রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচন সমাগত। মেডিকেল কাউন্সিল একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বডি। কাউন্সিলের নির্বাচনে, ইতিহাসে এই প্রথম, একগুচ্ছ প্রার্থী লড়ছেন সরাসরি একটি রাজনৈতিক দলের নামে। ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’ পরিচয়ে।
রাজ্যের সব চিকিৎসক কাউন্সিল নির্বাচনে ভোট দেন। তাঁদের বাড়িতে ব্যালট আসে, ডাকযোগে। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের জন্য আরও একখানা ব্যালট আসে, কলেজের প্রিন্সিপালের অফিসে। চিকিৎসক হিসেবে তাঁরা যেমন সাতজনকে বাছতে পারেন (ক্লজ এইচ), শিক্ষক-চিকিৎসক হিসেবে বাছতে পারেন আরও একটি প্যানেলের সাতজনকে (ক্লজ জি)। শিক্ষক-চিকিৎসক তাঁরা, গুরুদায়িত্ব বইকি!!
তো কলেজগুলোর প্রশাসক যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ, তাঁদের কর্তব্য ব্যালটের ঠিকঠাক বিলিবণ্টন। অর্থাৎ তাঁদের কাজ যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থাকা। কিন্তু ঘটছে তার বিপরীত।
কলেজের প্রশাসনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধানদের কাছে খোলাখুলি ভোট চাওয়া হচ্ছে। ফোন করে ফাঁকা ব্যালট চাওয়া হচ্ছে। এমনকি, ডিপার্টমেন্টের বাকিদের কাছ থেকে ভোট ও ব্যালট জোগাড় করে দেওয়ার ব্যাপারে বিভাগীয় প্রধানদের প্রতি ‘অনুরোধ’-ও আসছে।
কলেজ চলাকালীন, ডিউটি আওয়ারের মধ্যেই, কলেজ অডিটোরিয়াম বা বড় লেকচার থিয়েটারে ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’-দের প্রচারসভা আয়োজিত হচ্ছে। কলেজের প্রশাসনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেই প্রচারসভায় উপস্থিত থাকার জন্য ‘অনুরোধ’ জানাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষরা। রাজ্যের প্রায় সবকটি মেডিকেল কলেজে চলছে এই পরিস্থিতি।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকপ্রার্থী’-রা দলীয় সংস্কৃতি মেনে এমনটাই করবেন, সে প্রত্যাশিত।
মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ যাঁরা, তাঁদের দেখে অবশ্য একটু লজ্জাই করেন। এঁদের অনেকেই শিক্ষক হিসেবে ও চিকিৎসক হিসেবে সম্মানের যোগ্য – স্যার বলে ডাকি এঁদের অনেককেই – ছিঃ বলতেও কেমন একটা লাগে। মেডিকেল শিক্ষার নতুন কারিকুলামে, শুনেছি, এথিক্সের উপর বাড়তি জোর দেওয়া হবে। এঁরাই পড়াবেন নিশ্চয়ই।
আর মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের প্রতি…যাঁরা এইসব প্রচারসভায় বসে ফাঁকা ব্যালট তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশে… নাহ্, কিছু বলার নেই।
তো কথাটা হলো, ডাক্তারবাবুরা ইদানীং ভয়ানক হোলিয়ার-দ্যান-দাউ। দেশ ও রাজ্যের এই হালের পেছনে যে অশিক্ষিতদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনিবার্য ব্যর্থতা, সে নিয়ে এঁদের অনেকেই খুব নিশ্চিত। -সাথী -শ্রী-র টাকায় ভুলে গরীবগুর্বো অশিক্ষিতরা ভোট দেয় বলেই যে নেতারা যা-ইচ্ছে-তাই করে রাজ্যটাকে লাটে তুলে দিচ্ছে, এ নিয়ে তাঁরা অতি নিশ্চিত।
কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে…
এই কাউন্সিল নির্বাচনে আমিও প্রার্থী। মেডিকেল শিক্ষক হিসেবে। স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত মেডিকেল কাউন্সিলের দাবিতে।
প্রার্থী হিসেবে আমার ভোট চাওয়া উচিত। আমার সহকর্মী সহশিক্ষকদের কাছে।
কিন্তু, বর্তমানে, এই রাজ্যে, মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকদের জন্য থিম সং হতে পারে… ওই শুরুর লাইনখানা…
মানুষ নহি কো, আমরা মেষ…
যাঁরা যাঁরা সত্যিকারের ভালোবেসে ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’-দের ভোট দেবেন, তাঁদের জন্য রইল আমার শ্রদ্ধা।
আর যাঁরা যাঁরা মেষের পাল হিসেবে প্রচারসভায় হাজির হচ্ছেন, ফাঁকা ব্যালট তুলে দিচ্ছেন – তাঁদের কাছে আমার ভোট চাওয়ার নেই।
মেষপালক হওয়া একটা ব্যাপার, মেষকুলের কাছে অনুরোধ করতে চাওয়া ব্যাপারটা অকল্পনীয়।
পুনঃ- পীতবরণ স্যার, আপনার জন্য খারাপই লাগছে। অভিমান আপনি করতেই পারেন। সত্যিই তো, সব পাখি যেখানে মাছ খাচ্ছে, আপনি একা মাছরাঙা হিসেবে বদনাম কেন নেবেন!!