[আমার মা কিন্তু খুব গরীব ঘরের বড্ড সাধারণ একটা জেদী মেয়ে।জীবনী লেখার মতো বিরাট কিছু কাজ করে নি।যেটুকু সমাজসেবা করেছে-অপ্রকাশ থাকাটাই ভালো। তবু একটা সময় আর একটা জীবনযাপন বদলে যাওয়ার ছবি হিসেবে থাকুক এই লেখা]
সে অনেক দিনের কথা। আমি জন্মেছিলাম সিউড়িতে। জ্যেঠামশাইয়ের বাড়িতে। ষষ্ঠী তলায়, বুড়ো বটগাছের তলার ঘরটিতে। নাড়ি কেটে আমাকে প্রথম কোলে নিয়েছিলেন আমার জ্যেঠিমা। মা বাবার থিতু হওয়ার আগে জ্যেঠামশাইয়ের বাড়িটাই ছিলো আমাদের সবার আশ্রয়। পিতৃহারা হয়ে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে ভেসে যেতে যেতে শুধু হায়ার সেকেন্ডারি (ইন্টার)পাশ ছেলেটা যখন আমার মা’কে সঙ্গে পেয়ে লড়াই করে এম.এ. পাস হয়ে ডাব্লিউবিসিএস অফিসার হলো তখন পর্যন্ত। ছোটোকাকা, সমুকাকা, পিসিদের থাকা,পড়া -সব-ঐ সিউড়ির বাড়ি (বাড়ি কিন্তু নয়-ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টার); এমনকি আমার ব্যায়ামবীর, অসীম সাহসী ছোটমামাকেও মা এনে সিউড়ির এলসি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিল। কলকাতা তখন ছোটমামার পক্ষে একটু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলো।
আমরা বাঁকুড়ায় আসার পর সবাইকার আরেকটা জায়গা হলো। বাঁকুড়া এলআইসি কোয়ার্টার; এ ৯; ঠাকুমা এসে থাকলো তার “মেজছেলের” বাড়িতে আর পিসিরা তাদের মেজদা আর মেজবৌদির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে থাকতো।এছাড়া ছিলো আমাদের বেলেতোড় (আমি বলি যামিনী রায়ের গ্রাম, গাজনের মেলার গ্রাম) গ্রামের লোকজন। তারা সুবিধে অসুবিধেয় অমলদা আর বৌদির কাছে চলে আসতো। বিশেষত অসুখ বিসুখে। আমার মা কি তখন সুখী হয়েছিলো? কোনও ব্যক্তিগত পরিসর নেই। খাওয়া ঘুমের জায়গা নেই। প্রায়ই মেঝেতে ঢালাও বিছানা-হৈ হৈ। অবশ্য হিন্দু নারীদের শ্বশুরবাড়ির সেবা করাটাই সুখ হিসেবে দেখা হয়। মা হয়তো সেই শিক্ষা থেকে বেরোতে পারে নি-অথবা….
না সেটা জানা হয়নি। কিন্তু মা কতোটা প্রথাগত হিন্দু বৌ ছিলো সেটায় সন্দেহ আছে, তবে বাবার প্রতি ছিলো অসীম ভালবাসা। শাড়ি গয়নায় আকর্ষণ ছিলো না। বিয়েটাও অন্য রকম।জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া একজন কবিকে, যে কিনা ভাইবোনেদের জন্য শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে সিকিমের রাস্তা জরীপের কাজ করছে।
স্মৃতি বড়ই অদ্ভুত।কতো অকারণ, ছোটো ছোটো কথা মনে পড়ে।
বাড়িতে প্রথম প্রেসার কুকার, শীতকালে মাথায় তোরঙ্গ নিয়ে কেক, পেস্ট্রি বিক্রি করতে আসা, প্রথম টেরিলিনের কাপড় আসা….তুচ্ছ…. তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব কথা। এই সবের মধ্যে জড়িয়ে মড়িয়ে রয়েছে আমার মায়ের কথা।
বড়ো ছুটি পড়লে দোদোর বাড়ি। বজবজ, রবীন্দ্রনগর। চক্রধরপুর হাওড়া ট্রেনে রাতে কলকাতা যাওয়া-কতো ছোট্ট সব স্মৃতি! কাশ্মীর নয় কন্যাকুমারী নয়-শুধু দাদুর বাড়ি-গঙ্গা থেকে হাতে ঝুলিয়ে টাটকা ইলিশ, সামনের খালে ছিপ নিয়ে মাছধরা-দোদো আমাকে একটা ছিপ বানিয়ে দিয়েছিলো। দুপুরে দোদোর পাশা খেলতে যাওয়া, ভাদ্রের রোদে মাঠ শুকিয়ে এসেছে-আমি খালে, বিলে, নর্দমায় ছিপ ফেলে বসে আছি। রাতে আলোয়ান জড়িয়ে রামলীলা শোনা।
ওখানে মাকে আর পাওয়া যেতো না। দিদুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতো, বাগানে-গোয়ালে- গরুদের কাছে-ছাতের পায়রাদের কাছে। দেশভাগের দাঙ্গার প্রভাবে দিদু তখনও নিজের মনে চাটগাঁইয়া ভাষায় বকবক করতে করতে রান্না করতো।ভারী মিষ্টি অন্য রকম একটা গন্ধ বেরোতো, টিউকলের জল উঠতো ক্যাঁচকোঁচ শব্দে। দিদুর বেড়াল গুলগুলি লেজ ফুলিয়ে পাশে বসে থাকতো-মা বসে বসে দেখতো। তখন মা গৃহকর্ত্রী নয়-কন্যা মাত্র।
যখন আঁধার থাকতো দোদো ঘুম থেকে উঠে সারা ঘর ঘুরে ঘুরে কীর্তন গাইতো-একদম বেসুরো; আমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো-মা কিন্তু তার মধ্যেই গুটিশুটি ঘুমিয়ে থাকতো।
আজ মনে হয় কোনটা আমার মা? দোদোর কাছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা? নাকি হাসপাতাল থেকে ফিরে একঘর অতিথিকে নিজের ভাতটুকুও তুলে দেওয়া সংসারী গিন্নি?
বুঝতে পারছি না।
ক্রমশ সংসার তার সমস্ত ওজন দিয়ে মায়ের জীবন নিংড়ে রং রূপ রস সব বার করে নিলো।
ক্রমশঃ