Skip to content
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

আর্টিস্ট

Scan_20160930 (3) 2
Dr. Aniruddha Deb

Dr. Aniruddha Deb

Psychiatrist, Writer
My Other Posts
  • September 4, 2022
  • 11:23 am
  • No Comments
১
হাতের তুলিটা নামিয়ে রেখে সুকৃত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সামনে তৈরি ক্যানভাসটা এখনও পরিষ্কার। প্যালেটে এখানে ওখানে রঙের জগঝম্প। মাথায় কিচ্ছু আসছে না। সুপ্রতীক বলে, “হাবিজাবি। নিও-ইম্‌প্রেশনিস্ট না ঘোড়ার ডিম। ধ্যাবর ধ্যাবর করে চালান’ তুলি! সবুজটা গাছ, হলুদটা বালি আর নীলটা আকাশ ভাবে সবাই। তার জন্যেও এত কী ইন্‌স্‌পিরেশন লাগে?”
আজও নিশ্চয়ই তাই বলত। কাজটা ওরই সোর্সে পাওয়া। ওর অফিসের এম.ডি তরুণ সামন্তর একটা ল্যান্ডস্কেপ চাই। সুপ্রতীককে দিয়ে বলিয়েছেন। সুকৃত মেজাজি মানুষ সবাই জানে। ফট করে ‘না’ বলতে আটকায় না।
অত বড় একটা সংস্থার এম.ডি-কে ‘না’ বলার দম সুকৃতর থাকুক চাই না থাকুক, সুপ্রতীক বললে তো ‘না’ বলার প্রশ্ন ওঠে না, তাই ‘হ্যাঁ’-ই বলেছিলেন। চার দিন গেল। এম.ডি-র ফরমাশের শরতের নীল আকাশ আর সোনালী হলুদ মিশিয়ে কোন আইডিয়াই আসছে না।
সরে এলেন সুকৃত। সাদা ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আইডিয়া আসে না। বিরক্তি বাড়ে। উত্তরমুখী জানালার বাইরে দেখার নেই কিছুই — সামনের উঁচু বাড়ির নোংরা কালচে দেওয়াল। ওপরে ছাইরঙা আকাশ।
কাজটা না নিলেই হত। কমিশন নিয়ে সুকৃত আঁকেন না তা নয়, ছোটদের ম্যাগাজিনে ইলাস্ট্রেশনের কিছু কাজ সুপ্রতীক দেয় মাঝে মাঝে। ওর এখন এত চাপ যে সময়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। সেই সম্পাদকরা সস্তায় কাজ করাতে চাইলে সুকৃতকে ফোন করে। সে দায়িত্ব আর এই দায়িত্বে অনেক ফারাক।
স্টুডিও থেকে বেরিয়ে খানিকক্ষণ ড্রয়িং রুমের দেওয়ালের ছবিগুলো দেখলেন ঘুরে ঘুরে। সবই নিজের ছবি। শুধু ডাইনিং রুমে দুটো নিজের না। একটা সুপ্রতীকের বিরাট শিবঠাকুর, আর একটা সুঋতির আঁকা। এটা অরিজিন্যাল না। ইনটারনেট থেকে নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রেজোলিউশান বজায় রেখে বড় একটা প্রিন্ট নেওয়া। ল্যান্ড — না, সী-স্কেপ।
এই ছবিটার সামনে দাঁড়ালে অনেক পুরনো কথা ভীড় করে আসে। ব্যাচের তিনজন বেস্ট স্টুডেন্টই জীবনে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। সুকৃতর মতে সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ছিল সুঋতি। কিন্তু বিয়ে করে নিউফাউন্ডল্যান্ড না কোথায় চলে গেল — সুপ্রতীক বলে ফাউন্ড না, নিউলস্ট-ল্যান্ড — আর যোগাযোগও নেই। সুপ্রতীক আজ ওদের মধ্যে সবচেয়ে নামী শিল্পী। সেটা ওর চাকরির জন্যও বটে, তবে ট্যালেন্টেড তো বটেই। বটব্যালদা বলতেন, “তোরা আমার থ্রী shoes।” তিনজনেরই নাম সু- দিয়ে বলে থ্রী shoes ডাকতেন। বলতেন, “মনে থাকে যেন, জগতে ছাপ রেখে যাবি।” ছাপ, নাম, কারওরই থাকবে না। বটব্যালদা দুঃখ করতেন সুপ্রতীক ওর ট্যালেন্ট নষ্ট করল বিজনেস হাউসের পোষা কুকুর হয়ে গিয়ে, দুঃখ করতেন সুকৃত ভাল করে নিজের খ্যাতিবৃদ্ধির দিকে নজর-ই দিল না, মনমৌজি এঁকে গেল বলে। সবচেয়ে বেশি দুঃখ করতেন সুঋতিকে নিয়ে। ছবি ভুলে ঘর করছে কোথায়, হোয়াট আ ওয়েস্ট অব ট্যালেন্ট।
চা চাই। রান্নাঘরে ঢুকে সস্‌প্যানে জল ভরে গ্যাসে বসালেন। এক কাপ জল, দেরি হবে না। ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। সস্‌প্যানের নিচের আগুনের শিখার নীলটাই চাই। তার সঙ্গে শরতের রোদের হলদে।
গ্যাসের আগুনে একটা লালচে আভা? অনেক সময় বার্নারে কিছু আটকে থাকলে এমন হয়। পেঁয়াজের খোসা বা আলুর? রান্নার মাসি ঠিক করে পরিষ্কার করেনি? কোমর ভাঁজ করে নিচু হয়ে দেখতে যেতেই একটা অদ্ভুত জিনিস হল। শিখাটা দপ্‌ করে অনেকটা বেড়ে প্রায় সুকৃতর মুখ ছুঁয়ে, চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে নিভে গেল।
চট্‌ করে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে নব্‌ ঘুরিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু বন্ধ গ্যাসের নব্‌ হাতে ধরে চোখ বন্ধ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় মিনিট খানেক। তার পরে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালেন। মুখে স্মিত হাসি। সুপ্রতীক ইন্সপিরেশন নিয়ে প্যাঁক দিতে পারে, কিন্তু ব্যাটা ম্যাগাজিনের ইলাস্ট্রেটর এই চোখ বন্ধ করে ছবি দেখতে পাওয়াটা কোনদিন বুঝতে পারবে না। দ্রুত পায়ে স্টুডিওতে ফিরে গিয়ে হাতে তুলি নিয়ে যে রংটা লাগাতে শুরু করলেন, সেটা নীলও নয়, হলুদও না। গাঢ় বাদামী — প্রায় কালো।
২
মাস পাঁচেক পরে একদিন সকাল সাড়ে দশটায় যখন ফোন বাজল, তখন সুকৃত বসার ঘরে ইজি চেয়ারে বসে চোখ বুজে নতুন ছবি দেখছেন। গতকাল সুপ্রতীক আবার ফোন করেছিল। ওদের অনেক ম্যাগাজিনের একটার পূজাবার্ষিকীর প্রচ্ছদ এঁকে দিতে হবে। তরুণ সামন্ত নাকি বলেছেন, সুপ্রতীক যেন যে করে হোক সুকৃতকে রাজি করায়।
সুকৃত রাজি হয়েছেন। গ্যাসের ঘটনার তিন দিনের মাথায় ছবি আঁকা শেষ করে, চার দিনের দিন সুপ্রতীকের ভূয়সী প্রশংসায় অল্প হেসে, আরও দিন কয়েক পরে ট্যাক্সি করে দু’বন্ধু তরুণ সামন্তর বাড়িতে ছবি নিয়ে পৌঁছেছিলেন। সামন্ত ছবি দেখে বাক্যহারা, বিদায় দেবার সময় হাতে যে চেকটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটায় লেখা সংখ্যাটা পূর্বনির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। সেটাও কাজ করেছে প্রচ্ছদ আঁকতে রাজি হওয়ার পেছনে।
এই ভাবেই শিল্পী বিক্রি হয়ে যায়? তবে গত পাঁচ মাসে ছবির চাহিদাও বেড়েছে হঠাৎ। সুতরাং তরুণবাবুর সামন্ততন্ত্রকে বেশি না ডরালেও চলবে। ইজি চেয়ারে বসে বন্ধ চোখের পর্দায় পূজাবার্ষিকীর মলাট দেখছিলেন, এমন সময় মোবাইল বাজল।
নিগ্‌ঘাত নতুন কলার টিউনের বিজ্ঞাপন। উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বরটা দেখে একটু অবাক হলেন। বিদেশি নম্বর। বোতাম টিপে বললেন, “হ্যালো?”
“এটা কী আর্টিস্ট সুকৃত চৌধুরীর নম্বর?” ইংরেজিতে নারীকণ্ঠ! গত পনের বছরে সুকৃতকে কোনও মহিলা ফোন করেছে বলে তো মনে পড়ে না। শুধু সেই এক জন গ্যালারী মালিক করতেন কখনও সখনও। কিন্তু তিনি নেই অনেক দিন। আবার বিদেশ থেকে! বাপরে! বিদেশ থেকে সেই কবে শেষ কেউ ফোন করেছিল…
জবাব দিতে দেরি হওয়ায় আবার শোনা গেল, “হ্যালো?”
সুকৃত বললেন, “হ্যাঁ, সুকৃত চৌধুরী বলছি, বলুন। কে বলছেন?”
ওপারের কণ্ঠস্বর এবারে উচ্ছ্বসিত শোনাল। “কৃত, চিনতে পারলি? কে বলত?”
সুকৃত ধপ করে বসে পড়লেন। সুকৃত, সুপ্রতীক আর সুঋতির ‘সু-’ বাদ দিয়ে কৃত, প্রতীক আর ঋতি বলে ডাকা যে শুরু করেছিল, দেশ ছেড়ে সে চলে যাবার পরে বাকি দু’জন সে খেলা আর বজায় রাখেননি। “সু-… সুঋতি?” নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে থতিয়ে গেলেন সুকৃত।
খিলখিল হাসিটা বদলায়নি। হাসি শেষে সুঋতি বলল, “চমকালি তো? কেমন আছিস?” “ভাল… কিন্তু কী আশ্চর্য! এত দিন বাদে… তুই… কোত্থেকে? কী ব্যাপার…” আবার সেই হাসি। তারপর, “অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তোর নম্বর জোগাড় হয়েছে। খবর বল। কোথায় আছিস? কী করছিস? বিয়ে করেছিস? ছেলে-পুলে ক’জন? বউ কী করে?”
সুকৃত অকৃতদার। অনেকে বলত সুঋতি চলে যাবার পরে সুকৃত সব রকমের ইচ্ছাই জলাঞ্জলি দিয়েছেন। সুকৃত সেটা ঠিক বা ভুল প্রমাণ করার কোন চেষ্টাই করেননি কোনও দিন। সুকৃতর খবরে তাই সে সব অ্যাঙ্গেল নেই। খবর শুধু ছবি আঁকার — বা না আঁকার। তবে সুঋতির খবর আছে।
বিয়ে ভেঙেছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। এত দিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য কাজ করত। এখন ছেলে ভাল চাকরি পেয়েছে। বলেছে, তুমি ছবি আঁক, আমি স্পনসর করব। তবে এর মধ্যেই সুঋতির ছবির যা কদর হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে না ছেলের স্পনসরশিপ দরকার হবে। “এজেন্ট বলেছে, যথেষ্ট বায়ার্স আছে…”
সুকৃত বললেন, “বটব্যালদা থাকলে খুব খুশি হতেন।”
সুঋতি একটু থেমে বলল, “বটব্যালদা… নেই?”
“না, মাস ছয়েক হল। ক্যানসার… লাং।”
“স্মোক করতেন তো খুব…” “খুব। আমরা হাসপাতালেও দেখতে গেলেই ঝুলোঝুলি করতেন, ‘এনে দে না রে, একটা দে, মরেই তো যাব — সর্বাঙ্গে ছড়িয়েছে, জানিস তো — এই শেষ ইচ্ছেটা অন্ততঃ রাখ…’ এই সব বলতেন।”
সুঋতি জিজ্ঞেস করল, “তুই এখনও খাস?”
সুকৃত হাসলেন। “আমি? কোনও দিনই খেতাম না।”
সুঋতি বলল, “ওঃ, স্যরি, তুই না, প্রতীক খেত, তাই না? ওর কী খবর রে?”
সুকৃতর কি সামান্য দুঃখ হল, সুঋতি সিগারেটের ব্যাপারটা মনে রাখেনি বলে? মনটাকে ঝাড়া দিয়ে বললেন, “ও এখন বিখ্যাত ইলাস্ট্রেটর। বড় বড় ম্যাগাজিনে ওর ছবি দেখা যায়। ওর নম্বর আছে? দেব?”
সুঋতি বলল, “না, এখন না। আমি ফোন করেছি অন্য একটা কারণে। প্রায় বিজনেস্‌ রিজ্‌ন… কৃত, রিসেন্টলি তোর একটা ছবি বিক্রি হয়েছে নিউ ইয়র্কে, জানিস?”
না। নিউ ইয়র্কে? কে বিক্রি করেছে? কে কিনেছে?
“বড় ছবি — অ্যাবাউট চার ফুট হাইট। গোল্ডেন সানশাইন নামে বিক্রি হয়েছে।”
গোল্ডেন সানশাইন? সুকৃত কোনও দিন ইংরিজিতে ছবির নাম দেননি। তবে কখনও কোনও অবাঙালি খদ্দের ইংরিজি নাম দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে সুকৃতর ছবি কোনওদিন বিক্রি হয়েছে বলে জানেন না। তবে অত বড় ছবি জীবনে কটা এঁকেছেন, জানেন সুকৃত। একটা। নাম দিয়েছিলেন ‘শরততপনে’। গোল্ডেন সানশাইন কি তারই ইংরিজি?
“ছবিটা তুই দেখেছিস?”
জানা গেল, দেখেনি, বিশেষ কিছু জানেও না। তবে?
“কৃত, ছবিটা কত দামে বিক্রি হয়েছে জানিস?”
বিক্রি হয়েছে তাই জানতেন না, তায় দাম। কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। ওদিক থেকে সুঋতি বলে চলল ছবিটা কিনেছেন এক অজ্ঞাত ক্রেতা। প্রাইভেট সেল। কিন্তু তিনি খুব শিগগিরই সেটাকে নিউ ইয়র্কে একটা পাবলিক অকশনে প্রকাশ করবেন। এবং সেই অকশনের পূর্বাভাস হিসেবে সেই বিক্রেতার এজেন্ট বলেছেন ছবির আর্টিস্ট এক অজ্ঞাত, অখ্যাত ভারতীয়। এবং বলেছেন যে এই ছবি নাকি একপ্রকার অমূল্য!
অমূল্য? সুকৃতর ছবি! তাই বলেছেন এজেন্ট।
আপাতত একটা দাম ধার্য হয়েছে, তবে এজেন্ট আশা করছেন ছবি তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হবে। দামটা শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এত দামে সুকৃতর ছবি বিক্রি হবে? হতে পারে কখনও? তরুণ সামন্ত যা দিয়েছিলেন, তা আশাতীত বেশি ছিল — কিন্তু এ তো তার চেয়েও আরও, আরও অনেক বেশি! ঠিক ক’ গুণ, সুকৃত চট করে হিসেব করে উঠতে পারছেন না, কারণ নিজে পারিশ্রমিক পেয়েছেন টাকায়, আর এ হিসেবটা ডলারে…
সুঋতি বলে চলেছে, “আমার এজেন্ট আমাকে জানাল…”
এবার কথা কেটে সুকৃত বললেন, “তুই শিওর, আর্টিস্ট আমিই?”
“আমার এজেন্ট তোর নাম নিয়ে এসেছে। আমিও ইন্ডিয়ান, তাই… সুকৃত চৌধুরী নামে আর কোনও আর্টিস্ট তুই চিনিস, যে নিও-ইম্‌প্রেশনিস্ট আঁকে?”
না। কিন্তু… “আমার ছবি এত দামে বিকোবে আমি ভাবতেই পারছি না।”
“ছবিটা নিশ্চয়ই খুব ভাল। কিন্তু আমি কেন ফোন করেছি… আমার এজেন্টের কাছে খবর, তোর ছবি কেনার চেষ্টা করছে ওই এজেন্ট এবং ওর ক্লায়েন্ট, দুজনেই। ওর ধারণা তোর সব ছবিরই দাম অনেক বাড়বে। যারা তোর ছবি কিনেছে, সকলেই অনেক লাভে বেচতে পারবে। সুতরাং এই ব্যাপারটা সল্‌ভ্‌ হওয়া অবধি তুই তোর কোনও ছবি বিক্রি করবি না, বুঝলি? নানা ওয়েবসাইটে তোর ছবির যা প্রাইসিং দেখলাম, সবই রিডিকুলস্‌লি কম…”
পিঁক, পিঁক করে শব্দ এল সুঋতার কথা ছাপিয়ে। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে এক লহমা দেখলেন সুকৃত। কল ওয়েটিং — তরুণ সামন্ত।
আবার ফোন কানে দিলেন। “…বিক্রি করার কোন মানেই হয় না। সব ছবি তুই সরিয়ে দে — ডোন্ট সেল এনিথিং। তোর ছবির দাম যদি সাংঘাতিক বেড়ে যায়, ইউ শুড বী দ্য ফার্স্ট টু বেনিফিট, তাই না? হ্যালো, কৃত, শুনছিস?”
শুনছেন, এবং দ্বিমত পোষণ করছেন না, এই ফোন শেষ করেই সমস্ত ছবি বাজার থেকে তুলে নেবেন এমন কথা দিয়ে শেষ করলেন, যদিও সেটা করা উচিৎ হবে কি না, সেটা বুঝতে পারছেন না।
প্রায় তক্ষুনি আবার ফোন বাজল। “ভাল আছেন? ব্যস্ত কি? না হলে পরে ফোন করব?”
বাবা! এমন কণ্ঠস্বর তো আগে শোনেননি! বশংবদ না হলেও, প্রায় সেই গোছেরই। কিছু করছেন না, ছবি আঁকছেন না, ইত্যাদি শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ভদ্রলোক বললেন, “আপনার ছবিটা না, লোকে সাংঘাতিক প্রেজ করছে। অনেকেই আপনার ছবি কিনতে চায়। আর কী কী আছে, ফর সেল?”
“অত বড় ছবি তো…”
“না, না,” তাড়াতাড়ি বললেন সামন্ত। “বড় ছোট নিয়ে কথা নয়, যা আছে, তাতেই চলবে। আছে নিশ্চয়ই?”
“ইয়ে…” আবার কথা শেষ হল না সুকৃতর। “আমি আসতে পারি? কখন সুবিধা হবে আপনার? ধরুন দুপুরের দিকে?”
খটকা লাগল। বললেন, “আমি তো এখুনি বেরিয়ে যাব…”
“ফিরবেন কখন? সন্ধেবেলা? ধরুন ছ’টা-সাতটা?”
এত তাড়া? একটা দুষ্টুবুদ্ধি এল। বললেন, “ছবিটা কোথায় ডিস্প্লে করেছেন? একবার দেখতে পারি?”
একটু নৈঃশব্দের পর, “ডিস্প্লে…”
এবার সামন্তর কথা কেটে সুকৃত বললেন, “আজ আমি সন্ধের দিকে আপনার বাড়ির কাছাকাছি থাকব। আপনি বললে, সাতটা, সাড়ে-সাতটায় আমিই আপনার বাড়ি যেতে পারি।”
“না,” প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল কি? “আমি আজ কলকাতায় নেই… মানে… ইয়ে, বেরিয়ে যাব… ক’দিন পর ফিরব…”
এবার বেশ উৎফুল্ল গলায় সুকৃত বললেন, “বেশ তো, তাহলে আপনি ফিরে আসুন, তার পরেই নাহয় যাব।” তার পরে সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলে শেষ করলেন।
আর দেরি করা চলবে না। খাতা খুলে সুকৃত ডিলারদের, গ্যালারিগুলোর আর ওয়েবসাইটের ম্যানেজার না কী বলে তাদের নম্বর বের করে করে একে একে ফোন করলেন। হিসেব মত বাইশটা ছবি থাকার কথা ছিল, জানলেন তার মধ্যে ন’টা বিক্রি হয়েছে গতকাল রাত থেকে আজ সকালের মধ্যে। একজন ডিলার একাই তিনটে বিক্রি করেছেন। ওনার কাছে আর কোনও ছবি নেই। বললেন, “ঔর কুছ ভেজ দিজিয়ে, এক কাস্টমার মাং রহে থে…”
“কী নাম কাস্টমারের?”
“আরে বড়া আদমী হ্যয়।” বলে যে নামটা বললেন, সেটাই শুনবেন, জানতেন সুকৃত। যে কটা ছবি বাকি আছে সেগুলো বিক্রি হবে না, এমনকি ডিস্প্লে থেকে তুলে নেওয়া হবে সুকৃত আবার জানান’ অবধি, এমনটা গ্যালারি, ওয়েবসাইট, ডিলারদের বুঝিয়ে শেষ করতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। এর মধ্যে ছ’টা মিস্‌ড্‌কল সুপ্রতীকের। অন্য দিন হলে ফিরে ফোন করতেন। কিন্তু আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া, সুপ্রতীক কী বলবে সেটা তো আন্দাজ করতে পারছেন। দাড়ি তেমন গজায় না। সপ্তাহে বার দুয়েক কামালেই চলে, কিন্তু গতকাল কামান’র সত্ত্বেও আজও কামাতে ইচ্ছে করছে। কেন ঠিক বুঝছেন না, মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ছবি বেশি দামে বিক্রি হবে বলে? উঁহু। খ্যাতি বাড়বে বলে? নাঃ, তাও না। তবে? জানেন না সুকৃত। দাড়ি কামান’র মধ্যে আরও একবার, চান করে বেরিয়ে দেখলেন দু’বার ফোন করেছে সুপ্রতীক। এবার ফিরে ফোন করলেন।
“কোথায় থাকিস?” রাগ রাগ গলা। “দু’ঘণ্টা ফোন বিজি, তার পরে বাবু হাওয়া! ফোন ধরার নাম নেই।”
ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কেন? তোর বস্‌ কি জানতে চেয়েছে আমি কোথায়?”
একটু থতমত খেয়ে সুপ্রতীক বলল, “কেন, তা কেন? না, তা বলেনি — কিন্তু বসের জন্যই ফোন করলাম। তোর কপাল খুব ভাল।”
সুকৃত চুপ।
সুপ্রতীক বলল, “তোর সব ছবি এখন থেকে তরুণ সামন্ত কিনতে চাইছে।”
সুকৃত বললেন, “সব? তার মানে?” এবার সুকৃত বিরক্ত।
“সব মানে? জানি না তুই কী জিজ্ঞেস করছিস। সব মানে সব। ইংরিজিতে বলে ‘অল’।”
সুকৃত বললেন, “কেন?”
সুপ্রতীক বলল, “কেন মানে? তুই ইয়ার্কি করছিস? সামন্ত তোকে এত বড় একটা অ্যাসাইন্‌মেন্ট দিল, এত হ্যান্ডসামলি পে করল, তার ওপর এখন তোর সব ছবি কিনতে চাইছে, আর তুই কারণ খুঁজছিস?”
উত্তর না দিয়ে সুকৃত বললেন, “নতুন বাড়ি কিনছেন, না মিউজিয়াম বানাচ্ছেন তোর বস্‌?”
“তুই একটু ঝেড়ে কাশবি?”
“বেশ তবে শোন। আমি মাসে অন্তত একটা, কখনও দু’টো ছবি আঁকি। কোনও বছর যদি মেজাজ ভাল থাকে, বা বিক্রি কম হয়, প্রায় পঁচিশটা অবধি এঁকেছি। এটা কমিশন বাদ দিয়ে আঁকার কথা। তোর বস যদি এগুলো সব কিনতে চায়, তাহলে পাঁচ বছরে শ’খানেক ছবি হবে। কোথায় রাখবেন?”
সুপ্রতীক কিছু বলার চেষ্টা করছিল, সুকৃত বললেন, “শোন, ‘শরততপনে’ ছবিটা নাকি ওনার বন্ধুরা খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম ডিস্প্লেটা, উনি বলেছেন, উনি কলকাতার বাইরে, ফিরে হবে। আমার কী ছবি উনি কিনবেন, সেটাও নাহয় তখনই হবে।”
সুপ্রতীক অবাক। “কে কলকাতার বাইরে? তরুণ সামন্ত? কে বলল তোকে?”
“উনি নিজেই। বাইরে না? আমিও আন্দাজ করেছিলাম। যাই হোক, ওই ছবিটা কোথায় আছে, কীভাবে আছে না জেনে আমি সামন্তকে আর ছবি বেচছি না। সেটা তুই ওকে বলবি কি না আমি জানি না, কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।” ফোন কেটে দিলেন।
হঠাৎ রাগ হতে লেগেছে। বসের সঙ্গে মিলে এ কী রকম অত্যাচার বন্ধুর ওপর!
দু’তিন দিন কারওর সঙ্গে যোগাযোগ না করে কাটালেন। তেমন কেউ ফোনও করল না, দেখাও করতে এল না। কিন্তু এ ক’দিনে সুকৃত তিন তিনটে ছবি এঁকে ফেললেন। তার মধ্যে দুটো বড় — সামন্ত যেমন কিনেছেন, তেমন বড়।
তার পরে সুঋতির ফোনটা এল। এজেন্ট খবর পেয়েছে, আগামি পঁচিশে ছবির অকশন। কিন্তু তার আগে একটা অনুষ্ঠানে কার্ট ভ্যান ডাম্‌ আর আৎসুসি টাকেউচি কিছু একটা ডেমনস্ট্রেট করবেন।
এরা কারা? নামও শোনেননি জীবনে।
জানা গেল এনারা বিখ্যাত আর্ট ক্রিটিক। দু’জনেই জাপানি আর্ট স্পেশালিস্ট। এর তাৎপর্য কী, তা সুকৃত বা সুঋতির জানা নেই।
সুঋতি বলল, “আমার ভীষণ ইন্ট্রিগিং লাগছে, জানিস? আমি যেতাম, কিন্তু আমার মেয়ের কনভোকেশন সেদিনই। যেতে হবে অ্যালবার্টা। তবে আমার এজেন্ট থাকবে। ওরও জাপানি আর্টে ইন্টারেস্ট… তুই একবার সুপ্রতীককে জিজ্ঞেস করবি? ও তো থিয়োরিতে খুব স্ট্রং…” গত ক’দিনে সুপ্রতীকের সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি। কিন্তু সে কথা সুঋতিকে জানাবার নয়, হুঁ-হাঁ করে ফোন রেখে দিলেন।
পঁচিশে। তিন দিন আরও। অর্থাৎ আরও চারদিনের আগে কিছু জানা যাবে না।
দিন কাটে, সুকৃতর ছটফটে ভাবটা বাড়ে। কারওর সঙ্গে কথা বলতে পারলে হত। অনেকবার সুঋতিকে ফোন করতে গিয়েও করেননি। অনেক বার ভেবেছেন সুপ্রতীকের সঙ্গে কথা বলেন, কিন্তু…
তৃতীয় রাতে প্রায় ঘুমোতেই পারলেন না সুকৃত। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রাস্তায় হেঁটে এলেন এক চক্কর।লেকের ধারে ফুটপাথের দোকানে চা খেতে খেতে চোখের সামনে একটা ছবি ফুটে উঠল বলে চা’টা শেষ না করেই বাড়ি ফিরে ক্যানভাসে জেসো লাগিয়ে শুকোতে দিয়ে জল বসাতে গেলেন। তখনই দরজায় বেল বেজে উঠল।
এত সকালে কে? ভিজে হাতটা তোয়ালেতে মুছতে মুছতে দরজা অবধি যেতে যেতে আবার বাজল। কারও কোনও সমস্যা হয়েছে? সুকৃত পা চালিয়ে বসার ঘর পেরিয়ে দরজার পীপ্ হোলে চোখ রেখে অবাক হলেন। সুপ্রতীক। এত সকালে?
দরজা খুললেন। সুপ্রতীকের চুল উস্কোখুস্কো। চোখের নিচে কালি। সুকৃত বললেন, “কী হয়েছে?”
জবাব না দিয়ে ঢুকল সুপ্রতীক। বলল, “হিদাও নাকামুরার নাম শুনেছিস?”
সুকৃতর এক কাপ জল ফুটে গেছে। আর এক কাপ জল তাতেই ঢেলে দিয়ে সুপ্রতীকের দিকে ফিরে বললেন, “জাপানি?”
“জাপানি তো বটেই। নাম শুনেছিস কি?” না, শোনেননি। কী হয়েছে নাকামুরার?
“হিদাও নাকামুরা উনিশশতকের জাপানি আর্টিস্ট। খুব বিখ্যাত না। তার কারণ বেশি দিন বাঁচেননি বলে বেশি ছবি আঁকেননি। গোটা কুড়ি ছবির কথা জানা আছে, সাতটা আছে মেট্রোপলিট্যান মিউজিয়ম অফ আর্ট, নিউ ইয়র্কে, আর বাকি সবই জাপানে, বিভিন্ন মিউজিয়াম, ইত্যাদিতে…”
চা ভিজিয়ে আবার রান্নাঘরের দরজায় ফিরে এলেন সুকৃত। সুপ্রতীক টেবিলে রাখা কাগজটা খুলেছে। গতকালের কাগজ। আজকের কাগজ এখনও আসেনি।
মুখ তুলে সুকৃতর দিকে তাকিয়ে দেখল, বলল, “গতকাল নিউ ইয়র্কে অ্যাকারম্যান ফাইন আর্ট গ্যালারিতে তোর একটা ছবি বিক্রি হয়েছে…”
সুকৃত বললেন, “কোন ছবি?”
সুপ্রতীক একটু থতমত খেয়ে চুপ করে মাথা নামিয়ে চেয়ে রইল টেবিলের দিকে।
সুকৃত বললেন, “তোর বস্‌ যেটা নিয়েছিল, সেটাই?”
চট করে একবার চোখে চোখ রেখে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে ঘনঘন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল সুপ্রতীক।
“আর কার্ট ভ্যান ডাম্‌ আর আৎসুসি টাকেউচি কী বললেন?” প্রশ্নটা করে সুকৃত চা ছাঁকার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন, কিন্তু চায়ের পট হাতে নিয়ে ঢালার আগেই সুপ্রতীক রান্নাঘরের মধ্যে। “তুই সব জানিস, শালা… বল, সব জানিস…”
এবার হেসে ফেললেন সুকৃত। বললেন, “চা-টা ঢালি, তারপরে বলছি আমি কী জানি।”
আর রাখঢাক নয়, সুকৃত টেবিলে বসে চা খেতে খেতে সুঋতির ফোন থেকে শুরু করে, আজ অবধি যা জানেন সবই বললেন। সুঋতির ফোনের খবরটা জানাননি বলে যে যে মধুর সম্ভাষণ প্রাপ্য ছিল সেগুলো হজম করে বললেন,“নাকামুরার ব্যাপার কিছুই জানি না।”
সুপ্রতীক বলল, “তোর ছবি কাল কত দামে বিক্রি হয়েছে জানিস?”
জানেন না, তাই চেয়ে রইলেন। কেউ যদি সামন্তর কাছে অত দামে ছবি কিনে অকশন করে, তাহলে কত দামে বিক্রি হতে পারে?
দামটা শুনে এক লহমার জন্য সুকৃতর মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে কি? এর বেশি দামে ভারতীয় কোনও আর্টিস্টের ছবি বিক্রি হয়েছে কোনও দিন?
সুপ্রতীক হাসল। “হয়েছে। তোর ছবি কোনও রেকর্ড করেনি, তবে আর্ট ওয়র্ল্ড চমকেছে বইকি!”
“তুই এত জানলি কী করে?”
“কাল রাত তিনটের পর তরুণ সামন্ত ফোন করেছিল। পিস্‌ড্‌ ড্রাঙ্ক। ভীষণ আপসেট। তোর ছবি বেচে ঠকে গিয়েছে। আমি তখন থেকে পড়াশোনা করছি। আজ একটা ই-মেল করে এসেছি। বেশ হয়েছে, তোর ছবি কিনে বেশি দামে ভায়রাকে বেচে দেবার বেলায় মনে ছিল না?”
সুকৃত বললেন, “এবার তুই ঝেড়ে কাশ দেখি, ভায়রা আবার কে?”
সুপ্রতীক বলল, “তরুণ সামন্তর ভায়রা নাকি আর্ট বোঝে। নিউ ইয়র্কে থাকে। সেই নাকি কবে তোর কোন ছবি দেখে সামন্তকে বলেছিল, ‘বাঃ, বেশ তো,’ আর তখনই তরুণ সামন্ত ঠিক করে তোকে দিয়ে বড় ছবি আঁকাবে।”
সেই ছবিই ‘শরততপনে’। তার ফটো তুলে সামন্ত ভায়রাকে পাঠায়, আর সেটা দেখে ভায়রার এজেন্ট একটা হাই-রেজোলিউশন ছবি চান। এবং তার পরেই এজেন্টের কথায় ভায়রা ছবিটা কিনে নেয়, তরুণকে বলে সব ছবি কিনে নিতে। সুকৃত বিক্রি বন্ধ করার আগে অবধি তরুণ গত কয়েক দিনে কলকাতা, বম্বে, দিল্লীর ডিলারদের কাছ থেকে সুকৃতর সব ছবি কিনেছে, আর ওয়েবসাইট থেকে কিনেছে সামন্ত, ভায়রা আর এজেন্ট — তিনজনেই।
এক, কেন? দুই, এর মধ্যে ওই নাকামুরার কী অবদান? এবং তিন, ওই দুই আর্ট বিশেষজ্ঞ কাল কী বলেছেন?
“বলেছেন তোর আঁকা আর হিদাও নাকামুরার আঁকার স্টাইল নাকি একই রকম।”
“নাকামুরা উনিশ শতকে জাপানে বসে পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ল্যান্ডস্কেপ আঁকত?”
“জানি না,” বলল সুপ্রতীক। “আমি কাল বাকি রাত অনেক পড়েছি, অনেক খুঁজেছি। তোর মনে আছে, আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে একজন ইয়ং টিচার পড়াতে এসেছিলেন, যিনি কয়েক মাস পরে সুইসাইড করেন?”
মনে আছে। নাম মনে নেই।
“আমারও নেই। উনি আমাদের মাঝে মাঝে জাপানি আর্টিস্টদের কথা বলতেন না? একজনের কথা বলেছিলেন —কুরোদা সেইকি, মনে আছে?”
মনে নেই আবার! বিখ্যাত জাপানি ইম্প্রেশনিস্ট, এবং তার চেয়ে বড়ো কথা, নতুন করে জাপানি আর্টে ন্যুড ছবির প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে…
“এই হিদাও নাকামুরা হল সেইকির সমসাময়িক। তবে বলা বাহুল্য, সেইকির মতো প্যারিস গিয়ে আঁকা শেখেনি, মারাও গিয়েছে সেইকির অনেক আগে। এবং আমি যতটুকু বুঝলাম, আঁকার স্টাইলেও আকাশ পাতাল তফাৎ।”
তাহলে কেন…
“সেইকির কথাটা বললাম তোকে বোঝানোর জন্য। একটা পরিচিত নাম পেয়ে তো মজা লাগে, তাই। তবে কেন তোর আঁকার সঙ্গে নাকামুরার আঁকার সিমিলারিটি? পেলাম না কোথাও।”
ঘড়ির দিকে তাকালেন সুকৃত। নিউফাউন্ডল্যান্ড ন’ঘণ্টা পিছিয়ে। অর্থাৎ ওখানে রাত নটা। “আশাকরি সুঋতি এখনও শুয়ে পড়েনি। আজ ওর মেয়ের কনভোকেশন ছিল। টায়ার্ড থাকতে পারে।”
ফোন বাজার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরল সুঋতি। “আমি তোকে এখুনি ফোন করছি, কৃত — আই অ্যাম টকিং টু মাই এজেন্ট অ্যাবাউট ইউ।”
এখুনি বলে প্রায় দশ মিনিট দেরি করল। এর মধ্যে সুকৃত আর সুপ্রতীক আরও এক কাপ চা খেলেন। সুপ্রতীক প্রায় একশো বার পকেট চাপড়াল, আর বলল, “সিগারেট… কিনতে হবে…” সুঋতির ফোনটা যখন এল তখন সুকৃত উঠে পায়চারি করছেন আর সুপ্রতীক টেবিলে বসে। ফলে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা কানে দিল সুপ্রতীকই। প্রথমেই বলল, “কী রে! কেমন আছিস? সুকৃত ফেমাস হচ্ছে বলে খালি ওকেই ফোন করিস, কেমন?”
দু’জনের প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ হলে সুপ্রতীক বলল, “আছে, আছে, এখানেই আছে, একবার এই পা, আর একবার ওই পায়ে নাচছে… দাঁড়া, আমি ফোনটা লাউডস্পীকার করি। তাহলে ব্যাপারটা আমিও জানতে পারব। কেন ওই জাপানি নাকামুরা আর আমাদের আঁকামুরা সমান সমান…”
সুঋতি যা বলল সেটা এতই অদ্ভুত যে ওরা অবাক হয়ে গেল। নাকামুরা মোটেই অজানা অখ্যাত শিল্পী নন। বরং যারা জাপানি আর্ট নিয়ে লেখাপড়া করে, আর্টের বিশ্লেষণ করে, তাদের কাছে নাকামুরা একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং ফেনমেনন। তার কারণ ওনার ব্রাশ স্ট্রোক।
সুঋতি বলল, “নাকামুরার ব্রাশ স্ট্রোক নাকি অনন্য। সে নাকি স্কলারদের রিসার্চের বিষয় ছিল বহু দশক। এমনকি উনিশশো তেষট্টিতেও নাকি কেউ নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌ নিয়ে পিএইচডি করেছে। তার পরে গত কয়েক দশকে অত হইচই না হলেও বিদগ্ধজনেরা নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌ নিয়ে আলোচনা করে।”
সুপ্রতীক জিজ্ঞেস করল, “এর বিশেষত্ব কী?”
সুঋতি জানে না। সেটাই নাকি কাল ভ্যান ডাম্‌ আর টাকেউচি বুঝিয়েছেন সমবেত জনসাধারণকে। স্পেশাল অকশনের আগে। আর সেই সঙ্গে বলেছেন যে আজ অবধি কেউ কোনদিন নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌ নকল করতে পারেনি, এমনই কঠিন সে তুলির টান।
বিস্ময় বিমূঢ় সুকৃত ধরা গলায় বললেন, “আর আমি…”
সুপ্রতীক থেমে যাওয়া প্রশ্ন শেষ করল, “আর তুই বলছিস আমাদের এই সুকৃত হতভাগা নাকামুরা স্ট্রোক করতে পারে?”
সুঋতি বলল, “শুধু করতে পারে এমনটা না, ওরা সুকৃতর প্রায় গোটা পনের’ ছবি অ্যানালাইজ করেছে কাল। ওরা বলছে সুকৃত ইজ আ ন্যাচারাল নাকামুরা। ওর সমস্ত ছবিতে ওই একই তুলির টান।”
সুঋতি ফোন ছাড়ার পর দু’জনে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। সুপ্রতীক চট করে বাইরে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনল। সুকৃত হুইস্কির বোতল বের করলেন। সুপ্রতীক ঘড়ি দেখে বলেছিল, “এখন হুইস্কি খাবি? তোর মাথাটা গেছে।” কিন্তু সুকৃত যখন বললেন, “এখন যদি আমরা নিউ ইয়র্কে থাকতাম, খেতি, কি না?” তখন আর না বলল না। খানিকক্ষণের মধ্যেই গোটা ঘরটাকে ভরিয়ে ফেলল ধোঁয়ায়। একবার বলল, “বটব্যালদার কথাটা তাহলে তুইই রাখলি।” তারও অনেক পরে, অনেকটাই জড়ান’ স্বরে বলল, “তোর ব্রাশস্ট্রোক স্টাইল আলাদা, চাইনিজ… আমি অনেক বার বলেছি।”
ঠিক কথা। বলেছে।
“তোর মনে আছে,” বলে চলল সুপ্রতীক, “বটব্যালদা বলত, ব্রাশস্ট্রোক কক্ষণও নিজে নিজে আসে না, কোনও শেখা থেকে আসে?”
মনে আছে।
“তাহলে? তোরটা কোত্থেকে এল?”
এ প্রশ্ন সুকৃত অনেক করতেন নিজেকে, কলেজে যখন সুপ্রতীক ওর আঁকা নিয়ে মন্তব্য করত। উত্তর পেতেন না, বরং একটা গভীর অস্বস্তি হত বলে ভাবতেন না। আজ সুপ্রতীকের প্রশ্নে সেই অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল। কিছু বললেন না।
৩
এর পরের কয়েক সপ্তাহ কোথা দিয়ে গেল সুকৃত জানতেও পারলেন না। হাজার ফোনের শুরু হয়েছিল সুঋতির এজেন্টকে দিয়ে। তার পরে দেশি-বিদেশি নানা এজেন্ট — সকলেই সুকৃতর একমাত্র রিপ্রেজেন্টেটিভ হতে চান। সেই সঙ্গে খদ্দেরদের ফোন। সমস্যা হয়েছিল খানিকটা তরুণ সামন্তকে নিয়ে। তবে তাঁকেও সুকৃত সসম্ভ্রমে জানিয়েছেন যে তাঁর জন্যই আজ সুকৃতর নাম ছড়িয়েছে — সুতরাং তাঁকে ছবি নিশ্চয়ই দেবেন সুকৃত, এমনকি বাজারদরের চেয়ে খানিকটা কম দামেই। সামন্ত আর ফোন করেননি, লোকজনকে বলে বেরিয়েছেন, সুকৃত অকৃতজ্ঞ।
সেই সঙ্গে এসেছে মিডিয়া। প্রথমে বিদেশি, তার পরেদেশি। কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি। হঠাৎ হয়ে উঠেছেন বিশ্বের, ভারতের, বাংলার সবচেয়ে চর্চিত শিল্পী।
নিজে অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ড আর জাপান গিয়েছেন বিভিন্ন শিল্প সংস্থার ডাকে। দেখা করেছেন ভ্যান ডাম্‌ আর টাকেউচির সঙ্গে। তাঁরা সি.এন.এন-এর ক্যামেরার সামনে শুকনো তুলি ধরে দেখিয়েছেন, ঠিক কী ভাবে ধরলে, কী ভাবে টানলে নাকামুরা স্ট্রোক আঁকা সম্ভব। হাঁ করে দেখেছেন সুকৃত। ক্যামেরা নিয়ে মিডিয়ার দল গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। ক্যানাডা থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে সুঋতাকে। সুকৃতর বেড়ে ওঠার গল্প তৈরি হয়েছে শহরের নানা গলি ঘুরে। ইন্টারভিউ দিয়েছে দুই বেস্ট ফ্রেন্ড। কখনও আলাদা, কখনও তিনজন এক সঙ্গে। “তোর কল্যাণে আমরাও বিখ্যাত হয়ে গেলাম,” বলেছিল সুপ্রতীক। সুঋতি এক চাঁটি মেরে বলেছিল, “তুই আর বকিস না, তুই এমনিই যথেষ্ট বিখ্যাত। আমারই লাভ হল। আমি বলব — থ্যাঙ্ক ইউ, কৃত।” মুখ্যমন্ত্রী এসে দেখা করে গিয়েছেন সুকৃতর বাড়িতে। জানতে চেয়েছেন, কী এই তুলির টান, বাংলা মিডিয়া যেটাকে বলছে ‘নাকামুরা-চৌধুরী-তুলি-টান’? এর মধ্যে ভ্যান ডাম্‌ আর টাকেউচির টিউটোরিয়াল ইউ-টিউব থেকে পেন ড্রাইভ বন্দী করে দিয়ে গিয়েছে সুপ্রতীক। সেটাই চালিয়ে দেখিয়েছেন সকলকে। লাইভ ডেমনস্ট্রেশনের কথায় হাতজোড় করে বলেছেন, কাজ করেন একাই। কেউ থাকলে হাতে তুলি নিতে পারেন না। আর ‘কোথা থেকে শিখেছেন?’ প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেই ভেতর থেকে উথলে ওঠা অস্বস্তিটা জোর করে দাবিয়ে দিয়ে হতাশ হেসে বলেছেন, “জানি না।”
গত ক’দিন বি.বি.সি-র টিম কলকাতায় রয়েছে। সব কাজই তাদের শেষ, কিন্তু সুকৃতর তুলির টান ক্যামেরাবন্দী না করে ফিরবে না — এই তাদের ধনুকভাঙা পণ। রোজ ফোন করে জ্বালাচ্ছে। গতকাল ওদের ফোন তোলেননি সুকৃত।
আজও যখন ফোনটা বাজল, সুকৃত প্রথমে হাত বাড়াননি। তার পরে মনে হল, যদি অন্য কেউ হয় — তুলে দেখলেন, সুপ্রতীক।
বাড়ি আছেন জেনে বলল, “আসছি, বেরোস না কোথাও।”
হাজির হল ঝড়ের মত। ওদের মিডিয়া হাউসের টিভি চ্যানেল এখন বি.বি.সি-র সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। সুতরাং ওর ওপর দায়িত্ব পড়েছে, সুকৃতর ছবি আঁকার সম্পূর্ণ দৃশ্য যেন বি.বি.সি ক্যামেরায় ধরতে পারে।
আঁতকে উঠে সুকৃত বললেন, “ছবি আঁকতে অন্তত দু’তিন দিন লাগে — সারাক্ষণ ক্যামেরা লাগিয়ে বসে থাকবে নাকি ওরা?”
সুপ্রতীক হেসে বলল, “আরে না না, একটা ক্যানভাসে কাজ করছিস, সেটার দশ-পনের মিনিট শট নেবে। এত টেনশন করছিস কেন? নিজের মত আঁকবি, ওরা ছবি নিয়ে চলে যাবে। ব্যস, এই তো।”
সুকৃত উত্তর দিলেন না। সুপ্রতীক গেলে পরে ওর দেওয়া পেনড্রাইভটা টিভিতে ফিট করে ভিডিওটা আবার চালালেন — নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌…
৪
দিন কাটে। গড়ায় মাসে, মাস গড়ায় বছরে… দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। সকালে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুকৃতর নিজেকে বৃদ্ধ লাগে। চারপাশে তাকিয়ে দেখেন বাড়িটাও বড্ড ন্যাড়া। দেওয়ালগুলো ফাঁকা। কেবল সুপ্রতীকের শিব আর সুঋতির সী-স্কেপ। বাকি ছবিগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। দেওয়ালে ফ্রেম-এর আউটলাইন ধরে কালচে ছোপ। ক’দিন আগেও মাঝে মাঝে ভাবতেন আবার ছবি এঁকে ভরিয়ে দেবেন, কখনও বা ভাবতেন বাড়ি রং করিয়ে শুধু সুপ্রতীক আর সুঋতির ছবিদুটো বসার ঘরে রেখে দেবেন — আর কোন ছবিই থাকবে না।
আজ আর সে সব দরকার নেই। সুকৃতর কাজ শেষ। নিজের সব ছবি বিক্রি করে দিয়েছেন। অপেক্ষারও শেষ হয়েছে। সুকৃতর ছবি নিয়ে মাতামাতি কমে এসেছে। দৈনিক একাধিক ফোন থেকে আজ সুকৃতর ফোন প্রায় বাজে না বললেই চলে।টিভি চ্যানেলরা আর ইন্টারভিউ চায় না। ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও ফোন করেন না। তাঁরা জানেন গত তিন বছরে সুকৃত কাউকে হ্যাঁ বলেননি। দুটো মানুষের ফোন আসে। ওরা জানতে চায়, কী আঁকছিস? সুকৃত হেসে বলেন, “জানাব।”
স্টুডিওর ঘরে এখন আর কোনও ছবি নেই। ক্যানভাসগুলো গোছান। এদিক ওদিক ছড়ান ছবি নেই। অসম্পূর্ণ ছবিও না। একমাত্র ব্যবহৃত ক্যানভাস সেটাই, যেটার ছবি বি.বি.সি নিয়ে গেছে। যতটুকু বি.বি.সিকে দেখান’র জন্য তুলি চালিয়েছিলেন ততটুকুই রং সেই ক্যানভাসে। এটা না রাখলেও চলত, কিন্তু রাখতে হবে ব্যাপারটা বোঝান’র জন্য।
দরজায় ঘণ্টি বাজল। বাইরে চটের ব্যাগ নিয়ে লুঙ্গি পরিহিত সুকৃতর মিস্ত্রী। “ছবি প্যাক হবে খবর দিয়েছিলেন?”
দরজা খুলে ছেলেটাকে ঢুকিয়ে সুকৃত সুপ্রতীক আর সুঋতির ছবিদুটো দেখিয়ে বললেন, “ওই দুটো। অনেক দূর যাবে। ভাল করে করবি। দেখ ভেতরের ঘরে বাব্‌ল্‌ র‍্যাপ কাগজগুলো আছে।” ছেলেটা কাজ করে যেতে না যেতে আবার দরজায় কে এল। আবার দরজা খুললেন। বাইরে ছেলেটি সেলাম করে বলল, “গাড়ি এসে গেছে, বাবু।”
এবার সুকৃত একটা ঢাউস আর একটা ছোট স্যুটকেস, আর সুন্দর করে প্যাক করা ছবি দুটো দেখিয়ে বললেন, “এগুলো গাড়িতে রাখ। বড়টা রাখবে ডিকিতে, ছোটটা পেছনের সিটে, ছবিগুলোও সিটে রাখবে।”
সুকৃত ফিরে গেলেন ডাইনিং টেবিলে। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে হবে আর এক বার। সেটাই হবে একেবারে শেষ কাজ।
৫
“তোদের দু’জনকে একসঙ্গে লিখছি। হাতে লেখা চিঠি, একটাই কপি। একজন পাবি অরিজিন্যাল, অন্যজন জেরক্স। কে কোনটা পাবি আমি জানি না। কিন্তু বক্তব্য একটাই। আমি চলে যাচ্ছি, সেটা তোরা হয়ত এই চিঠি পাবার আগে জানতে পেরে যাবি। হয়ত জানবি না। এর মধ্যে ফোন করলে জেনে গেছিস যে নম্বরটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।
অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছি। নাকামুরার কল্যাণে যা নাকানি-চোবানি খেয়েছি, তার আর পর নেই।
সুপ্রতীক, তোর মত জোক করার চেষ্টা করলাম, মাপ করিস।
একটা এক্সপ্ল্যানেশন দেবার চেষ্টা করি। তোরা, বিশেষ করে সুপ্রতীক বার বার জিজ্ঞেস করেছিস, মিডিয়া পাগল করে দিয়েছে — কোথা থেকে পেলাম এই নাকামুরা ব্রাশস্ট্রোক? বাঙালি শহুরে ছেলে, মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ, যার ঊর্ধ্বতন চোদ্দপুরুষে কেউ কোনও দিন ছবি এঁকেছে বলে জানা যায়নি, সে কী করে এমন এক ব্রাশস্ট্রোক আবিষ্কার করল?
সুপ্রতীক, আমাদের মধ্যে তুইই বেশি ভাবিত — এখনও বলিস, গাইডেন্স নিশ্চয়ই ছিল। আমি কখনও মনে করতে পারিনি, কিন্তু প্রশ্নটা করলেই আমার একটা অস্বস্তি হত, যেটা চাপা দিতে আমি কলেজ জীবন থেকে তোর প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করতে শিখেছিলাম।
কিন্তু এবার আর অগ্রাহ্য করা গেল না। এত বার, এত ভাবে, এত লোকের কাছে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল, যে আমি দিশেহারার মত হয়ে যেতে লাগলাম। খালি মনে হতে লাগল, আমার জীবনে জাপানি কেউ ছিল, সে কিছু একটা করেছিল, কিন্তু কী, তা ভেবে পাই না। ক্রমে এমন হল যে গত কয়েক বছরে আমি রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি, স্বপ্নে জাপানি আর্টিস্ট দেখে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছি, রাত্তির তিনটের সময় বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল ঢেলেছি — আর ভেবেছি, এটা কি সত্যি? নাকি বার বার শুনে শুনে আমার মনই জাপানি গাইডেন্স সৃষ্টি করছে?
হঠাৎ, কী করে বলছি একটু পরে, সবটা মনে পড়েছে।
আমার তখন বোধহয় পাঁচ কী সাত বছর বয়স, কী এক দুরারোগ্য অসুখ করেছিল। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ছিলাম বেশ কয়েক মাস, তার পরে ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেন পড়াশোনার চাপ কমিয়ে দিতে। এক মাসি থাকতেন শান্তিনিকেতনে। মেসো নিয়ে গেলেন। এক বছর, বা তার বেশি সময় ছিলাম ওখানে। সেখানে একজন জাপানি আর্টিস্ট ছিলেন, মাসির বাড়িতে থাকতেন। নাম জানি না। ইন ফ্যাক্ট, কিছুই মনে ছিল না। এইটুকু মনে আছে, আমি শান্তিনিকেতনে দুপুরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, কিংবা ছবি আঁকতাম। কোনও কথাই হয়নি বোধহয় আমাদের মধ্যে। মনে তো পড়ে না এখনও। আমি হিন্দী ইংরিজি কিছুই জানতাম না। উনি বাংলা এক অক্ষরও বলতে পারতেন না। ছবি আঁকতেন, আমি দেখতাম। আমাকে কাগজ দিয়েছিলেন, আর একটা তুলি, তার সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি পেন। আমি ছবি এঁকে দেখাতাম, উনি দেখিয়ে দিতেন, কখনও হাত ধরে তুলির টান দিতেন। যাবার আগে কয়েকটা তুলি আমাকে দিয়ে যান। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, মেসোমশাই কেন বাবাকে বলেছিলেন আমাকে ছবি আঁকা শেখাতে। নিশ্চয়ই ওই আর্টিস্টের কথাতেই। আরও একটা কথা মনে পড়ছে। সুঋতি, তোর বাবা অফিসের কাজে জাপান গিয়েছিলেন — তোকে একসেট বাঁশের জাপানি তুলি এনে দিয়েছিলেন, মনে আছে? তুই সেগুলো কোনও দিন ছুঁয়েও দেখিসনি, কিন্তু আমি সেগুলো তোর কাছ থেকে নিয়ে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন জাপানি ঢঙে অয়েল করতাম? বাঁশের ছবি, বাঁশপাতার ছবি, তোরা হাসতি, নানা বানানো জাপানি নামে ডাকতি আমাকে। সুপ্রতীক, তুই তো এসব রিসার্চ করতে পারিস। আমার পাঁচ সাত বছর বয়সে কোন কোন জাপানি আর্টিস্ট বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন, বের করতে পারবি? তিনিও কি কোনও অজ্ঞাত নাকামুরা? দেখ হয়ত তাঁকে তুই-ই আবিষ্কার করবি। এখন আমার মাসি মেসো কেউই আর নেই, সন্তানহীন ছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করার কেউ বাকি নেই। এখন আমি নিশ্চিত — ওনার সেই স্টাইলই আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। ভাবিওনি, জানতামও না। আমার পার্থিব পোজেশন সব গোছাতে গিয়ে ওই তিনটে জাপানি তুলি আর একটা ক্যালিগ্রাফি পেন খুঁজে পেলাম বাবার ব্যাঙ্কের লকারে। কেন বাবা সেগুলো লকারে রেখেছিল কে জানে! কিন্তু সেই মুহূর্তে কেমন আলাদীনের গুহার দরজা খুলে গেল, বন্যার জলের মত, জলপ্রপাতের মত স্মৃতির বাঁধ ভেঙে গেল। এই মনে পড়া যে কী আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, যে এর ভেতর দিয়ে না গিয়েছে, সে বুঝবে না।
কিন্তু আজ আমি আর তুলি ধরতে পারছি না। ছবির পর ছবি আমার মনের চোখে ভেসে উঠছে— কিন্তু তুলি ধরলে আর কিছুই হচ্ছে না — কেবল টাকেউচির আঙুল আর কবজি ভেসে উঠছে। কোন অ্যাঙ্গেলে তুলি ধরে, কোন অ্যাঙ্গেলে ক্যানভাসে লাগিয়ে, কী ভাবে টানলে নাকামুরা স্ট্রোক হয়, সেটাই মাথায় ঘুরছে। বার বার দেখছি ভিডিওটা, আবার না দেখে নিজের মত আঁকার চেষ্টাও করছি, কিছুই আর হচ্ছে না। এবার বুঝছি কেন বলেছে জেনেবুঝে নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌ আঁকা যায় না। গত আড়াই-তিন বছরে একটাও ছবি আঁকিনি। শুধু ক্যানভাসের পর ক্যানভাস নষ্ট করেছি। সব ফেলে দিলাম, শুধু ইজেলে রেখে দিলাম একটা। ওই যেটার ছবি নিয়ে গিয়েছে বি.বি.সি। দেখে বুঝবি কী রকম স্ট্রোক এঁকেছি। আমার খ্যাতির কারণটা জানাই আমার সর্বনাশ করল।
আমার ছবি নিয়ে মাতামাতি শেষ হয়ে গিয়েছে, বেশ বুঝছি। অর্থাৎ আমার পনের মিনিটের খ্যাতি শেষ। আর আমি শুধু আলেয়ার পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, নাকামুরা স্ট্রোক্‌স্‌ ধাওয়া করে।
আর ভাল লাগছে না। এমনিতেই এ শহরের ধুলো ধোঁয়া আমার দম বন্ধ করে দিত, কিন্তু যেতে পারতাম না, যাব কোথায় — এ কথা ভেবে। নাকামুরা আমায় মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর কল্যাণে আমি আজ বড়লোক। এবং এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না, যে তরুণ সামন্ত আর তাঁর নাম না জানা ভায়রাভাইকে এর জন্য ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। মানানসই এবং নাটুকে দুইই হত যদি দুটো দারুণ ছবি ওঁদের উপহার দিতে পারতাম। কিন্তু ছবিগুলো সব বিক্রি করার আগে ওঁদের ওপর রেগে ছিলাম, ভেবেছিলাম ওঁরা আমায় ঠকিয়েছেন, তাই মাথায় আসেনি, যে ওনারা যা করেছেন, সেটা ওনাদের হক, আমাকে ঠকান’র জন্য করেননি। এখন চাইলেও ওঁদের ছবি এঁকে দেবার উপায় নেই।
কোথায় যাচ্ছি বলে গেলাম না। ভেবেছিলাম ছবি আর আঁকব না, তাই সরঞ্জামও কিছু নিইনি। কিন্তু ওই জাপানি তুলি তিনটে আর ক্যালিগ্রাফি পেনটা নেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিয়ে যাচ্ছি। যদি নিজেকে আবার খুঁজে পাই, যদি ছবি আবার বেরোয়, তোদেরই আগে জানাব।
বাড়ির চাবিটা কেয়ারটেকারের কাছে। বলা আছে, সুপ্রতীক, তোকে দেবে। তুই অনেকদিন বলেছিলি, একটা যুতসই জায়গা পেলে মনের মত একটা ছবি আঁকার স্কুল খুলবি, যেখানে বাঁধাধরা ছবি-রং-করা শেখান হবে না, ট্যালেন্ট খোঁজা হবে, নার্চার করা হবে — আলমারির চাবি রয়েছে বসার গরে চেস্ট অব ড্রয়ারের ওপরের ডানদিকের টানায়। আলমারিতে তোর নামে বাড়ির দানপত্র লেখা আছে। বাড়িটায় অ্যাকাডেমি করিস। আর তা যদি না করতে চাস, যা খুশি করিস, আমি দেখতে আসব না।
সুঋতি, তোর নাম এই চিঠিতে কম আছে, তার কারণ গত পনের বছরে তোর সঙ্গে আমার কথা হয়ইনি। কেবল গত ক’দিনে একটু টেলিফোন যোগাযোগ হয়েছে। তবু, অনেক কথা সুপ্রতীকের নাম লিখে বলা সত্ত্বেও সবগুলো তোকেও বলা, সেটা আশাকরি তোর বুঝতে অসুবিধা হবে না। চললাম, ইতি।
———————————————————————
আন্তর্জাতিক পাঠশালা, জানুয়ারি – জুন ২০১৬, বার্ষিক সংখ্যা, ২০১৬, পৃঃ ৩৫০ – ৩৬৭
PrevPreviousস্মৃতি নিয়ে বলছি-২
Nextআমি অরাজনীতিতে বিশ্বাস করি না।Next
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

“রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি – বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক”

November 17, 2025 No Comments

বামপন্থীরা (বা কমিউনিস্টরা) রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে গালাগালি করেছিল – দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা এই বহুল প্রচারিত কুৎসা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। প্রথম কথা এটি একটি অর্থ সত্য

এ কোন ‘বাংলা’?

November 17, 2025 No Comments

রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জেল থেকে ঘর ওয়াপসি ঘটলো। জেল থেকেই উনি বেসরকারি ঝাঁ চকচকে নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেই নার্সিং হোমের দরজা দিয়ে

উত্তেজক বিহার বিধানসভা ভোট ২০২৫ এবং তারপর

November 17, 2025 No Comments

গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের মাধ্যমে সকলেই জেনে গেছেন। তথাপি সংক্ষেপে ফলাফলটি তুলে ধরিঃ ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (NDA)  মহাগঠবন্ধন (MGB) বি জে পি (৮৯ আসন) (২০.৬% ও

আমাদের পয়সায় সুপ্রিমে পাড়বে সে ডিম

November 16, 2025 1 Comment

★ আমাদের পয়সায় সুপ্রিমে পাড়বে সে ডিম। আইন? সে তো প্রতারণা। কার্নিশে গড়াচ্ছে হিম। জাগল চন্দ্রচূড়। ফণা জেগে ওঠে সুওমোটো। মেয়ে খুন হয়ে যায়। হাড়হিম

পাঠ্যপুস্তক যখন ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার

November 16, 2025 No Comments

সম্প্রতি এনসিইআরটি (ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ এডুকেশানাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং) প্রকাশিত অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বই নিয়ে তথ্য বিকৃতি ও একটি বিশেষ মতাদর্শের ইস্তেহার বানানোর অভিযোগ উঠেছে।এই

সাম্প্রতিক পোস্ট

“রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি – বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক”

Dr. Samudra Sengupta November 17, 2025

এ কোন ‘বাংলা’?

Sukalyan Bhattacharya November 17, 2025

উত্তেজক বিহার বিধানসভা ভোট ২০২৫ এবং তারপর

Bappaditya Roy November 17, 2025

আমাদের পয়সায় সুপ্রিমে পাড়বে সে ডিম

Dr. Arunachal Datta Choudhury November 16, 2025

পাঠ্যপুস্তক যখন ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার

Suman Kalyan Moulick November 16, 2025

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

590841
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

[wppb-register]