যখন অনুরোধের আসর শেষ হয়ে যেতো। অথবা ঠাকুমার ঘরে আটটার নাটক শেষ হয়ে যেতো, তখন হয়তো মা ডাকতো “আয় তপ্পি একটু বসে নে।” একটু পর খেতে দেবো। হয়তো ছোটবেলার কথা বলতো “তখন ওপার থেকে এসে তোর দোদো-এলাহাবাদে। বাড়িতে-গরু ছিলো।ছোটবেলা থেকেই। আমাদের বাড়ির পাশে একটা বিরাট বাগানওয়ালা বাড়ি ছিলো। সামনে দিয়ে রেল লাইন গেছিলো। বিরাট একটা গোলাপ বাগান। কতো রকমের গোলাপ। জহরলাল নেহেরু থাকতো সেই বাড়িতে। একবার একটা বাচ্চা ফুল চুরি করেছিল বলে’ সবাই মিলে খুব মেরেছিলো।”
যতই নেহেরুর নামে শিশুদিবস হোক, আমি আর কোনোদিন নেহেরুকে ভালোবাসিনি।
শীতের সন্ধে শেষ হয়ে আসতো। বেগুন পোড়া মাখতে মাখতে বলতো
“ঠিক চারটের ট্রেনটা বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যেতো আর আমার ক্ষিদে পেতো। তখনই তোর দোদো আমাকে গরু দুইয়ে টাটকা দুধ ফুটিয়ে দিতো। তখন বুঝলি আমার গালদুটো ফোলা ফোলা ছিলো।সবাই আমাকে মেমবাচ্চা বলতো”
মা জানতেও পারে নি, যখন বিস্মৃতি মা’কে ঘিরে ধরেছে, যখন মা এসে পৌঁছেছে একটা ছোট্ট নার্সিং হোমের ছোট্ট কেবিনে-তখনও আয়ারা আমার বুড়ি মা’কে মেমদিদাই বলতো।
তার পর আসতো বর্ষা। ঘন নীল মেঘের পাল এসে ঘিরে ধরতো আকাশ। লাল মাটি আর নীলাঞ্জন ছায়ার মিলটা ভারি মিষ্টি লাগতো। রাঢ় বাংলার বর্ষা ভারি সুন্দর। শাল পিয়ালের পাতারা সব স্নান করে’ ধুলোমাখা গৈরিক পোষাক ছেড়ে সবুজ রংয়ে সেজে ওঠে। রাস্তায় কাদা নেই। বয়ে চলেছে জলের ধারা। একবার আমাদের শান বাঁধানো আঙিনায় একটা মা শঙ্খচূড় তার ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা গোটা পঁচিশ ছানা পোনা নিয়ে হিলহিলিয়ে চলে গেছিলো। আমি, মা, বাবা, টোটোন, টুলটুলি, মাসিমণি, সবাই চুপটি করে সেই মিছিল দেখেছিলাম।
সুন্দরবনের মতো রাঢ় বাংলাও সাপের দেশ। বাবা শিখিয়েছিলো কী ভাবে লাঠির আড়াঅড়ি এক ঘায়ে সাপের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে হয়।
এরপর আমার জীবনে এলো গল্পের বই। হুগো, স্বপনকুমার, সব নতুন নতুন পূজাবার্ষিকী মনিহার, উপহার, শুকতারা-সুধীন্দ্রনাথ রাহা, নটরাজন, হাঁদা ভোঁদা, লরেল হার্ডি, অরণ্যদেব। তারপর এলো কিশোর ভারতী। সূর্য রায়ের ঋজু রেখায় প্রচ্ছদ, দীনেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দূরন্ত ঈগল, টীক, জুরা-তখনই এলো নকশাল আন্দোলন। পাড়ায় পাড়ায় পুলিশের জীপ। ইশকুলে ইশকুলে টোকাটুকি। ইশকুলে আগুন, হত্যা, পুলিশের হাতে এবং নকশালদের হাতে। বিপ্লবটা বুঝি নি, একটা দমবন্ধ ভয় অনুভব করেছিলাম। আমি তখন লোকপুর হাই স্কুল। ঐ নিচু ক্লাসেও তখন টোকাটুকি। এখনকার মতোই, তবে প্রশ্ন বলে দেওয়া( সাজেশন নাম দিয়ে) অবশ্য ছিলো না।
একদিন বাবা অফিস থেকে অনেক অনেক রাতে ফিরলো। মা সন্ধে থেকেই চুপ করে বসে ছিলো বারান্দায়। একটা মোড়া নিয়ে। টোটোনের বাবা-মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রির টিচার, বলে গেলেন ঘোষবাবুর অফিস পুলিশ সীল করে দিয়েছে। বাবা তখন মেডিক্যাল কলেজের সেক্রেটারি। নকশাল ছাত্ররা এসে বাবার অফিস ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। এই পুরোনো, জংধরা ব্যবস্থা তারা মানবে না। কিন্তু কিছুই কি বদলালো, আজও?
ঐ ছাত্ররা সবাই বাবার পরিচিত-প্রিয়পাত্র।
“ঘোষসাহেব,ঐ ছাত্রদের নামগুলো বলুন। আমরা জানি ওরা আপনার ঘনিষ্ঠ। আপনার চেনা….”
না। বাবা একজনের নামও বলেনি। তারপর চাকরিতে শাস্তিমূলক বদলি। বাবা ধুবুলিয়ায়। মা বাঁকুড়া। চিঠিপত্র আতসকাচে ফেলে যাচাই করা হতো।
“এলাহাবাদ থেকে তোর দোদো ফিরে এলো কলকাতার লোয়ার রেঞ্জ, পার্ক সার্কাস (কী আশ্চর্য লাগে জাতিদাঙ্গা থেকে বাঁচতে শেষে সেই মুসলমান এলাকায়?) দোদোর চাকরি জুটছে না। দিদু-হয়তো বংশগতিতে-হয়তো এই তীব্র ঘৃণার অভিঘাতে-তখন পাগল হয়ে গেছে।মায়ের হাতে সংসার। রান্না বান্না, কাজ কর্ম ভাই বোন, দাদা সবাইকার স্কুলের খাবার তৈরি-অভাগিনীর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।
ক্রমশঃ