অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আগের পোস্টে কিছু সংশয় ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বোধহয়। লেখাটা পড়ে কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছেন অ্যান্টিবায়োটিক মানেই বুঝি খুব খারাপ কিছু। সেই জায়গাটা আগে পরিষ্কার করছি…
অ্যান্টিবায়োটিক আসলে অমৃতের আরেক নাম। রোগজর্জর পৃথিবীতে অন্যতম সুধাস্পর্শ। অ্যান্টিবায়োটিক, ওআরএস এবং ভ্যাক্সিন চিকিৎসা-বিজ্ঞান তো বটেই, সব ধরনের আবিষ্কারের ইতিহাস মিলিয়েই সম্ভবত সর্বোৎকৃষ্ট আবিষ্কারের দলে পড়বে। যে আবিষ্কার মানুষের বেঁচে থাকার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, তার চেয়ে বড় কিছু হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে সামান্য সংক্রমণও মারণ রোগ ছিল। অ্যান্টিবায়োটিক এসে ছবিটা বদলে দেয়।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর কত সংখ্যক মানুষের জীবন বেঁচেছে তার হিসেব করতে গেলে সংখ্যায় কুলোবে না। অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার করে আমরা ধ্বংস ডেকে আনছি। সে দোষ অ্যান্টিবায়োটিকের নয়। দোষ ব্যবহারকারী কিংবা উপদেশ প্রদানকারীর। দোষ যন্ত্রের নয়; যন্ত্রীর। আশা করি, জায়গাটা পরিষ্কার হ’ল। আর দোহাই, পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে অ্যান্টিবায়োটিককে দোষারোপ করবেন না। পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই যার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় না। ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা’ সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। রাস্তায় নামলে হোঁচট খেতে হয় বলে, ট্রেন-বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বলে কেউ সেগুলো বন্ধ করার কথা ভাবেন না। কেননা লাভের ঘরে বহু বহুগুণ বেশি জমা পড়ে। তাই সামান্য ক্ষতি স্বীকার করে নিতেই হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর সব ব্যাক্টিরিয়াঘটিত সংক্রমণ ম্যাজিকের মতো সারতে শুরু করে। যেগুলো এতদিন দুঃস্বপ্ন ছিল। সেই সাথেই অপব্যবহার এবং অবিমৃষ্যকারিতা শুরু হয়। অ্যান্টিবায়োটিককে সর্বরোগের মহৌষধ ভেবে যত্রতত্র, যেমন খুশি ব্যবহার করা শুরু হয়। জীবাণুর দলও ভীষণ বুদ্ধিমান। তারা শত্রু চিনে নিজেদের বদলে নিলো। হয়ে উঠলো অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী। একটার পর একটা অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে আর উল্টোদিকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়াও বেড়েছে।
ইতিহাসের দিকে তাকাই। ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার হ’ল। তারপর একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে। ১৯৫০ সালে আবিষ্কার হ’ল টেট্রাসাইক্লিন। ১৯৫৩-তে এরিথ্রোমাইসিন, ১৯৬০-এ মেথিসিলিন, ১৯৬৭ তে জেন্টামাইসিন, ১৯৭২ সালে ভ্যাঙ্কোমাইসিন। সে ছিল অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ।
কিন্তু প্রতিরোধী-ব্যাক্টিরিয়া আসতে শুরু করল হু হু করে। বুদ্ধিমান ব্যাক্টিরিয়া নিজেদের জীনগত পরিবর্তন করে কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক ধ্বংসকারী উৎসেচক তৈরি করে নিজেদের রঙ বদলে ফেলতে লাগল। অ্যান্টিবায়োটিক শত্রু চিনতে পারল না অথবা চিনতে পারলেও তাদের শক্তিশালী বর্ম ভেদ করতে পারল না। ১৯৫০ সালে আবিষ্কার হওয়া টেট্রাসাইক্লিনের প্রতিরোধী-ব্যাক্টিরিয়া এসে গেল ১৯৫৯-এ। তারপর বাঁধভাঙা জলের মত ১৯৬২ তে মেথিসিলিন, ৬৮ তে এরিথ্রোমাইসিন, ৭৯ তে জেন্টামাইসিন, ৮৮ তে ভ্যাঙ্কোমাইসিন প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়া পাওয়া গেল।
ফলাফল হ’ল মারাত্মক। একটু তথ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক…
১. আমেরিকায় বছরে ২ মিলিয়ন মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হন এবং বছরে ২৩০০০ জন মারা যান।
২. ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২০১৫ সালের তথ্য অনু্যায়ী বাৎসরিক আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭১৬৮৯। প্রাণ যায় ৩৩১১০ জনের।
৩. ভারতের দিকে তাকাই। শুধু শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বাৎসরিক ৫৮০০০।
৪. ইংল্যান্ডে বছরে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়া সামলাতে অতিরিক্ত ১.৫ বিলিয়ন ইউরো খরচ হয়।
৫. অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার দ্রুত রোধ করা না গেলে ২০১৪-৫০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ বেঘোরে মারা পড়বেন। ২০৫০ সালের পর বছরে ন্যূনতম ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারন হবে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স।
৬. কয়েকটি জীবাণুর কথা বলা যাক। ই. কোলাই ভারতে ১৬% সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। ক্লেবসিয়েলা, সিউডোমোনাস, অ্যাসিনেটোব্যাক্টরের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ৫০%, ৪১%, ৭০%
অর্থাৎ, যে অ্যান্টিবায়োটিক এতদিন রক্ষাকবচ হয়ে এসেছে আজ সে কবচ ক্ষতবিক্ষত, ভঙ্গুর। তার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগের কালো দিনগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছি। যদি মনে করেন, আগে সবাই খুব সুস্থ শরীরে বাঁচতেন; তাহলে আর একবার মনে করিয়ে দেবো- স্বাধীনতার সময়েও দেশের গড় আয়ু ছিল মাত্র বত্রিশ বছর!
অ্যান্টিবায়োটিক হেরে গেলে আমরাও হেরে যাবো। অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু সে এখনো অমৃত। এখনো হাজারে হাজারে মানুষের জীবন বাঁচে তার হাত ধরে। সে অমৃতের উত্তরাধিকার হেলায় হারালে ভবিষ্যতের কাছে উত্তর দেওয়ার মতো কিছুই থাকবে না।
(কেন অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার হয় আর তার সমাধানের রাস্তা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করবো)