আট বছর আগের কথা। নন্দীগ্রাম এক নম্বর ব্লকের মহেশপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র দেখতে গিয়েছি। ফেরার সময় গাড়িতে উঠতে যাবো, একদল যুবক ঘিরে ফেললো। তাদের দাবি তাদের কিছু কথা শুনতে হবে। তাদের হাবভাব খুব একটা বন্ধু সুলভ নয়, রীতিমত কঠোর চোখমুখ। কি আর করা যাবে, ঘেরাও হওয়ার অভ্যেস আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা শুরু হল।
মূল দাবি একটাই, এই হাসপাতালে ইনডোরে রুগী ভর্তি চালু করতে হবে। আগে না কি হত, এখন অনেকদিন বন্ধ। কথায় কথায় এক জন জানালেন সেই ডাক্তার যিনি একার হাতে রুগী ভর্তি করে সামলাতেন তার নাম ডা: সন্দীপ স্যান্যাল। ঘটনাচক্রে এই সন্দীপ আমার সামান্য জুনিয়র হলেও ওকে খুব ভালো করেই চিনতাম। সে কথা বলেও ফেললাম।
ছোট বড় নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে যখন উঠতে যাবো, এক যুবক খপ করে হাতটা ধরে বললো, “একটু দাঁড়ান স্যার। সন্দীপ স্যারের সাথে এইমাত্র ফোনে কথা হল, উনি আপনার খুব সুখ্যাতি করলেন, আপনাকে এই ভাবে আমরা যেতে দিতে পারি না। আপনি ওনার বন্ধুলোক।” ততক্ষণে দেখি আরেকজন যুবক এগিয়ে এসেছে, তার হাতে একটা হাঁড়ি। হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা। আমার দিকে এগিয়ে বললো, “খান স্যার”। কি আর করি, খেতে হল দুটো। সমস্বরে আবার আসবেন স্যার ধ্বনির মধ্যে গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম। যেতে যেতে ভাবছিলাম যে সন্দীপ এখনো কত জনপ্রিয়। স্রেফ ওর চেনা এটা জানতেই এত খাতির!
স্বাস্থ্য ভবনে থাকার সময় ওর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছি, অসম্ভব সৎ, পরিশ্রমী, এই ছোট ভাইটি দপ্তরের একটি এসেট, জুনিয়র- সিনিয়র, সব সহকর্মীদের মধ্যে সমান জনপ্রিয়। ও যে হাসপাতালের সুপার ছিল সেই ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফার্মাসিস্ট থেকে ওয়ার্ড মাস্টার, সবাই আমায় সন্দীপের বন্ধু বলে অতিরিক্ত খাতির যত্ন দেখিয়েছে। আমাদের দুজনেরই গুরু ছিলেন ডা: অনিরুদ্ধ কর। গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সন্দীপও স্পষ্ট বক্তা। কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পিছপা হয়নি কোনোদিন। এমন কি মুরশিদাবাদের সিএমওএইচ হওয়ার পরেও ওর এই স্বভাবটা পাল্টায় নি।
আজ খবর পেলাম সেই সন্দীপ আজ মার খেয়েছে উত্তেজিত জনতার হাতে বিনা কারণে। সেই জমায়েতে একজন এমএলএ ও একজন সভাধিপতিও ছিলেন। তা সত্ত্বেও সন্দীপ মার খেয়েছে। আমার এই লেখা সন্দীপের জন্য নয়। ওর বুকের ছাতি খুব বড় মাপের, যে বুক দিয়ে ও তার চাকরি জীবনের শুরু থেকে আমাদের এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাকে আগলে রেখেছে। আমার লেখা অন্যদের জন্য,যাঁরা ওকে চেনেন না তাঁদের জন্য। আমি জানি না আমার এই লেখা মুরশিদাবাদের কেউ পড়বেন কিনা। যদি পড়েন, সেই আশাতে বলছি, আপনারা অতি ভাগ্যবলে এমন সিএমওএইচ পেয়েছেন। ওকে নিগৃহীত করে তাড়িয়ে দিলে আপনদেরই ক্ষতি। সন্দীপের কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। চাকরি ছেড়ে নন্দীগ্রামের যেকোন গাছতলায় বসে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলে বাকি জীবনটা ওর ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। আপনারা এই অপকর্মের জন্য ওর কাছে ক্ষমা চান। যারা অপরাধ করেছে তাদের চিহ্নিত করে পুলিশের হাতে তুলে দিন। মহা পাপ করেছেন, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুন। কতগুলি নির্বোধ, ধান্দাবাজ নেতার কথায় নেচে ওঠা বন্ধ করুন। মানুষ চিনতে শিখুন। মানুষ হয়ে উঠুন।