আরেক ফাল্গুন। বসন্তের দিন। দোল এসে গেছে। দিনপঞ্জিকায়। এসেছে পলাশ শিমূলের ফুলে। সকাল বেলা আমরা বেলিয়াতোড় গেছিলাম। আমাদের পৈতৃক ভিটে। এখন অবশ্য ঘাড়মুড় গুঁজড়ে পড়ে আছে। সেখান থেকে গঙ্গাজলহাটি। আমি, মা আর বাবা।
“বাবা গঙ্গাজলহাটিতে কি আছে বাবা?”
“পলাশ আছে শিমূল আছে-শালের বন আছে-দেখবি ওখানে নীল আকাশে লাল রংয়ের আগুন লেগেছে…” (সঠিক বাক্যবন্ধটা মনে পড়ছে না। তবে আকাশে আগুন লাগার কথাটা বাবা বলেছিলো)।
বাসে গোটা রাস্তায় মা কোনও কথা বলে নি। বাস একটা লালমাটি কাঁচা রাস্তায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল। দূরে তাকিয়ে দেখি পড়ন্ত ফাল্গুনী বিকেলে শিমূলে পলাশে নীল কমলা আকাশে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কী যেন জিগ্যেস করেছিলাম। মা বাবা কেউ উত্তর দেয় নি।
আমি হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সবাই পায়ে হেঁটে একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে এলাম। প্রায়ান্ধকার-ঝুলে ভর্তি-পলস্তারা খসা-”এটা তোর মায়ের কোয়ার্টার ছিলো”
মা হঠাৎ বলে উঠলো “তুমি যদি তখন কাছে থাকতে…..”
তারপর আমরা শালবনের ভেতরে মস্তো একটা শিমূল গাছের গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। আকাশে হাত ছড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ধুপধাপ করে শিমূলের ফুল ঝরছে। দূরে বেনেবৌ ডেকে ডেকে বাড়ি ফিরছে। মা নিচু হয়ে সেই বৃদ্ধ গাছের পায়ের কাছে বসে পড়লো। বাবা অস্ফুটে বললো “সুন্দর..”
দুহাতে গাছের কাঁটাভরা কান্ডে আদর করতে করতে মা বললো “আমার সুন্দরকে দেখে রেখো…বেঁচে থেকো…চিরকাল…নাহলে ও একলা হয়ে যাবে”
পরে বাবার ডায়েরি থেকে জেনেছি-আমার বড়ো ভাই সুন্দর নিউমোনিয়া রোগে-এক বছর বয়সে মারা যায়। বাবা তখন চাকরির খোঁজে অন্য কোথাও। সেই দিনটায় দোল ছিলো। আমার মা বাবা আর কোনোদিন দোল খেলেনি।পুরোনো রীতি অনুযায়ী আমার বড়োভাই সুন্দরকে এই বিরাট শিমূল গাছের তলায় মাটির গভীরে রেখে যাওয়া হয়েছিল। আমার মা বাবা জীবনের সব রং রেখে গেছে গঙ্গাজলহাটির এই বুড়ো শিমূলের শিকড়ে,মাটির গভীরে।বেঁচে থাকুক শিমূল, পলাশ, শাল পিয়ালের জঙ্গল, বেঁচে থাকুক বেনে বৌ, বেঁচে থাক রাতচরা প্যাঁচা আর চিড়িক চিড়িক কাঠবিড়ালি-সবাই মিলে দেখে রাখুক আমার না দেখা ভাইকে।
আমি যখন হই, তখনও বাবা থিতু হয়নি। এই চাকরি থেকে অন্য চাকরি। সঙ্গে বি.এ পড়া; পথের পাঁচালির মতো চাকরির পাঁচালি। মা ছোট্ট আমাকে নিয়ে চলে গেল দন্ডকারণ্যে। কেন? সে আমার অজানা অধ্যায়। আমি তখন ছ’মাসের। হয়তো তখন সেখানে বিজলি ছিলো না। লন্ঠন জ্বালানোর সুতলি দিয়ে আমাকে ঘিরে মা আমার উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজে যেতো। বলে যেতো “তপ্পি, দ্যাখ চারপাশে কতো সাপ! একদম এই বিছানাটুকুর বাইরে যাবি না” পাছে আমি গড়িয়ে চলে যাই। জানিনা আমি তখন কী খেতাম। জানিনা সেই সাপের রেখা ভেঙে বেরিয়েছিলাম কিনা। সেই রুক্ষ মালভূমি তার তীব্র গরম আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, ঢেউ খেলানো প্রান্তর আর এক ছ’মাসের শিশু সহ এক নখে দাঁতে লড়ে যাওয়া মা’কে স্থান দিলো।
তারপর সেজমামা বি.এ. পড়া ছেড়ে এলো ভাগ্নের দায়িত্ব নিতে। বাস্তার, দন্ডকারণ্য সম্বন্ধে আমার যেটুকু জানা-জীবনের পাঠের অনেকটাই আমার সেজমামার কাছ থেকে। ততদিনে বাবা বি.এ. পাস করেছে। দন্ডকারণ্যে কিছুদিন থেকে হলো এস.ডি.ও.-দিনহাটা। কুচবিহারে। মা’ও সরকারি চাকরি নিয়ে চলে এলো দিনহাটা। মা চাকরি করতো বলে কোনোদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে নি। হাড় বার করা, কঠোর ভূমি থেকে সোজা সজল শ্যামল, ঘনসবুজে ঢাকা উত্তরবঙ্গ। ওখানে বৃষ্টি হয়ই না, এখানে কথায় কথায় আকাশের চোখ ভরে জল আসে। এবার বুঝি আমার মায়ের জীবনের একটা স্থিতি এলো।
একটা ছোট্ট কোয়ার্টার, সামনে ইশকুল, সজনে গাছের ফুল। সন্ধ্যায় সবুজ চোখের শেয়ালের আনাগোনা। সবুজে সবুজ।সাজানো ছবির মতো।
ক্রমশঃ