গা এমনকি একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালের ভিত্তিতেও অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধের ধরণ বদলে যায়। সম্ভব হ’লে প্রতিটি হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধের ধরণের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা গাইডলাইন তৈরি হওয়া প্রয়োজন।
৫.
সব জায়গায় গাইডলাইন মেনে চলা হচ্ছে কিনা তার উপরে কড়া নজরদারি দরকার। কোনও একটি নির্দিষ্ট রোগে কোনটি প্রথম সারির অ্যান্টিবায়োটিক এবং কোনগুলি ক্রমান্বয়ে শেষের দিকের অ্যান্টিবায়োটিক তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার। যে কোনও ডাক্তার (সে তিনি পদমর্যাদার দিক দিয়ে যতই উপরে হোন না কেন) সেই গাইডলাইন মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। কোনও ক্ষেত্রে গাইডলাইন ভেঙে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাইলে তার নির্দিষ্ট কারণ লিখে রাখতে হবে। সত্যিই বারবার গাইডলাইন ভাঙার প্রয়োজন হ’লে দরকার মতো গাইডলাইন সংশোধন করতে হবে।
৬.
একসাথে অনেক রোগে কাজ করে বা বিশেষ কিছু রোগের মহৌষধ; এমন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একাধিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো। অথচ, পাড়ার উমুক-তমুক দাদাও বাড়িতে বসে মেরোপেনেম কিংবা লিনেজোলিড শুরু করে দেন। সেটা যে কোনও উপায়ে বন্ধ হওয়া দরকার।
৭.
বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও নিয়মের আওতায় আনা দরকার। হয়তো একটু কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। অকারণে মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে কিনা সেটা দেখা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালে নিজেদের গাইডলাইন না থাকলে তাঁরা নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালের গাইডলাইন মানবেন।
৮.
সব ধরনের টিকাকরণ করানো উচিত। (আর্থিক সমস্যা না থাকলে) সরকারি টিকাগুলো ছাড়াও প্রয়োজনীয় বাড়তি টিকা দেওয়া উচিত। রোগ হওয়ার আগেই আটকানো গেলে ভালো।
৯.
হাসপাতালে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা দরকার। নিজেদের হাত পরিষ্কার রাখলে অনেকটা সংক্রমণ ঠেকানো যায়। করোনা অতিমারীর সময় মুখে মাস্ক থাকার ফলে যত্রতত্র থুতু, পানের পিক ফেলা অনেকটা কমেছিল। আমরা আবার সাফল্যের সাথে পানের পিকে রাস্তা রাঙানো শুরু করেছি।
১০.
স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বৃহদাংশ সরকারি ছাতার তলায় এলে প্র্যাক্টিসের প্রতিযোগিতা কমবে। ‘রোগী-ধরা’ আর ‘ডাক্তার-কেনা’র খেলাটা কিছুটা কমলে অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহারও কমতে বাধ্য।
১১.
মাছ, মুরগী বা গবাদী পশু চাষের জায়গায় অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহারের দিকে নজরদারি দরকার।
১২.
ফাজ থেরাপি, প্রিডেটর বা ঘাতক-ব্যাক্টিরিয়া প্রয়োগ ইত্যাদি কিছু আধুনিক আবিষ্কার খানিক আশার আলো দেখাচ্ছে। হয়তো এগুলোর দ্বারা ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার অনেকটা কমিয়ে ফেলা যাবে।
****
রোগজর্জর পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিক অজান্তেই অমৃতের মতো ঝরে পড়েছিল। যে পরিমাণ মানুষের জীবন সে বাঁচিয়েছে, তার হিসেব করতে গেলে সংখ্যাই শেষ হয়ে যাবে সম্ভবত। মূলত আমাদের অবিমৃষ্যকারিতায় সে অমৃতের উত্তরাধিকার আমরা হারাতে বসেছি। জীবাণুর দল আজকাল অ্যান্টিবায়োটিককে ভয় পায় না। নিজেদের বাঁচানোর স্বার্থেই অ্যান্টিবায়োটিককে বাঁচানো দরকার। এই লড়াইটা সবার। এবং, এ লড়াই জিততেই হবে।
ছবিঃ গুগল